গল্পঃ অনুভূতির গুঞ্জরন
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
মাঝে মাঝে মনে হয় এ জগতে আমিই কেবল একমাত্র পরাজিত, আর সারা জগত জয়ী। এই ইট পাথরের শহরটা জয়ী, আশে পাশের মানুষগুলো জয়ী, জয়ী এই জনবহুল শহরের মাঝের এই একতলা বাড়িটা যেখানে আমি লজিং থাকি। সবাই যেন আঙুল তুলে আমাকে দেখায় ”ভি” চিহ্ন। আর আমি বোকার মত ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকি। তাদের উপহাসে মাথা নিচু করে বেঁকে যাওয়া বাঁশের মত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। এছাড়া আর কি বা আমার করার আছে? আমি তো আসলেই বোকা। নয়ত এভাবে কেউ ঠোকে আসে? দশহাজার টাকা নিয়ে গিয়েছিলাম একটা সেকেন্ডহেন্ড স্মার্ট ফোন কিনতে। আমার ভার্সিটির এক বন্ধুর দূরসম্পর্কের কাজিন বলেছে মেনেজ করে দিবে। ছেলেটার সাথে আমার আজই প্রথম পরিচয়। কথায় কথায় জানালো একটা ফোন বিক্রি করবে সে। এর বাজার দর ষাট হাজার টাকা। মাত্র ২ মাস হয়েছে কিনেছে। কিন্তু এখন জরুরী টাকার দরকার হওয়াতে অল্প দামে বেঁচে দিবে। আমি সুযোগটি লুফে নিলাম। এত ভালো ফোন কোন দিন আমার কেনার যোগ্যতা হবে না। ফোনটা ওজনে বেশ ভারী। দামি জিনিস, একটু ভারী তো হবেই। আমি টাকাটা ওর হাতে বুঝিয়ে দিয়ে ফোনটা পকেটে ভরে সোজা বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। বলা যায় না পথে না আবার ছিনতাইকারী ধরে। সামান্য একটা ফোনের জন্য আজকাল রাস্তাঘাটে মানুষ খুন পর্যন্ত হয়।
বার বার পকেটে হাত দিয়ে ফোনটাকে ছুঁয়ে দেখছিলাম। আমার বহু শখের ফোন। কিন্তু বাড়িতে এসে ফোনে সিম লাগানো নিয়ে হল বিপত্তি। কিছুতেই ফোনের সিম লাগানোর অংশ খুলতে পারছিলাম না। ফোনটা নিয়ে গিলাম রওশন চাচার কাছে। ওনার বাড়িতেই আমি লজিং থাকি। তিনি ফোনটা দেখে খুশি হয়ে বললেন ,”বাবা শোভন ফোনটা খুব সুন্দর হয়েছে। টিউশনের টাকা দিয়ে কিনেছো বুঝি?” আমি মাথা ঝাঁকালাম। নতুন ফোন দেখে চাচী সালেহা বেগম আর শাওন এসে দাড়িয়েছে পাশে। অনেক কায়দা কসরতের পর চাচা ফোনের সিম লাগানো অংশ টেনে তুলে আনলেন। কিন্তু ফোনের ভিতরটা দেখে আমাদের সবার চোখ ছানাবড়া! ফোনের বাহিরের মোড়কটা চকচকে হলেও ভেতরে কেবল এক দলা মাটি। ফোনের মালিক আমাকে ধোঁকা দিয়েছে। দামি ফোনের মোড়কের ভেতর মাটি ভরে নতুন ফোন বলে চালিয়ে দিয়েছে।
দুঃখে আমার হাত পা কাঁপছিল। কিছুতেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। চাচা আমার কাঁধে হাত রেখে মৃদু সান্ত্বনা দিয়ে চলে গেলেন। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। দুঃখগুলো কেন যেন আমার বিশ্বাস হতে চায় না। জীবনে এত দুঃখ পেয়েছি তবুও না। অনেক সময় লাগে দুঃখকে মেনে নিতে। ছোটবেলায় বাবা যখন মারা গেলো তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না। চোখের সামনে বাবার লাশ দেখছিলাম তবুও মনে হচ্ছিল আমার বাবা মরেনি। বেঁচে আছে।একদিন বাবা ঠিক ফিরে আসবে। আমি আমার সব কল্পনা, স্বপ্ন, ভাবনা সব কিছুতেই দেখতাম বাবা ফিরে এসেছে। কিন্তু বার বার হতাশ হয়েছি।
পরে যখন মায়ের স্নেহ ভালোবাসায় বাবাকে ভুলে যেতে থাকলাম, মেনে নিলাম বাবা আর কোন দিন আসবেন না, এখন এই মা ই আমার সব ঠিক তখন মা অন্যলোকের বধু নানা বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। আমার বয়স তখন মাত্র দশ বছর। আমি প্রায় রাতে স্বপ্নে দেখতাম মা এসেছে। এই মা কেবল আমারই মা। কোন অচেনা লোকের বধু নয়। আবারো বহুদিন চলল আমার মনকে বোঝানোর চেষ্টা। আমার মায়ের এখন অন্যখানে বিয়ে হয়েছে। সেখানে তার সন্তান হয়েছে। খুব সুখে শান্তিতেই আছে মা। তার আর এখন আমার কথা মনে পড়ে না। আমাকে আর তার প্রয়োজন নেই।
