চারিদিকে ঝি ঝি পোকার এক ঘেয়ে ডাক। বাহিরে রাতের শুনশান নীরবতা! গ্রীষ্মের তপ্ত আবহাওয়ার সাথে যেন সুর মেলাচ্ছে গাছের পাতাগুলো। এক ফোঁটা বাতাশও নেই চারিদিকে! ভ্যাপসা গরমের জান হাসফাঁস করতে থাকে সালেহার। তবুও সে ধৈর্য ধরে তাকিয়ে থাকে কম্পিউটারের দিকে! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হয়ে পড়ে শঙ্কিত। মধ্যরাত! এখনো কোন খরিদদ্বার নেই! অথচ কিছু নগদ টাকা তার খুব জরুরী। ছেলে বাইজিদকে কথা দিয়েছে তার সামনের জন্মদিনে তাকে একটা ক্যামেরা কিনে দিবে। বড়ই লক্ষী ছেলে তার। কখনো কোন কিছুর জন্য বাহানা ধরে না। এবার শুধু মুখ ফুটে একটা ক্যামেরার কথা বলেছে! সে মা হয়ে এতটুকু আবদার পূরণ করবে না তাই কি হয়!
ছেলের কথা ভাবতেই মন ভালো হয়ে যায় সালেহার। ছেলে বাইজিদের বয়স এবারের জন্মদিনে চৌদ্দ পেরিয়ে পনেরোতে পড়বে। ঠোটের উপর হালকা পাতলা মোচ উঠেছে। তাই নিয়ে তার লজ্জার সীমা নেই! বয়ঃসন্ধি কালের উদ্ভট মনের ভাবনা আরো বেশি লাজুক করে তুলেছে তাকে। সে এখন ক্লাস নাইনে পড়ে। অথচ এখনো ক্লাসে মেয়েদের মুখের দিকে চেয়ে কখনো কথা বলতে সাহস করে না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে আদায় করে। তাকে দেখে বৃদ্ধ ইমাম সাহেব সালেহাকে বলে,'' পোলা একটা সোনার টুকরা জন্ম দিছো সালেহা। বাপ মোরা পোলা! অথচ কি আদব লেহাজ। দেখা হইলেই সালাম দিবে। কোন বাজে অভ্যাসও নাই। কিন্তু পাড়ার অন্য পোলাগুলারে দেখো! আদব লেহাজ তো নাই ই! সবগুলা রাত হইলে গাঞ্জা, ইয়াবার আসর বসায়! কলিকাল বুঝছো সালেহা ! কলিকাল! কিয়ামত হইবার আর বেশি বাকি নাই! তাই খোদা এই সব দিন দেখাইতেছেন! তোমার পোলারেও দেইখা শুইনা রাইখো কইলাম। খারাপগো লগে মিশতে দিও না।'' জবাবে সালেহা শুধু মৃদু হাসে। ছেলের উপর অনেক বিশ্বাস তার! আর তার এই বিশ্বাস এমনি এমনি গড়ে উঠেনি। ছেলেটা তার বাপের মত হয়েছে। তাই এত বিশ্বাস। কোন অপরাধ তার সয় না! একদিন ক্লাস ফাঁকি দেয়ার অজুহাতে ক্লাসের স্যারকে মিথ্যে বলেছিল তার ডেঙ্গু হয়েছে। পরদিন সত্যি সত্যিই তার ডেঙ্গু হয়ে নাক মুখ দিয়ে অনর্গল রক্ত। সালেহা তড়িঘড়ি করে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। টানা এক সপ্তাহ ভোগার পর সুস্থ হয় বাইজিদ। সেই থেকে বাইজিদ কখনো মিথ্যে বলে না। উঠতি বয়সী ছেলেপেলের মত কোন অহেতুক দুষ্টুমিতে নিজেকে জোড়ায় না। পাড়ায় ভালো ছেলে হিসেবে অনেক সুনাম আছে তার।
তার বাবা সোবাহান সাহেবও অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। তারও কোন অপরাধ সইত না। সৎ কর্মচারী হিসেবে অফিসে অনেক খ্যাতি ছিল। তার সমপর্যায়ের অফিসাররা ঘুস খেয়ে গাড়ি বাড়ি করে ফেললেও সে কোনদিন অসৎ উপায়ে টাকা কামায়নি। সে গর্ব করে সালেহাকে বলতো ,''জানো সালেহা আমাগো বংশ হইল পীরের বংশ। এই জন্য আমাগো কোন খারাপ কাজ সয় না। একটা মিথ্যাও কইতে পারি। সাথে সাথে আল্লাহ পাক শাস্তি দিয়া দেন। এমন ভাগ্য সবার হয় এমন হয় না। বুঝছো? এইটা সৌভাগ্যের লক্ষণ। দেখবা তোমার পোলাও বড় হইয়া অনেক সৎ হইব! অনেক নাম কামাইবো। এই আমি বইলা রাখলাম!''
