হাসপাতালে সব থেকে আলাদা এই রুমটা। সারি করে মোট দশটা বিছানা পাতা। প্রায় প্রতিদিনই একেকটা বিছানা খালি হচ্ছে। একেকজন মানুষ মরে গিয়ে শুন্য করে দিয়ে যাচ্ছে বিছানাগুলো। আবার কয়েক ঘন্টার মধ্যের সেই বিছানা দখল করে নিচ্ছে আরেকজন। সেও মরে যাচ্ছে। ভাগ্য ভালো হলে দু একজন কেবল বেঁচে উঠছে। এই ঘরটার নাম বাবলী রেখেছে মৃত্যুপুরী। প্রতিদিনই কোন না কোন আগুনে পুড়া মানুষ তার কাবাবের মত ঝলসানো শরীর নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। বেশির ভাগই মারা যাচ্ছে।
এই রুমে বাবলি আছে আজ প্রায় এক সপ্তাহ হল। নিত্যদিন স্মৃতিতে যোগ হচ্ছে ভয়াবহ কোন স্মৃতি। তবুও দাঁতে দাঁত চিপে সব সহ্য করে যাচ্ছে। কিছু সময় থাকে মানুষকে অগ্নি পরীক্ষা দিতে হয়। এটিও সেই অগ্নি পরীক্ষার সময়। গত সপ্তাহে তার মা বেগম নুর জাহান আগুণে পুড়ে ঝলসে গেছে। ডাক্তার জানিয়েছে তার শরীরের সাইত্রিশ পারসেন্ট পুড়ে গেছে। এমন রোগীরা বেশির ভাগ সময় বাঁচে না। এ কথা শুনে সে আর তার বড় ভাই বাবলা খাম্বার মত খুঁটি গেড়ে দাঁড়িয়েছে তার মায়ের পাশে। যে যাই বলুক তারা তাদের কর্তব্য পালন করে যাবে। মায়ের সেবায় কোন কমতি রাখা চলবে না। মাকে সারিয়ে তুলতে হবে।
গত এক সপ্তাহ রাতে ঘুমায়নি বাবলি। দিনেও খুব একটা ঘুমানোর সুযোগ পায় না। গতকাল একটু চোখ বুজেছিল এমন সময় শোনে ডাক্তারের কন্ঠ,'' এই রোগীর ডায়াবেটিস আছে। সিস্টার জলদি ইনসুলিনের ব্যবস্থা করো।'' বাবলি লাফ দিয়ে উঠে বলেছে ,''না না আমার আম্মার ডায়েবেটিস কখনোই ছিল না। এখন হবে কেমন করে?''
ডাক্তার কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে বলে,'' আপনার আম্মার ডায়াবেটিস আমি বানায় দেইনি মেডাম। এটা রিপোর্টে এসেছে।''
বাবলির সব ঘুমে উবে গেছে। সে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে দেখে রিপোর্টে কুঁড়ি উঠে আছে। সে আবার প্রতিবাদ করে ,''আমার আম্মার ব্লাড সুগার এত না ডাক্তার। এই রিপোর্ট ভুল।''
সে ফোন করে তার ভাই বাবলাকে ডাকে,'' বাবলা এসে আবার আম্মার ব্লাড সুগারটা চেক করে নিয়া আয়।'' বাবলা আবার যায় রিপোর্ট চেক করাতে।
বাবলা বাবলির বড় ভাই। বাবলা বয়স চল্লিশ আর বাবলির আটত্রিশ। প্রায় সম বয়সী হওয়াতে বাবলি তাকে নাম ধরেই ডাকে।
কিছুক্ষণ পর বাবলা রিপোর্ট নিয়ে আসে। এবার রিপোর্ট ঠিক এসেছে। তার আম্মার ডায়াবেটিস নেই। প্রথম রিপোর্ট ভুল ছিল। ওটা অন্য কারো রিপোর্টের সাথে গুলিয়ে গিয়েছিল।
হাসপাতালে রোজ এমন কোন না কোন ঘটনা ঘটেই চলেছে। তারপর রোগীকে ড্রেসিং করানোর মত ভয়াবহতা তো আছেই। সে আর তার ভাই বাবলা অনবরত ছুটোছুটির করে সমস্যাগুলোর সমাধান করছে।