মাঝে মাঝে মা তার নতুন ছেলেকে নিয়ে আসতেন নানাবাড়িতে। আমি তখন দৌড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতাম। আমার স্মৃতিতে কেবল আমার আগের মা ই বেঁচে থাকুক যে আমার বাবার স্ত্রী। প্রতিবার মা যাবার আগে নানার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে কেঁদে কেঁদে বলতেন শোভনকে কিছু কিনে দিও এই টাকা দিয়ে। আমি তো ওকে মায়ের স্নেহ দিতে পারলাম না।
আমি যখন ইন্টারে পড়ি তখন আমার নানা মারা যায়। এক দূরসম্পর্কে মামা আমাকে রওশন চাচার বাড়িতে আমাকে লজিং ঠিক করে দেন। তারা আমাকে থাকতে দিবে ,তিন বেলা খাওয়াবে আর মাসে একশত টাকা করে হাত খরচ দিবে। বিনিময়ে আমি তার দুই ছেলে-মেয়ে হিয়া এবং শাওনকে পড়াবো। হিয়া তখন ছিল ক্লাস এইটে আর শাওন ক্লাস ফোরে। তারপর থেকে পাঁচ বছর আমি ঐ বাড়িতে আছি। হিয়া আর শাওনকে পড়াচ্ছি আর সাথে নিজেরও পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছি। ভার্সিটিতে ভর্তির খরচ রওশন চাচাই আমাকে দিয়েছেন। শর্ত ছিল প্রতিমাসের বেতন থেকে খরচটা কেটে রাখবেন। কিন্তু চাচা আমার ভার্সিটিতে যাতায়াতের খরচের কথা ভেবে আর টাকাটার আমার কাছ থেকে কাটেন নি। আমি তার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। যখন আপন আমাকে ছেড়ে চলে গেছে তখন পর আপন হয়েছে। রওশন চাচার মধ্যবিত্ত পরিবার। তবুও তিনি আমার ভরণপোষণ করেছেন।
আমিও যত্নের সাথে তার দুই সন্তানকে পড়িয়েছি। ব্যস এতটুকুই ছিল পাঁচ বছর ওই বাড়িতে আমার কাজ। তারপর চাচী অবশ্য আমার কাজ কিছুটা কমিয়ে দিয়েছেন। হিয়া বড় হয়েছে বলে আমাকে হিয়াকে পড়াতে বারণ করে দিয়েছেন। জুয়ান মাস্টার দিয়ে আর তার মেয়েকে পড়াতে চান না। হিয়াকেও আমার সামনে আসতে বারণ করে দিয়েছেন। বাড়ির ড্রয়িং রুমে আমার প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। ওখানে বসে হিয়া সহ বাড়ির লোকজন টিভি দেখে। আমি মাথা নিচু করে সাইড দিয়ে শাওনের রুমের চলে আসি।
শাওনের ছোট রুমটায় দু টো খাট পাতা। একটাতে আমি আর একটাতে শাওন ঘুমায়। এই ঘরেই কেটেছে আমার পাঁচটি বছর। কিন্তু এখনো মনে হয় সেদিন যেন এসেছি। সেদিনের হিয়া কবে কৈশোর পেরিয়ে যুবতি হয়ে উঠেছে বুঝতেই পারিনি। তবে কেন যেন মেয়েটাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। আমার সব স্বপ্নে আজকাল ও আসে। দুপুরে খেতে বসলে খনিকের কল্পনায় চোখ মদির হয়ে উঠে। আমি কল্পনায় দেখি হিয়া আমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। এসে বলছে ,”মাছের টুকরোগুলো বিড়াল খেয়ে গেছে। তোমার জন্য লেজটুকুই আছে। তুমি মন খারাপ করো না যেন।” চাচীর কথার আওয়াজে বাস্তবে ফিরে আসি ,”আজ শুধু শুঁটকি মাছ আর ডাল দিয়েই খেতে হবে। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। খাওয়ার পেছনে বিলাসিতা আমাদের মানায় না।” বলে চাচী ভেতরের ঘরের চলে যান। সেখান থেকে হিয়ার কন্ঠ ভেসে আসে,”মা বিরিয়ামী রান্না করেছিলে শোভন ভাইকে দিয়েছো?” চাচী ধমকের স্বরে বলেন ,”আস্তে বলো। বিরিয়ানী শুধু তোমাদের দুই ভাই বোনের জন্য রেঁধেছি। এত জনকে দিয়ে আমাদের পোষায় না।” চাচীর ধমকে হিয়া চুপ করে যায়। আর কথা বাড়ায় না। আমার মন এক অজানা ভালো লাগায় ভরে ওঠে। হিয়া আমাকে নিয়ে কত ভাবে!