তিনি ছেলের নাম বিশিষ্ট পীর বাইজিদ বোস্তামির নাম অনুযায়ী রেখেছেন বাইজিদ। তারপর খুশি মনে সালেহাকে বলেছেন,'' দেইখো সালেহা এই পোলাও একদিন বাইজিদবোস্তামীর মত তোমার জন্য পানির গ্লাস হাতে লইয়া দাঁড়ায় থাকবো। তোমারে অনেক সম্মান করব সালেহা। শুধু একটা অনুরোধ ওরে কোন দিন হারাম খাওয়াইয়ো না। হারাম খাইলে মানুষ আস্তে আস্তে অসৎ হইয়া যায়!''
স্বামীর এই কথাগুলোও আজো কানে বাজে সালেহার। অথচ সে স্বামী হারা হয়েছে আজ প্রায় এগারো বছর হল। কিন্তু মনে হয় এই সেই দিনের ঘটনা। বাড়ি আলা বাসা ভাড়ার জন্য খুব চাপ দিচ্ছিলো। চার মাসের ভাড়া জমা পড়েছে। মাস তিনেক আগে সোবাহান সাহেবের ছোট ভাই মোকলেস বিপদে পড়ে তাদের বাসায় উঠেছে। সোবাহান সাহেব বেতনের সব টাকাই কয়েক মাস ধরে তার হাতে তুলে দিয়েছেন। তাই এ মাসে এত টানাটানি! এদিকে বাড়ি আলাও কোন কিছু শুনতে নারাজ! সে রাগারাগি করে বলেছে আর দুইদিনের মধ্যে বাড়ি ভাড়া না দিলে তার বাড়ির আসবাব পত্র বিক্রি করে ভাড়া আদায় করবে। সোবাহান সাহেব পড়ে গেলেন মহাফাপ্পরে! তিনি এই প্রথম কোন এক ব্যক্তির কাছ থেকে ঘুস খেলেন! ঘুস তো তার অফিসের সবাই খায়। সে একদিন খেলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? পরে না হয় টাকা হলে এই ঘুসের টাকার সমপরিমাণ সদকা দিয়ে দেবে। তাহলেই হল! কিন্তু এবারও অপরাধ তার সইল না। পরের দিন রোড এক্সিডেন্টে মারা যায় সোবাহান সাহেব!
বাইজিদের বয়স তখন চার বছর। সালেহা তাকে নিয়ে পড়ে যায় মহামুসিবতে। যেই ছোটভাইয়ের বিপদে সাহায্য করতে গিয়ে আজ তাদের এই দশা সেও তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। দুইমাস কোন রকম তাদের পরিবার চালানোর টাকা দিয়ে পরে মাসে পাঠায় একটি চিঠি
,''প্রিয় ভাবী,
সালাম নিও। আশা করি ভালো আছো। এই কথাগুলো তোমাকে ফোনে বলার সাহস হত না। তাই চিঠি লিখছি। আমাকে ভুল বুঝো না। পরসমাচার এই যে আমার ব্যবসা এখন খুব খারাপ যাচ্ছে। নিজেরই পেট চলে না তোমাদের আর কি দিব বলো? তাই আমার একটা পরামর্শ। আমার এলাকায় একটা ভালো এতিমখানা হয়েছে। এখানে বিদেশ থেকে সাহায্য দেয়। শুনেছি অনেক ভালো ভালো খাবারও দেয়। ফলমূল, মাছ ,মাংশ সবই দেয়। তুমি বাইজিদকে এখানে দিয়ে দাও। আর আমার হাতে একটা ভালো বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। পাত্রের স্ত্রী মারা গেছে। বয়স যদিও একটু বেশি। কিন্তু আশা করি তুমি মানিয়ে নিতে পারবে। তুমিও তো যুবতি! কতদিন একা একা থাকবে?