ঘর সংসার ফেলে বাবলা বলা যায় হাসপাতালেই পড়ে আছে। তবুও রোজ তিনবার তাকে বাড়ি যেতে টিফিনবাটিতে করে খাবার জন্য। এর মধ্যে কয়েকবার তার স্ত্রী হনুফার সাথে তার ঝগড়া হয়ে গিয়েছে। সকাল দুপুর রুটি বানাতে পারলেও রাতে বানাতে বিরক্ত সে। গতকাল বাবলার মুখের উপর বলে দিয়েছে ,''দোকান থেইকা পাউরুটি কিন্না নিয়া যাও। আমার কোমড়ে ব্যাথা। রুটি বেলতে পারুম না।''
বাবলাও সমান তেজে বলেছে,''আমার মা মৃত্যু শয্যায় আর তুমি কয়টা রুটি বানায় দিতে পারবা না? তুমি মানুষ না। অমানুষ! ''
স্বামীর ধমক খেয়ে হনুফা ককিয়ে বলেছে,'' তোমার মায়ের ঘরে গেলে তার বিছানাতে পর্যন্ত আমার ছেলেটারে উঠতে পর্যন্ত দেয় না। সেইদিন পোলাটা দৌড়ায় উইঠা পড়ল বইলা তারে গাইল পারল ছুত আলা বুড়ি।''
বাবলা আর কথা বাড়ায় না। এখন ঝগড়ার করার সময় তার হাতে নেই। আর এগুলো তাদের বাড়ির নিত্যদিনকার ঘটনা। তার মা নূর জাহান বেগমের ছুঁচি বায়ু রোগ আছে। তিনি তার বিছানায় কারো উঠা পছন্দ করেন না। এমন কি নিজের ছেলে মেয়ে নাতীদেরও না। অথচ বাবলার ছেলে দুটো সুযোগ পেলেই লাফ দিয়ে যেয়ে দাদীর বিছানায় গিয়ে উঠে বসে। আর বৃদ্ধা চিল্লাপাল্লা শুরু করেন। এ নিয়ে হনুফাও মনে মনে ফুসতে ফুসতে থাকে। মাঝে মাঝে উত্তরও দিয়ে দেয় ,'' একটু বিছানায় উঠছে তো কি হইছে? ছোট মানুষ বোঝে বইলাই তো উঠে। যদি বুঝতো ওদের দাদী এমন তাইলে জীবনেও উঠতো না।''
আর ওমনি শ্বাশুড়ি বউয়ে মুখ কালাকালি,কথা বন্ধ দুদিন। তারপর আবার নিজেরাই কথা বলবে। তিন দিনের বেশি কারো সাথে কথা বন্ধ করে থাকা ঠিক না।
বাবলি আজ সাত বছর হয় মায়ের সাথে থাকে। স্বামী ভাগ্য তার হয়নি। বিয়ের দুবছরের মাথায় স্বামী রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। তারপর তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে এসেছে বাবার বাড়ি। স্বামীর মায়ায় আর দ্বিতীয় বিয়ের দিকে পা বাড়ায়নি। এ নিয়েও নূর জাহান বেগমের চিন্তার কমতি নেই। মেয়েকে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য পীড়া দিতে গিয়ে অহেতুক কথায় মেয়ের সাথেও বেঁধে যায় ঝগড়া। এভাবেই পারিবারিক খুনসুটিতে চলে তাদের সংসার।
বাবলার খাবার নিয়ে হাসপাতালে পৌছাতে পৌছাতে রাত দশটা বেজে যায়। বাবলি দুধের সাথে রুটি ভিজিয়ে মাকে খাওয়াতে গেলে তিনি ফিরিয়ে দিয়ে তীক্ষ্ণভাবে লক্ষ্য করেন মেয়ের হাতের দিকে ,''কিরে বাবলি হাত ঠিকমত ধুইছিস তো?
-জ্বী আম্মা ধুইছি।
-কয়বার ধুইছিস?
-আম্মা পাঁচ বার ধুইছি। দুইবার ডেটল আর স্যাভলন দিয়ে, তিন বার সাবান দিয়ে।
-সত্যি ধুইছিস? নাকি মিথ্যা বলিস আমার সাথে?