হিয়ার সাথে কথা বলার জন্য একটা মোবাইল কিনব বলে টিউশনের টাকাগুলো পাই পাই করে জমিয়েছিলাম এক বছর ধরে। রোজ এক ঘন্টার পথ পায়ে হেটে গিয়েছি এক হাজার টাকা মাসিক বেতনের টিউশনের জন্যে। এক হাজার টাকা বিত্তবানদের কাছে হাতের ময়লা হলেও আমার মত পরের আশ্রয়ে বাঁচা যুবকের কাছে ছিল বিশাল অংক। কত স্বপ্ন বুনেছি এই মোবাইলকে ঘিরে। মোবাইল কিনে প্রথম ফোন দিবো হিয়াকে। নাহ ফোন দেয়াটা ঠিক হবে না। একটা মেসেজ পাঠাবো। কিন্তু কি লিখবো এই মেসেজে? ”হিয়া আমি তোমাকে ভালোবাসি।” না এটা লেখা ঠিক হবে না। কেমন যেন একটা ন্যাকামি ন্যাকামি ভাব আসে এতে। আমার হতদরিদ্রকে ন্যাকামিতে মানায় না। কি লিখবো এই ভেবে ভেবে আমার কেটে গেছে রাতের পর রাত। কিন্তু অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়। ফোনের ভেতর মাটি ঢুকিয়ে নকল ফোন বানিয়ে আমাকে গছিয়ে দিয়েছে!
কি তাজ্জব! এখন ঘুমের ঘোরে আমি স্বপ্নে দেখি ফোন বিক্রেতা ছেলেটা আবার ফিরে এসেছে। সে আমাকে একটা দামী ফোন দিয়েছে। আমি ওটা দিয়ে হিয়াকে ফোন করতে চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুতেই তার নাম্বার মেলাতে পারছি না। আমি ঘুমের ঘোরে হ্যালো হ্যালো বলে হিয়ার নেটওয়ার্ক পেতে চেষ্টা করি। শাওনের ডাকে ঘুম ভাঙে। ইদানিং নাকি আমি ঘুমের ঘোরে আবল তাবল কথা বলি। এতে শাওনের ঘুমে ডিস্টার্ব হয়।
সপ্তাহখানেক পর চাচী আসেন আমার রুমে। পিরিচে গোটা দুয়েক রসগোল্লা। তিনি ওটা আমার দিকে বারিয়ে দিতে দিতে বলেন ,” তোমাকে একটা সুসংবাদ দিতে এসেছি গো বাবা। হিয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, আমেরিকা থাকে। বিয়ের পর মেয়েকে ওখানে নিয়ে যাবে। ওখানে ওদের নিজেদের একটা বিশাল বাংলো আছে। মেয়েটা আমার পাঁচ আঙুলের কপাল নিয়ে জন্মেছে বাবা।” চাচী গাল ভরে হাসছেন।
হিয়ার বিয়ের দিন খুব সকালে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। হিয়াকে কিছুতেই আমি অন্যের বধু বেশে দেখতে চাই না। আমার চোখে সাজানো থাক সেই কৈশোরের হিয়া। শহর থেকে কিছুটা দূরে সবুজ মাঠে শুয়ে পার করে দেই সারাটা বিকেল। মধ্যরাতে হিয়ার বিয়ের পাঠ চুকিয়ে গেলে বাড়ি ফিরে আসি। শাওনের কাছে শুনি হিয়া বিয়ে আগে খুব কেঁদেছিল। শুনে আমার চোখও ভিজে উঠে। হিয়া কি আমার জন্য কেঁদেছিল? দূর বোকা হিয়া আমার জন্য কেন কাঁদবে! এত বছর বাবা মায়ের কাছে বড় হয়েছে তাদের জন্য কেঁদেছে। আমি শাওনের থেকে অশ্রুগুলোকে আড়াল করতে লাইট নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে চোখ মুদি। কল্পনায় ভেসে উঠে হিয়া আমার জন্য কাঁদছে।
৩৯টি মন্তব্য ৩৯টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!
সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন
কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী
ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন