(১)
আমার অনেক রাগ । অনেক মানে অনেক বেশি, অন্ধ রাগ, পাষণ্ড রাগ। অনেকে রাগলে কি করে কোন ঠিক থাকেনা, কিন্তু আমি যখন রেগে যাই, তখন নির্দিষ্ট ধারাবাহিকতায় কিছু কাজ করি। রাগ যখন উঠতে থাকে, তখন প্রথমে আমার চোখ মুখ লাল হয়ে আসে। কান দিয়ে গনগনে ধোঁয়া বেরুতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণের জন্য খানিকটা হতভম্ব হয়ে যাই, কথা বলতে পারিনা, তারপর রাগ যখন চড়ে যায়, সামনে যাকে পাই তার ওপর রাগ ঝারি, কুৎসিত ভাষায় গালাগালি করি, জিনিস ভাংচুর করি, অনেকক্ষণ রাগ দেখানোর পর যখন ক্লান্ত হয়ে যাই, হাতের কাছে আর কিছু থাকেনা ভাঙার বা ছুঁড়ে ফেলার মত, সামনে আর কেউ থাকেনা অভিযোগ, অপমান বা গালি দেয়ার মত, তখন কাঁদি... যেনতেন কান্না না, বুক ভাঙা আর্তনাদ করতে থাকি, পশুর মত গোঙ্গানোর আওয়াজ হয়, মা মা বলে চিৎকার করি, তারপর... যখন ক্লান্ত লাগে, আর পারিনা কিছু করতে...তখন আমার রাগ ধীরে ধীরে কমে আসে।
আমাদের পরিবারের রাগের ইতিহাস ভালই পুরনো। আমার বাবা আর মা দুজনেই রাগের জন্য সমান বিখ্যাত (নাকি কুখ্যাত?)...তবে বাবার রাগ একরকম, মায়ের রাগ অন্যরকম, বাবা বদমেজাজি, কথায় কথায় রেগে যায়, রাগলে বেশ কিছু ধমকা-ধমকি করে, তারপর ঝট করে রাগ কমে যায়, আবার হাসিখুশি। ওদিকে মা এত সহজে রাগেনা, তার মাথা সব সময় ঠাণ্ডা , কিন্তু একবার কোন জিনিস নিয়ে রাগলে আর ছাড়াছাড়ি নেই, কখনও উত্তেজিত হয়না, চেঁচামেচির তো প্রশ্নই আসেনা, কিন্তু মনের মধ্যে চিরকাল সেই রাগ পুষে রাখে, কোনভাবেই কাউকে মাফ করেনা। আমি বাবা-মায়ের যোগ্য সন্তান, দুই রকম রাগই আমার রক্তে বইছে।
ছোটবেলায় আমি ছিলাম নাদুসনুদুস, বোকাসোকা একটা বাচ্চা মেয়ে, সারাদিন নিজের মনে খেলতাম, কোথাও গেলে মাকে ছেড়ে একটুও নড়তাম না, শিশুরা চঞ্চল প্রকৃতির, এই কথা ভুল প্রমাণ করার জন্য আমি একাই ছিলাম যথেষ্ট। স্কুলে ভর্তি হবার পর আমার কোন বন্ধু হলনা, সারাদিন একা একা থাকি, নিজের মনে পড়াশুনা করি, একা একাই টিফিন খাই, পড়তে শিখেই বই পড়ার তীব্র নেশায় ধরেছিল। ক্লাস টু'তে উঠেই চশমা নিতে হল, তবুও নিজের মত করে ভালই ছিলাম, কিন্তু যত বড় হতে লাগলাম পৃথিবীটা আর এত সুন্দর থাকলনা, স্কুলে অন্যান্য বাচ্চারা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে, আমি অসুস্থ হয়ে স্কুলে যেতে না পারলে পড়া বলে দেয়ার কেউ থাকেনা, ক্লাস টিচার আমার বাবা-মাকে ডেকে পাঠাল, বলল আমার মধ্যে অ্যান্টি সোশ্যালের লক্ষণ স্পষ্ট। আমাকে মানুষের সাথে মিশতে শিখাতে হবে। কেউ এই সহজ কথাটা বুঝলনা যে আমার কাউকে দরকার নেই, আমি একা একা অনেক ভাল আছি, আর এভাবেই থাকতে চাই, মা আমাকে জোর করে অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলতে পাঠাত, আমাকে নাচ আর গানের ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দিল, বই পড়ার ওপর কারফিউ জারি করল, তখন থেকেই আমার রাগের সূত্রপাত, সারা দুনিয়ার ওপর আমি রেগে ছিলাম, এই সমাজ নিজেদের মত করে নিয়ম বানায়, যারা সেই নিয়ম মানতে চায়না, তাদের অ্যান্টি সোশ্যাল নাম দিয়ে দূরে ঠেলে দেয়।
যাইহোক মায়ের শত চেষ্টাতেও কাজ হলনা, আমি কোন বন্ধু ম্যানেজ করতে পারলাম না, মেয়েদের জন্য খেলাধুলার এত সুযোগই বা কোথায়...নাচ আর গানের ক্লাসেও একি অবস্থা, তবে বই পড়া চলতে লাগলো। রেজাল্টটা চলনসই হত বলে মা-বাবাও আর কিছু বলতনা। ততদিনে আমার চরিত্রের আরেকটা দিক বের হয়ে এসেছে, আমি রাগ করা শিখে গেছি...পান থেকে চুন খসলেই লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে দিতাম, আমার প্রতিটা জিনিস আমি আমার মত করে চাইতাম, এর কোন ওলটপালট হলে আমাকে সামলানো মুশকিল হয়ে যেত। মা ভয়ে আমাকে চটাত না। যা বলতাম তাই শুনত। আর আমার চাহিদাও তো বেশি ছিলনা, শুধু নিজের মত করে থাকতেই তো চাইতাম, এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোন অন্যায় নেই?
