তখনও উইন্ডোজ ৯৫ বের হয় নি। একটা বই দেখে দেখে কম্পিউটারে কমান্ড দেই। হঠাৎ মনে হল বাসার জন্যে একটা পি সি কেনা দরকার। একটা কম্পিউটারের দাম তখন আকাশ ছোঁয়া। সদ্য খোলা বাইং হাউজের বায়ার ধরতে ইউরোপ সফর করে তখন আমি কপর্দক শূণ্য। কিন্তু ব্যাপারটাকে আর মাথা থেকে বের করতে পারছিলাম না। ব্যাবসার জন্যে কম্পিউটার তখনও জরুরী কিছুই নয়। ফ্যাক্সেই সব কিছু সারা হয়। কিন্তু আমার দুই সন্তানের জন্যে একটা পিসি জরুরীভাবে দরকার এই ধারনাটাই আমাকে বারে বারে অশান্ত করছিল। কিভাবে বাসায় সেই কম্পিউটারটা এসেছিল সেটা আরেকটা রামায়ন তবে ঐ প্রাণপাত যে সার্থক হয়েছিল তা আজ বুঝি।
কিন্তু আজ এই পিসির মাধ্যমে আমরা কি শেখাচ্ছি আমাদের সন্তানদের? আমার ফেইসবুকের হোম পেইজ যখন খোলা থাকে তখন এক নজর পেইজের দিকে তাকালেই আমি চলে যাই আমার অতি পিচ্চিকালে। তখনো গভঃ ল্যাবে ভর্তি হইনি, বয়স খুব বেশী হলে চার হবে। বুয়েটের তেপান্তরের খেলার মাঠের দুরতম প্রান্তে ছিল রেল লাইনের বস্তি। আমি রোজ বিকেলে খেলতে খেলতে চলে যেতাম সেখানে। ওদের অপরিচিত, বিজাতীয় ভাষার প্রতি আমার নেশা ধরে গিয়েছিল।
একদিন আমাদের বাসায় আসলেন কিংবদন্তীতুল্য ডঃ রশীদ, বুয়েটের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য্য।
আমি তাকে রেল লাইনের ভাষায় স্বাগতম জানালাম।
বাবা মা স্তম্ভিত আরেকটু হলেই বাবা আমাকে তুলে আছাড় দিতেন যদি না ডঃ রশিদ ছোঁ মেরে আমাকে কোলে তুলে নিতেন।
তিনি তারপর অনেকক্ষণ ধরে বাবা মাকে বোঝালেন যে সেদিনের ঘটনায় আমার কেন কোন দোষ নেই।
আজ থেকে বছর পাঁচেক আগেও এই ভাষার এমন যথেচ্ছ ব্যাবহার আমি দেখিনি। আমার এক ছোট ভায়ের মেয়ে আজ থেকে বছর চারেক পর যখন তার ফেইসবুক হোম পেইজে পড়বে তার বাবা লিখেছে “___ন্দাইবার টাইম নাই”, তখন সে তার বাবা সম্পর্কে কি ভাববে? একই কথা যখন আমার প্রান প্রিয় কন্যা পড়ে সে কি একবারও ভাবে না, এই লোকটাকে আমার বাবা কি ভাবে এত শ্রদ্ধা করতে পারে?
এই বছর তিনেক আগেও মেয়েরা এই অকথ্য অশ্রাব্য ভাষা তেমন একটা ব্যাবহার করতো না। আজ যে মেয়ে এই ভাষায় অন্তর্জালে লেখে না সে ক্ষ্যাতাসার-ক্ষ্যাতাগাঁও।
আমার জেষ্ঠ পুত্র কড়াইল বস্তিতে পড়াতো, ঢাকার দুস্থঃতম শিশুদের। তার কারিকুলামে ব্যাক্তিগত সাস্থ্য, নেশাদ্রব্য থেকে দুরে থাকা ছাড়াও ভাষা পরিশীলিত করা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সে দু’ বছরে প্রচন্ড অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে শিশুদের একটা দল গড়ে তুলেছে যারা গালিবাজ নয়। এমন কি তারা তাদের বাবা মাদেরকেও সচেতন করতে পেরেছে ভাষার ব্যাবহার ও প্রয়োগের ব্যাপারে। আমার এই ছেলে যখন ফেইসবুকটি খোলে, তার মনের ও স্পৃহার কি অবস্থা হয়? তার প্রনোদন কোথায় পালায়? আজ কেন এই অকথ্য অশ্রাব্য ভাষা COOL?
এই ভাষা যারা ফেইসবুকে, ব্লগে যথেচ্ছ ব্যাবহার করে তারা কি এই ভাষায় বাসার খাবার টেবিলে আলাপ করে?
ডেইটিংএে বান্ধবীর/বন্ধুর সাথে?
শিক্ষালয়ে?
সামাজিক অনুষ্ঠানে?
এমন কি বন্ধুদের আড্ডায় এই ভাষায় তারা কি ভাবের আদান প্রদান করে?
যদি না করে থাকে তা হলে ফেইসবুক আর ব্লগে কেন? পনের থেকে পঁচিশের এই মানব সন্তানদের দোষ কতটুকু?
আমার তো মনে হয় তাদের খুব বেশী দোষ দেয়া অবিচার করা হবে। মানসিকভাবে বিকৃত কিছু লোক, কিছু ফেইসবুক সেলিব্রেটি্ গত পাঁচ সাত বছরে এই জঘন্য ভাষাকে অন্তর্জালে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এর থেকে কি আমাদের পরিত্রাণ নেই? অবশ্যই আছে।
শক্তিশালী মহলের ছত্র ছায়ায়, সরকারি সমর্থনপুষ্ট পরিমল জয়ধরকে এই ব্লগ ও ফেইসবুকের মাধ্যমেই আমরা কারাগারে ঢুকিয়েছি। বাংলাদেশের সকল মিডিয়া ছিল তখন নিঃশ্চুপ।
এইতো একবছরও হয়নি, মাত্র ৭২ ঘন্টার প্রচারনায় অন্তর্জালের গতি কমানোর সরকারের হটকারী সিদ্ধান্তকে আমরা ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছি।
আমি মনে করি এখনই সময় আমরা এই জঘন্য, অশ্রাব্য অশ্লীল ভাষার ব্যাবহার বন্ধ করতে সক্রিয় হবার। আমরা যদি এই জঘন্য ভাষার ব্যাবহারকারীদের বর্জন করি, তাহলে অতি সহজেই এই পূঁতিগন্ধময় হয়ে যাওয়া ফেইসবুককে সহনীয় করে আনতে পারবো। আজ না হয় আমার সন্তানেরা প্রত্যক্ষ ভাবে ভুক্তভোগী, কাল পরবর্তী প্রজন্মের কাচ্চাবাচ্চারা এই পঁচন ধরা ক্ষতের কবলে পড়বে।
কেউ রক্ষা পাবেনা। .
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১০:৫৯