ভুল কিছু বললে ক্ষমা করে দিও। ইতি মোকলেস।''
ঘৃণায় মুখ বাঁকায় সালেহা। তার চার বছরের সন্তানকে সে এতিম খানায় দিবে! বাইজিদের বাবা নেই তো কি হয়েছে! মা তো আছে! সেই চাকরী করে খাওয়াবে তার সন্তানকে। তবুও নিজের সুখের জন্য এতটুকু শিশুকে সে মা ছাড়া করবে না। তার ইচ্ছে হয় ফোন করে মোকলেসকে দুটো কথা শুনিয়ে দেয়। কিন্তু দরজার ঠকঠকানীতে চিন্তায় বাঁধা পড়ে! কে এল এমন সময়ে? সূর্য সবে ডুবে গিয়ে হালকা অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছে পৃথিবী। এই সামান্য আঁধারকেই আজকাল অসহ্য মনে হয়। চার বছরের বাইজিদকে নিয়ে এখন এই ফ্ল্যাটে একা থাকে সালেহা। আশে পাশের দুষ্টু হায়েনার দল সন্ধ্যা হলেই জানালা দিলে ঘরের ভিতর ঢিল ছুঁড়ে দেয়! সালেহা বাইজিদকে কোলে নিয়ে চুপ করে ঘরের ভিতর আলো নিভিয়ে বসে থাকে। বড় নিষ্ঠুর মনে হয় এই আঁধার! নিষিদ্ধ আঁধার!
কিন্তু আজ দরজায় কে? সালেহা ভিতর থেকে আওয়াজ দেয় ,''কে দরজা থাপড়ায়? কে ?'' ওপাশ থেকে বাড়ি আলার আওয়াজ ,''মা সালেহা আমি!'' সোবাহান সাহেবের মৃত্যুর পর সেই নিষ্ঠুর বাড়ি আলাই তাদের অনেক সাহায্য করে। এমন কি মাঝে মাঝে বাইজিদকে কোলে নিয়ে বাজারে গিয়ে চকলেট আইসক্রিমও কিনে দিয়েছে। সালেহাকে বলেছে ''মা কিছু লাগলে আমাকে বলো। আমি এনে দেবো। এতিমের সাহায্য করলে আল্লাহও খুশি হন!''
এভাবেই হয়ত অনেক সময় পরই হয় আপন আর আপন হয় পর। বাড়িআলা আর মোকলেসকে তুলনা করে ভাবে সালেহা। সে বাড়ি আলাকে এনে ড্রয়িং রুমে বসায়। কিন্তু বাড়িআলা আজ কেমন যেন উস্কখুস্কো করছে! সালহা শঙ্কিত হয়ে বলে ,''চাচাজি আপনার শরীর খারাপ?'' বাড়িআলার চোখে চোখ পড়তেই সালেহা দেখে বুনো দৃষ্টি! যেন চোখ দিয়েই গিলে খেতে চাচ্ছে তার সর্বাঙ্গ। সালেহা সতর্ক হবার আগেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়েনার মত!
কিছুক্ষণ পর ফ্লোরে পরে থাকে সালেহার রক্তাক্ত নিথর দেহ। বাড়ি আলা সালেহার দিকে এক দলা থুতু নিক্ষেপ করে বলে ,''হারামজাদী এই ঘটনা যদি কেউ জানতে পারে তাহলে তোকে জানে মেরে ফেলব!'' তারপর পকেট থেকে কিছু টাকা সালেহার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। আজ বাড়িতে তার স্ত্রী, সন্তানেরা কেউ নেই। সেই সুযোগেরই সদব্যবহার করেছে সে!