বুয়েটে ভর্তি কোচিং করার সময় আসিফের সাথে পরিচয়। ছেলেটা একেবারে আঠার মত পিছনে লেগে থাকত, রাস্তায় আসার সময় আমার সাথে সাথে হেঁটে আসতো, আমি কথা বলা পছন্দ করিনা বলে সেও চুপ করে থাকত। তবু তার আমার সাথে থাকা চাই। আমাকে ফোন করলে ফোন ধরে কথা বলতাম না, আসিফও চুপ করে থাকত, দেখা যেত কয়েক ঘণ্টা আমরা কথা বলেছি, অথচ কিছুই বলা হয়নি...প্রথম প্রথম বিরক্ত হলেও আমার জীবনে আসিফের উপস্থিতি একসময় মেনে নিলাম। এই প্রথম আমি নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালবাসতে শিখলাম।
(২)
আজ আসিফের সাথে আবার ঝগড়া করেছি, ঝগড়া বললে ভুল হবে, ঝগড়া হয় দুই পক্ষ মিলে, আমাদের ঝগড়ায় আসিফের কোন ভূমিকা ছিল না। আমি একাই যা করার করেছি, রাগে আমার সারা গা জ্বলছিল...হাত এত জোরে মুঠ করেছিলাম যে নখ বসে যাচ্ছিল... আমি ভেবেছিলাম আসিফ ইন্ডিয়া যাচ্ছে... আমাকে না বলে...আমি ভেবেছিলাম ও আর ফিরে আসবে না, আমাকে ও আর সহ্য করতে পারেনা... ও আমাকে ভালবাসতে ভুলে গেছে...ও আসলে কোথাও যাচ্ছেনা, ফেসবুকের ইভেন্টটাতে এমনিতেই গোয়িং সিলেক্ট করেছে সেটা বোঝার আগেই আমি তীব্র তাণ্ডব চালিয়েছি ওর ওপর, অকথ্য ভাষায় ওর সাথে কথা বলেছি, এবং কখনও যা করিনি আজ তাই করেছি...ওর মাথায় গ্লাস ছুঁড়ে মেরেছি... গ্লাসটা মাথায় না লেগে কাঁধে লেগেছে, ও কিছুক্ষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, তারপর কিছু না বলে বেরিয়ে গেছে।
(৩)
অন্যদিন আমার রাগ ঠাণ্ডা হতে যতক্ষণ লাগে আজ তার চেয়েও অনেক বেশি সময় লাগছে। কিছুতেই কান্না বন্ধ করতে পারছিনা...আসিফ আবার আমাকে মিথ্যা কথা বলেছে, সে আর আমার কথা শোনে না, আমি ওকে পইপই করে ওই ছেলেগুলোর সাথে ঘুরতে মানা করেছি, অথচ ও কাল বিকেলে ওদের সাথেই ছিল... আমাকে বলেওনি...আজ জিজ্ঞেস করাতে বলেছে, আমাকে নাকি ভয়ে বলেনি, আমাকে সবাই ভয় পায়...মা-বাবা, আসিফ পর্যন্ত...কেউ আমাকে কোনদিন ভালবাসতে পারবেনা... আমি কারও ভালবাসার যোগ্য না... আমি শুধু সবাইকে কষ্ট দিয়ে বেড়াই। কিন্তু আমার ভেতরে যে কষ্ট বাস করে তার খবর কে রাখে? আমি যে অনেক ভয় পাই...আমাকে ছেড়ে সবাই চলে যাবে এই ভয়... তা কি কেউ বোঝে? এই ভয়ে আমি কোন মানুষের সাথে কাছে ঘেঁষি না...কারন একবার তারা জীবনে জায়গা করে নিলে শুধু কষ্টই দেয়... আসিফ ও কি তাই করছে না? আমার ভেতরে যে রাগ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তা তো আমার নিয়ন্ত্রনে নেই, কেউ কেন বোঝেনা?
আমি কাঁদতে থাকি, কাঁদতে কাঁদতেই আসিফের মোবাইলে ফোন করি... ও রিসিভ করেনা...আমি আরও কাঁদি...আমার কান্না ফুরায় না... আজ আমার রাগের বদলে ভয় লাগতে থাকে... তবে কি আসলেই সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে?
(৪)
দু’পাতায় বিশটা ওষুধ। বুঝতে পারছিনা এতগুলো লাগবে কিনা। না লাগলেও খেয়ে ফেলতে হবে...রেখে দিয়ে কি হবে? তাছাড়া বলা যায়না, কম খেলে কাজ নাও করতে পারে। আমি পানি দিয়ে একে একে ওষুধগুলো গিলতে থাকি, তারপর বাতি নিভিয়ে শুয়ে পরি, জীবনে শেষ বারের মত আমার রাগ লাগতে থাকে...কেন এখনও ঘুমিয়ে পড়ছি না...কিন্তু আমি আর রাগ করার সময় পাইনা... প্রতিটা অর্থহীন রাগের মত এই রাগটাও অর্থহীন করে দিয়ে আমার ঘুম এসে যায়। সবাই আমাকে ত্যাগ করার আগে আমিই সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে থাকি।