-আম্মা আপনার এত সন্দেহ করা স্বভাব বাদ দেন তো।
মেকি রাগ করার ভান করে বাবলি। তবে মনে মনে খুশিও হয়। তার মা বোধয় কিছুটা সুস্থ হয়েছে। এখন আবার আগের মত সন্দেহ করা শুরু করেছে। এই কদিন তো একদম লাশের মত প্রতিক্রিয়াহীন ছিল। আগে বাসায় খাওয়ার আগে সে পাঁচ বার হাত ধৌত করতো। বাবলি এতবার ধৌত করতে চাইতো না বলে সে তার হাতের রান্না করা খাবার খেতে চাইতো না। বাসায় এই স্বভাব নিয়ে বিরক্ত হলেও এখন বাবলি স্বস্তি বোধ করছে।
কিন্তু তার স্বস্তি বেশিক্ষণ টিকলো না। রাত বারোটার দিকে হঠাৎ তার মায়ের শ্বাস কষ্ট উঠেছে। এ সময় ডাক্তার বা নার্স কেউ নেই। বাবলিই দৌড়ে গিয়ে পাশের রুম অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আসে। তার মায়ের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এই বুঝি মারা যাবে! আর এত রাতে মারা গেলে লাশ নিয়ে কি করবে সে ভেবে অস্থির। বাবলাও সাথে নেই। আজ সারাদিন অনেক খেটেছে সে। রাতে মায়ের অবস্থা একটু ভালো দেখে বাসায় ঘুমাতে গেছে। আর আজ রাতেই এই অবস্থা!
হঠাৎ পাশের কেবিন থেকে কান্নার সুর ভেসে আসে। ওখানে কেউ একজন মারা গেছে। বাবলি দরজা ভিড়িয়ে দেয়। কান্নার শব্দ যেন এই রুমে না আসে। আসলে তার মা ভয় পেয়ে যাবে। তখন আবার শুরু হবে নতুন মসিবত। এমনিতেই রাতের হাসপাতালকে গোরস্থানের মত মনে হয় বাবলির কাছে। সাধারণ কাজগুলো করতে গেলেও কেমন যেন একটা ভয় চেপে ধরে।
সারা রাত এক ফোটা ঘুমাতে পারে না বাবলি। সকালে দিকে তার মায়ের অবস্থা একটু ভালো হলে চোখ লেগে আসে তার। চেয়ারের হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে সে। এমন সময় পাশের বেডে শুরু হয় আরেক মহিলার আহাজারি। তার ছেলে মারা গেছে। ওয়ার্ডবয় নার্সরা জলদি লাশ সরিয়ে নিয়ে ঐ বেডে আরেকজন পোড়া রোগীকে এনে শোয়ায়। বাবলি তার মায়ের দিকে তাকায়। বিঘোর ঘুমে মগ্ন তিনি। তাকে ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়েছে।
ঘন্টা দুয়েক পর ঘুম থেকে উঠে নুর জাহান বেগম জিজ্ঞাসা করেন -''কিরে বাবলি পাশের বেডের ছেলেটা কই? আমি ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলাম ও মারা গেছে। ওর মা কান্নাকাটি করতেছে।''
-কি বলেন আম্মা? ওতো সুস্থ হয়ে গেছে। ওর মা ওরে বাড়ি নিয়ে গেছে।
-আমারে মিথ্যা কথা কইস না বাবলি। নুর জাহানের কন্ঠে অবিশ্বাস।
- আমি মিথ্যা কথা বলি? আপনি নার্সদের জিজ্ঞাসা করেন।
নার্সরাও তাকে একই কথা বলল। ছেলেটা সুস্থ হয়ে গেছে। তাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রোগীদের সাথে এমন অভিনয়ে তারা অভ্যস্থ।
প্রায় দুমাস অক্লান্ত খাটুনির পর মাকে সুস্থ অবস্থায় বাড়ি নিয়ে যায় বাবলা বাবলি। সন্তানের ভালোবাসার কাছে পরাজিত হয় মৃত্যুপুরীর ভয়াবহতা। আবারো মান অভিমান হাসি খুশি, ক্ষনিকের দুঃখ খুনসুটিতে মেতে উঠে তাদের পরিবার। আর এভাবেই ভালোবাসা আর মায়ায় জড়িয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে ভালোবাসার বন্ধনগুলি। আর মানুষ হয়ে পড়ে খুনসুটির মায়া জালে আবদ্ধ।