এদিকে সালেহার গননবিদারী কান্না ইটের শক্ত থাম বিদীর্ণ করে পৌঁছায় না কোন মানুষের কানে! বাইজিদ শুধু ভয়ে রুমের এক পাশে বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিল। সালেহার শরীর নিস্তেজ! এতটুকু শক্তি অবশিষ্ট নেই ছেলের কাছে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিবে। স্বামী হারানোর বেদনার, সম্ভ্রম হারানোর বেদনা সব যেন এক সাথে জাপ্টে ধরে তাকে নির্জীব করে দিয়েছে! সারা রাত মরার মত ফ্লোরে পড়ে রয় সালেহা। সংজ্ঞাহীন হয়েছিল কিনা ঠিক বুঝতে পারে না।
সকালে বাইজিদের ডাকে চোখ মেলে তাকায় সে। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ভয়, জ্বর সব মিলিয়ে আধমরা হয়ে আছে ছেলেটা! সালেহা রান্না ঘর থেকে বাসী ভাত ,তরকারী থেকে এনে কিছুটা খাওয়াতেই অনর্গল বমি! ছেলের অসুস্থতায় দিশাহীন হয়ে পড়ে সে! কার কাছে যাবে? কে সাহায্য করবে? এতিম মেয়ে সালেহা। জন্মের সময় মাকে হারিয়েছে। পরে সৎ মায়ের সংসারে বড় হয়েছে। কিছুদিন পর বাবাও মারা গেছেন। তারপর সৎ মায়ের লাথি জুতো সহ্য করে ঐ পরিবারেই মাটি কামড়ে পড়েছিল। সৎ মা তাকে তাড়াতাড়ি সোবাহান সাহেবের সাথে বিয়ে দিয়ে আপদবিদায় করেছেন। এখন আর ঐ বাড়িতে ফিরে যাবার কোন মুখ নেই। জগতসংসারে এত জায়গায় থাকলেও সালেহার জন্য এত স্থান যেন কোথাও নেই!
এদিকে বাইজিদের জ্বর বাড়ছে! তাকে ডাক্তার দেখাতে হবে। ফার্মেসী থেকে নাপা সিরাপ এনে খাওয়ায় সালেহা। কিন্তু জ্বর কমার কোন নাম গন্ধ নেই! বেলা গড়ানোর সাথে সাথে জ্বরও যেন বাড়ে। আস্তে আস্তে শ্বাস কষ্ট শুরু হয় ছেলেটার। এদিকে সালেহার হাতে টাকা কড়ি কিছুই নেই! কি দিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে সে? সোফার কোণায় চোখ পড়ে তার। বাড়ি আলার ছুঁড়ে দেয়া টাকা! সালেহা তাই নিয়ে বাইজিদকে ডাক্তারদের দেখায়। নিউমোনিয়া হয়েছে ছেলেটার। হাসপাতালে কয়েকদিন ভর্তি রাখতে হবে! সালেহা সব টাকা খরচা করে ছেলের চিকিৎসা করায়। তিন দিন পর অবস্থা একটু ভালো হলে বাড়ি নিয়ে আসে। আর কিনে নিয়ে আসে কিছু পাউরুটি আর কলা। নিজেকে কেমন যেন পতিতা পতিতা মনে হয় তার! ঘিন ঘিন লাগে সব কিছু! যেই লোক তার সাথে এত নিষ্ঠুর আচরণ করেছে, তার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তার সম্ভ্রম কেঁড়ে নিয়েছে তার টাকায় সে রুটি খাচ্ছে! পেট গুলিয়ে আসে তার! কিন্তু নিয়তির কাছে সে অসহায়!
