"আম্মা, একটা কথা ছিল।"
আম্মা পরীক্ষার খাতা দেখছিলেন, রিডিং গ্লাসটা নাকের ওপর আরেকটু ঠেলে দিয়ে আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, "বল"
আমি কোন উত্তর দিলাম না, এবার আম্মা আমার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বললেন, " কি হইসেটা কি? কি বলবি জলদি বল, খাতাগুলা পরশুদিন এর মধ্যে সাবমিট করতে হবে।"
এবার আমি একটা কাশি দেয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু গলা থেকে আধা মানব আধা গরিলার মত কিছু আওয়াজ বেরোল । আম্মা এখনো তাকিয়ে আছেন দেখে আমি মরিয়া হয়ে বলেই ফেললাম, " আম্মা, তোমাকে মেজ ভাই এর যে কথাটা বলসিলাম...।"
আম্মা আমার দিকে যে দৃষ্টিতে তাকালেন মহাভারতের যুগ হলে আমি আরেকটু হলেই ভস্ম হয়ে যেতাম আর কি!
"তোর নেক্সট টার্ম পরীক্ষা জানি কবে?" পরিস্থিতি খারাপ দিকে যাচ্ছে দেখে আমি কিছু বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আম্মা ততক্ষনে পরবর্তী আঘাত হেনেছেন, " লাস্ট টার্ম এ তোর কত পার্সেন্ট যেন আসছিল?" এবার আমি আহত পাখির মত একেবারে মিইয়ে গেলাম, আর কিছুই বলার থাকল না। আম্মা চোখ থেকে রিডিং গ্লাস টা খুলে আবার আমার দিকে তাকালেন, তারপর দরজার বাইরে কান পেতে থাকা মেজ ভাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, " এখন তোমার পড়াশোনা করার বয়স, ভাইদের বিয়ের ঘটকালি করার বয়স না, তারপর ও যদি তুমি আর তোমার ভাইরা এই জিনিসটা না বোঝো..." আমি আড়চোখে দরজার দিকে তাকালাম, মেজ ভাই যে দরজায় শুধু কান পেতেছে তাই না, কানের একাংশ আবার দরজার ফাঁক দিয়ে দেখাও যাচ্ছে....., একেবারে যোগ্য ভাই আমার। আর কথা না বাড়িয়ে আমি আম্মার ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
ডাইনিং রুম এ আসা মাত্র বড় ভাই, নায়লা ভাবি ( যিনি সম্প্রতি আমার বড় ভাবির স্থান দখল করেছেন এবং পূর্ণোদ্দমে বুদ্ধিজীবী গিরি চালিয়ে যাচ্ছেন ) আর বাবা আমাকে প্রায় ছেঁকে ধরল, ওদিকে মেজ ভাই দরজার বাইরে থেকে পড়িমরি করে ছুটে এসেছে। আমি দাঁত মুখ খিঁচিয়ে মেজ ভাইকে বললাম," ঠিকমত আড়িও পাততে জানো না...আম্মা বুঝে ফেলসে যে তুমিই আমারে পাঠাইসো।" মেজ ভাই বলল, " বুঝবে না তো কি? তাই বলে তুই এরকম হনুমানের মত চেহারা বানাবি? " একথা শুনে বুদ্ধিজীবী ভাবি'র কি হাসি! আমি তাকে পাত্তা দিলাম না, সবাই অধির আগ্রহে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু এদের স্বার্থে আমি আম্মার কাছে নিজেকে বলি দিতে পারবনা, আর দেবই বা কেন? মেজ ভাইটার কি কোন কৃতজ্ঞতা বোধ আছে! কেমন চ্যাটাং চ্যাটাং করে আমাকে হনুমান বলে দিল! আমি সবার উদ্দেশে ঘোষণা দিলাম "তোমাদের যত ইচ্ছা বিয়ে-শাদি কর, আমি আর এর মধ্যে নাই।" তারপর মাথা উঁচু করে সদর্পে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম।
বিকালে কলেজ থেকে বাসায় ফিরছি, গেটে দেখা হয়ে গেল পাশের বাসার স্বর্ণা'পুর সাথে। আপু ডাক দিয়ে বলল," কিরে তুই এরকম প্যাঁচার মত মুখ বানাইছিস ক্যান ? তোর প্রফেসররা কানমলা দিসে নাকি? " আমি আপুকে বললাম, " হ্যাঁ হ্যাঁ তুমিও বল, কেউ বলে হনুমান, কেউ প্যাঁচা...প্রানিজগত সমৃদ্ধ করার জন্যই তো আমি বেঁচে আছি।"
"আহারে, সরি সরি, আর বলবনা, কিন্তু তোরে হনুমান কইল কে?"
"কে আবার? মেজ ভাই, বড় ভাই পালায়ে বিয়ে করাতে তারও সাহস বেড়ে গেসে, সেও এখন বিয়ে করতে চায়... তা বিয়ে করবে ভাল কথা, এর মধ্যে আবার আমারে টানাটানি ক্যান? আমারে রোজ রোজ আম্মার কাছে পাঠাইতেসে সুপারিশের জন্য.....আমিই সব সময় বলির পাঁঠা হই আম্মার কাছে...তুমিই বল আপু, এইটা কি ঠিক?"
আপু আমার দুঃখে যথেষ্ট পরিমাণ সমবেদনা জানিয়ে বাসায় গেল ।আহ... স্বর্ণা'পুর কাছে মনের দুঃখ বলতে পেরে কি যে হাল্কা লাগছে । স্বর্ণা'পুরা সতেরো বছর ধরে আমাদের পাশের ফ্লাটে থাকে। এত জিনিয়াস আর ভাল মেয়ে ভুভারতে খুঁজে পাওয়া যাবেনা, এটা স্বয়ং আমাদের আম্মার উক্তি, তাহলেই বুঝুন আপু কি পরিমান লক্ষ্মী একটা মেয়ে। আমার অনেক বিপদে-আপদে আপু আমাকে হেল্প করেছে, আজও করল, কত মনোযোগ দিয়ে আমার কথাগুলো শুনল। উপরওয়ালা এভাবেই বোধ হয় ফেরেশতারুপি মানুষকে পাঠায়। বেশ কয়েক টা দিন পর মনটা ভাল লাগছে।
আসলে ভাল থাকি কেমন করে? মেজ ভাইটা যা আরম্ভ করেছে না...বলার মত না। মাত্র ইন্টার্নি তে ঢুকেছে, এখনি তার বিয়ে করতে হবে, তাও বড় ভাইয়ের মত প্রেমের বিয়ে। মাত্র দু'মাস হল বড় ভাই পালিয়ে বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে , নাহয় ইমোশনাল হয়ে আম্মা সেটা মেনে নিয়েছে। তাই বলে মেজ ভাই ও ? একটু ধৈর্য ধরলে কি হয়? আর আগের বারের মত এবারো আম্মাকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার উপর পরেছে ।তার চেয়েও বড় কথা মেয়েটা কে আমরা কেউ জানিনা, ভাই সেটা বলতে নারাজ, শুধু একটাই কথা, মেয়ে নাকি সোনার টুকরা... মেয়ে আবার কেমন করে সোনার টুকরা হয়? আম্মাকে বোঝাতে হলে মেয়ের একটা পরিচয় তো লাগবে, আম্মাকে আমি কি বলব,"ভাই সোনার টুকরা বিয়ে করতে চায়?" আমি বাবা বুঝিনা প্রেম-পিরিতের এইসব কচকচানি।
রাতে আম্মার মাথা ব্যাথা করছিল, আমি আম্মার মাথায় বাম লাগিয়ে দিচ্ছিলাম, কিছুক্ষন একথা সেকথার পর আম্মা হটাত আমাকে বললেন, "তনু টাও বিয়ে করতে চায়, না? তা, বিয়ে করবে ভাল কথা, মেয়েরা হল ঘরের লক্ষ্মী, বউ হয়ে ঘরে আসলে ঘরের জৌলুস আরও বাড়ে "
আমি তো হতভম্ব, তার চেয়েও বেশি আহত। আমরা ছেলেরা কি আম্মাকে কম ভালবাসি যে আম্মা এরকম মেয়ে মেয়ে করে পাগল। আর শুধু বাড়িতে একটা মেয়ে আসবে এই আশায় আম্মা মেজ ভাইয়ের উদ্ভটটি আবদারেও রাজি হয়ে গেল?
আম্মা আবারো বলতে লাগলেন," নায়লা আসার পর ঘরটা কেমন ভরা ভরা লাগে, তাই না? মেয়েটা ঠিকঠাক মত আছে তো ? আমি তো একদমই ওর খেয়াল নিতে পারিনা, বাপ-মাকে ছেড়ে অনেক কষ্টে আছে বেচারি, ওর খেয়াল রাখা আমাদেরই তো দায়িত্ব...।"
রাগে আমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিলো, এই কইদিনে বুদ্ধিজীবী ভাবি আম্মার এত আপন হয়ে গেল? আরে বাবা, বাপ-মার জন্য এত মায়া তো ছেড়ে আসতে বলছিল কে? আমার ভাইটার মাথা তো খেয়েছে, এবার আম্মার টা খাচ্ছে, আবার তার খেয়াল ও নাকি নিতে হবে, কচি খুকি নাকি? সাধে কি বুদ্ধিজীবী বলি! এক ভাবিতেই এই অবস্থা, মেজ ভাই বিয়ে করলে কি হবে সেটা চিন্তা করে আমার মাথা ঘুরতে লাগল।
আম্মা তখনো বলেই যাচ্ছেন , এতক্ষণ খেয়াল করিনি, শেষ কথাটা শুনে চমকে উঠলাম, " মেয়েটা কে রে? তোকে বলসে নাকি? তোকে তো আবার ওরা সব বলে...আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে বলিস, রাতু'র মত কাণ্ড যেন না ঘটায়, ওদের বিয়ে আমি ভাল করে দেব...তুই এবার যা ,পড়তে বস, আমার মাথা ব্যাথা কমে গেসে..."
আমি মুখ গোমড়া করে মেজ ভাইকে 'সুখবর' দিতে গেলাম, মেজ ভাই খবর শুনে আফ্রিকান সাম্বা নৃত্যের কাছাকাছি একটা নাচ দিল। তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে বলল, "আমি জানতাম সাফু, তুইই পারবি আম্মাকে রাজি করাইতে, বল তুই কি চাস? যা চাবি আজকে তোকে তাই দেব।" এবার আমার মধ্যে কৌতূহল নড়াচড়া দিয়ে উঠল । আমি বললাম," মেয়েটা কে, ভাই? "
ভাই প্রথমে এমন ভাব করল যেন হিব্রু ভাষা শুনেছে, তারপরে ভাব নিল যে কিছু শুনেই নাই, তারপরে আমাকে বলল, " তুই এখন যা সাফু, আমার ঘুম পাইসে"
আমি ভাইয়ের বেইমানিতে যারপরনাই ক্ষুব্ধ হলাম, বিভিন্ন ধরনের অ্যাকশন - রিঅ্যাকশন চালালাম, হুমকি দিলাম, হিন্দি সিরিয়ালের ভিলেনদের মত বিয়ে ভেঙ্গে দিব, কিন্তু কোনোভাবেই ভাইয়ের মুখ থেকে বের করাতে পারলাম না, কাকে বিয়ে করার জন্য তিনি এত উৎসুক । শেষমেশ কোন উত্তর উদ্ধার করতে না পেরে ভাইয়ের রুম থেকে ওয়াক আউট করলাম।
সেদিন বিকেলে মেজ ভাইয়ের সেই কাঙ্ক্ষিত মেয়েকে বাসায় নিয়ে আসার কথা, আম্মা স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি এসেছে, বাবা সব সময়কার মত অতি মনযোগের সাথে পত্রিকা পড়ছে, বড় ভাই, এমনকি চির নির্লিপ্ত নায়লা ভাবি্র মধ্যেও উত্তেজনার ছোঁয়া দেখা যাচ্ছে । একমাত্র আমিই মুখ কাল করে ডাইনিং টেবিল এ বসে আছি, দরজা খোলার মহান দায়িত্ব তো শেষমেশ আমাকেই পালন করতে হবে, তাই না?
ডোরবেল বাজল, দরজা খুলে দেখি স্বর্ণা'পু দাঁড়ানো, আমি উনাকে বললাম, "আপু, ভাল সময় আসছ, দেখ বাসায় কি কাহিনি হচ্ছে...", বাকি কথা মুখেই থাকল যখন দেখলাম পেছন থেকে মেজ ভাই বের হয়েছে, ওর ফর্সা মুখটা লাল টকটকে হয়ে গেছে, স্বর্ণা'পুর মাথা নিচু । এইসময় বুদ্ধিজীবী ভাবি মঞ্চে প্রবেশ করল, স্বর্ণা'পুকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেল, যদিও পরিচয়ের প্রয়োজন ছিল না, তাও আম্মার সামনে কথা বার্তা চালিয়ে গেল। আম্মা এমনই শক খেয়েছেন যে সেখান থেকে বের ই হতে পারছিলেন না। বুদ্ধিজীবী ভাবি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনল, সত্যি বলতে কি ভাবি কে আর অতটা খারাপ লাগছিল না, সত্যিই তো মেয়েরা না থাকলে এসব পরিস্থিতি সামাল দিত কে?
অবশেষে যখন বাবার কথা বলার পালা আসলো, বাবা অত্যন্ত হতাশ গলায় বললেন,"তোমরা মিষ্টি আননি, না? নায়লারা এনেছিল।"
এবার আমার আধা ঘণ্টা ধরে প্রিয় হয়ে ওঠা ভাবি হাসিমুখে বলল, "ওদের শুভকাজ টা হয়ে যেতে দিন বাবা, স্বর্ণা আপনাকে পায়েস রেঁধে খাওয়াবে।"
বাবার সাথে সাথে এবার আমার মুখেও হাসি ফুটল।
পার্ট-১-অতঃপর শুভ(!!) বিবাহ