পরদিন বাড়ি আলার স্ত্রী এসে তাকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিয়ে যায়। সালেহার যেন পড়ে যায় মহাসমুদ্রে! এতটুকু আশ্রয়ের জন্য হয়ে পড়ে মরিয়া! শিক্ষাগত যোগ্যতাও তেমন নেই যে চাকরী করে ছেলেকে খাওয়াবে। আর এত ছোট বাচ্চাকে একা ঘরে ফেলে কোথায়ইবা চাকরী করবে সে! আপাতত সে বস্তিতে একটা ছোট টিনের ঘরে কোন রকমে মুখ গুজে! কিন্তু এখানেও বিপদ তাকে ছেড়ে যায় না! এক রাতে প্রাকৃতিক ডাকে সারা দিতে গেলে পাশের পাড়ার মাস্তানেরা তাকে ধরে একের পর এক ভোগ করে! অসহায় সালেহার সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসে না। কোটি কোটি মানুষের পৃথিবীতে সে একাই যেন একদম একা!
সারা রাত পিশাচের মুখের খাদ্য হয়ে সকালে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত সালেহা প্রাণশক্তিহীন হয়ে ঘরের ফ্লোরে পড়ে রয়। ছোট্ট বাইজিদ মায়ের জন্য এক হাতে পানি অন্য হাতে হাত পাখা নিয়ে বসে থাকে। জ্ঞান ফিরতেই সালেহা দেখে তার নিষ্পাপ মুখ! তার সোবাহান সাহেবের কথা মনে পড়ে। ''দেইখো সালেহা এই পোলাও একদিন বাইজিদবোস্তামীর মত পানির গ্লাস হাতে লইয়া তোমার জন্য দাঁড়ায় থাকবো।'' ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কষ্ট উপশমের চেষ্টা চালায় সে। কিন্তু দুঃখরা যেন থেকে থেকে ছলকে উঠে! কিছুতেই যেন কমে না! থেকে থেকে উছলে উঠে আত্মহননের চিন্তা!
পরদিন বস্তির পেয়ারা বেগম নামে এক মহিলা এসে পরিচিত হয় সালেহার সাথে। ''বুঝছো সালেহা এই জগতে বাঁচতে অইলে অনেক কঠিন হইতে হয়! এত নরম হইলে জগত আরো শুইষে খায়!'' সালেহা ভাষাহীন চোখে তার দিকে চেয়ে থাকে! পেয়ারা বেগম বলে যায় তার দুঃখের কথা! জগতের লাথি জুতো খেয়ে সে কিভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে সেই কথা! সে সালেহাকে চাকরী দেবার নাম করে নিয়ে যায় দূরের শহরে! সন্ধ্যা হলে সালেহা বুঝতে পারে পেয়ারা বেগম তাকে বিক্রি করে দিয়েছে পতিতা পল্লীতে! তারপর কয়েক রাত ঐ পল্লীর মাস্তানেরা তাকে অন্য যুবকদের সাথে রাত্রি ভাগাভাগিতে বাধ্য করে! অসহায় সালেহা শুধু ছেলের মুখে দুটো খাবার তুলে দেবার আশায় মুখ বুজে থাকে। তারপর একদিন পালায় পতিতা পল্লী থেকে! কিন্তু দুর্ভাগ্য তার পিছু ছাড়ে না! পতিতা পল্লীর মাস্তানেরা তাকে অনুসরণ করে খুজে বের করে নিয়মিত তাকে হুমকি ধামকি দিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় পাঠায় দেহপসারিনীর কাজে। সালেহার কাছে আস্তে আস্তে ব্যাপারগুলো স্বাভাবিক হয়ে আসে। এখন আর আগের মত বিবেক গর্জন করে উঠে না। আর তার কাজ রাতের আঁধারে। তাই সমাজের কেউ জানতে পারে না তার আসল কাজ কি! সাধারণ সেলাইয়ের ব্যবসার আড়ালে তারা নীরবে চালিয়ে যায় তাদের দেহ ব্যবসা।
আস্তে আস্তে বাইজিদ বড় হতে থাকে। সালেহা তাকে ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়। এখন আর তাদের আর্থিক অনটন নেই। ছেলেকে নিয়ে ভালোই আছে সে। কিন্তু সন্তান বড় হওয়ার সাথে সাথে সালেহার চিন্তা বাড়তে থাকে! যদি কোন দিন তার সন্তান জেনে যায় তার কথা? তখন কি হবে? সালেহা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকদের বিনোদন দেবার বিকল্প পদ্ধতি খুঁজতে থাকে। অবশেষে আর বাড়িতে না গিয়ে কখনো ফোন, কখনো ইন্টারনেটের মাধ্যমে পেশাকে চালিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নেয় সে।
কিছুদিন পর পর তারা এলাকা পাল্টায়। একেক সময় একেক জায়গায়। এভাবে তার অন্ধকারের জগত থেকে বাইজিদকে রাখে সম্পূর্ণ আলাদা। বাইজিদ জানে তার মা খুব ত্যাগী একজন মহিলা। তার বাবার মৃত্যুর পর সে কষ্ট করে চাকরী করে তার মুখে খাবার তুলে দিয়েছে! তাই মায়ের জন্য ভক্তির শেষ নেই। অন্যদিকে সালেহাও সন্তানের সামনে একজন আদর্শ মহিলা। সত্বি সাধ্যি মহিলার সব গুণ সামনে রেখে সে তার সন্তানকে আগলে রেখেছে জগতের সব কালো থেকে। সব নিষিদ্ধ অন্ধকার থেকে! ছেলে তার ভালো হোক। ঠিক তার বাবার মত। আর বাইজিদ হয়েছেও তাই। সালেহার স্বপ্নগুলো যেন সব সত্যি হয়ে আসে! এই ছেলের মুখ দেখেই তো সে বেঁচে আছে। স্কুলে অনেক সুনাম বাইজিদের। বন্ধুমোহলেও জনপ্রিয়। অভিভাবকরা চান তাদের সন্তান বাইজিদের মত হোক। তার সাথে মিশুক। তাহলে তাকে অনুসরণ করে তার মত ভালো হবে।
সালেহা অতিরিক্ত সুরক্ষার জন্য সারাদিন ঘরের মধ্যেই থাকে। রাতে শুধু কখনো ফোনে ,কখনো ল্যাপটপে তার ব্যবসা চালিয়ে নেয়। এছাড়া একটা বড় সড় দোকানও দিয়েছে। ওটা কর্মচারী দিয়ে চালায়। এটি জগতের চোখে কালো চশমা পড়িয়ে তার নিজেকে আড়াল করার জন্য। তার সন্তান জানে এটাই এখন তাদের পেশা। সালেহাও ভাবে এই জঘন্য কাজ সে ছেড়ে দিবে। অন্তত সন্তানের জন্য। অনেকখানি টাকাও ইতোমধ্যে জমিয়েছে সে। আরো কিছু জমিয়ে নিয়ে ছেলেকে নিয়ে দেশ ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবে। তার ছেলে কোনদিন জানতে পারবে না তার অতীতের কথা! এখন শুধু আর কিছু বাড়তি টাকা দরকার ছেলের জন্মদিনে তাকে একটা ক্যামেরা উপহার দেবার জন্য। জমানো টাকায় হাত দিতে চায় না সালেহা। ওটা থাক যখন তখন লাগতে পারে!
এক সপ্তাহ পর বাইজিদের স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি হয়। তাই বাইজিদের বন্ধুরা বায়না ধরেছে আজ রাতে তাকে তাদের সাথে থাকতে দিতে হবে। তার বন্ধুরা অনুমতির জন্য সকাল থেকে এসে চাপাচাপি শুরু করেছে সালেহাকে! তাদের একজনের বাবা মা কেউ বাড়িতে নেই। তাই আজ রাতে তারা সারা রাত বাড়িতে কেরামবোট খেলবে। সালেহাও বাধ্য হয়ে বাইজিদকে অনুমতি দেয়। একটাই তো রাতের ব্যাপার। আর ছেলেরা যেভাবে ধরেছে! আর বাইজিদও কখনো অন্যদের মত নেশাযুক্ত কিছু খাবে না এতটুকু আস্থা তার আছে।
আজ রাতে সালেহা বাড়িতে একা। আজ আর তার রুমে এসে দরজা বন্ধ করে তার নিষিদ্ধ কাজ চালাবার কোন প্রয়োজন নেই। আজ সাবধান হবার মত কেউ নেই। নিশ্চিন্তে তার শোবার ঘরে আসে সালেহা। আজ রাত বারোটায় একটা পার্টির সাথে তার কন্ট্রাক্ট হয়েছে। তারা ব্যাংকে অগ্রিম টাকাও পাঠিয়ে দিয়েছে। আজ রাতে ইন্টারনেটের তাদের সাথে কুৎসিত কথা বলতে হবে তার আর নোংরা উপায়ে দেহ প্রদর্শন করতে হবে। এটাই তার কাজ। এই কাজে এখন সে ভালোই অভ্যস্থ! বেশ ভালোভাবেই অঙ্গভঙ্গি করে বিকৃত সুখ দিতে পারে ক্যামেরার ওপাশের ক্ষুধার মানুষগুলোকে!
ঠিক বারোটায় সালেহার কাজ শুরু হয়। এবারের খরিদদ্বাররা যেন একটু বেশই ক্ষুধার্ত! সালেহা কিছুক্ষণ কথা বলে বুঝতে পারে। সেও লেগে যায় প্রাণপণে ওদের সুখ দিতে। মধ্যনিশির মায়াবী জাদুতে সবার চোখে লাগে ঘোর। ঘোর লাগা চোখে তারা কখন সবাই ক্যামারার সামনে দৃশ্যমান হয়েছে কারোরই খেয়াল নেই! কিন্তু যখন খেয়াল হল তখন সালেহার অনেক দেরি হয়ে গেছে! ক্যামেরা ওপাশে বসে তার ছেলে ও তার বন্ধুরা!
রাতের আঁধারকে আরো বীভৎস কালো মনে হয় সালেহার! সে কম্পিউটার বন্ধ করে দিশাহীন হয়ে খুঁজতে থাকে লুকোবার জায়গা! কিন্তু এত কুৎসিত আঁধারেরও তার লুকোবার কোন জায়গা নেই! তার জীবনে আজ এতই আঁধার যে রাতের আঁধারও তাকে ঢেকে দিতে পারছে না! কি করে সে এই মুখ লুকোবে ছেলের থেকে? গলা কাটা পশুর মত তরপাতে তরপাতে সে শাড়ি ফ্যানের সাথে পেঁচিয়ে ঝুলে পড়ে! এটিই তার লুকোবার একমাত্র পথ! মৃত্যু! এই রাতের নিষিদ্ধ আঁধারে এভাবেই মিশে যেতে হবে তাকে!
এদিকে বাইজিদেরও বুক ভেঙে আসে। বাবা হারানোর সময় সে খুব ছোট ছিল। তাই সে সব দুঃখ তার মনে আসে না। তবে তার বাবার কথাই তার জীবনে আবার সত্যি হল! বন্ধুদের চাপাচাপিতে বাধ্য হয়ে করা এই পাপও তার সইল না! অনেক বড় শাস্তি হয়ে দাঁড়ালো! একাকী রাতের বেলা অন্ধকার গলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবে বাইজিদ! সে এই ঘটনার পর বন্ধুদের বাড়ি থেকে সোজা দৌড়ে বেরিয়ে এসেছে। এখন রাজপথ ধরে হেঁটে চলছে। মায়ের উপর কোন ভুল বোঝাবুঝি নেই তার। শুধু মায়ের উপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের লীলিহান শিখার উত্তাপ কল্পনা করতেই কলিজা ফেটে আসছে তার! সবই তার জন্য! তার জন্যই তার মাকে এত নিচে নামতে হয়েছে! সে তার মায়ের জন্য অভিশাপ! রাতে ব্রীজের উপর থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে তার এই অভিশপ্ত জীবনের অবশান ঘটায় সে!