"আম্মা, ভাইয়া আর ভাবি আসছে ।"
আম্মা হয়ত ব্যস্ত ছিলেন, অথবা এমনিতেও নিজেই ভুল শুনেছেন ভেবে, ভাবি'র ব্যাপারটা বাদ দিয়ে গেলেন। বললেন," রাতু আসছে? ওরে ভাত খেয়ে বের হইতে বল, না খেয়ে যেন যায় না। আমার স্কুল এ আজকে রিপোর্ট কার্ড দেয়ার কথা । আসতে দেরি হবে।" আমি একটু কাশি দিয়ে গলা পরিস্কার করলাম, তারপর আবার বললাম," আম্মা ভাইয়া ভাবি কে নিয়া আসছে।"
এবার আম্মা চুপ করে গেলেন। সম্ভবত ভাবছে্ন। আমাকে বললেন, "দেখ সাফু, ফাইযলামি করিসনা, আজকে আমি অনেক বিজি, বললাম না তোরে? যা ফোন রাখ!" বলে নিজেই লাইন কেটে দিলেন। আমি পাশে দাঁড়ানো বাবা, বড় ভাই, মেজো ভাই, আর ভাবির দিকে তাকালাম। সবাই রুদ্ধশ্বাসে আমার দিকে তাকিয়ে। এছাড়া আর উপায় ই বা কি? আমার সাথে আম্মার ফোনে কথাবার্তার উপর এই বাসার সবার জীবন নির্ভর করছে। মেজ ভাই হা করা মুখটা বন্ধ করে বলল, কি বলে আম্মা? আমি বললাম, "বড় ভাইরে ভাত খাইতে বলসে, আর বলসে বাসায় আসতে দেরি হবে, স্কুল এ রিপোর্ট কার্ড দিবে ত..." আমার কথা শেষ না হতেই বড় ভাই হাউহাউ করে উঠল। বলল, "আরে এইসব না, তোর ভাবির কথা শুনে কি বলসে সেইটা বল।"
"কিছু বলে নাই, ভাবসে ভুল শুনসে।" আমি নির্বিকার মুখে জবাব দিলাম। আমার কথা শুনে আমার আধা ঘণ্টা পুরানো ভাবি একটা নিঃশ্বাস ফেলল, যেন আমি খুবি অধম একজন প্রাণী। আমি নতুন ভাবির দিকে বেশ কটমট একটা দৃষ্টি দেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বলাই বাহুল্য আধা ঘণ্টা পুরানো ভাবি বেশ চালাক মানুষ । আমার দৃষ্টি অতি সহজে ইগনোর করে ফেলল। বড় ভাই বিয়ে করার আর মানুষ পেলনা, এইরকম বুদ্ধিজীবী প্রকৃতির একটা মেয়ে জুটল ওর কপালে। দেখে কে বলবে মাত্র কিছুক্ষন আগে এর বিয়ে হয়েছে, চোখে মোটা চশমা, গম্ভীর চেহারা, কথা বলার সময় মনে হয় যেন ভাষণ দিচ্ছে। নতুন বউ এর কথা চিন্তা করলে আর যার কথাই মাথায় আসুক এনার কথা আসে না।
মিনিট দশেক আগে যখন ডোরবেল বাজল, আমিই দরজা খুলেছিলাম । দেখি বড় ভাই এর সাথে এই মেয়েটা দাঁড়িয়ে। ভাবলাম, ভাইয়ের বান্ধবী। তাতেও বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, কারন আমাদের ঘরের চৌকাঠ মাড়ানোর অধিকার আছে এমন নারী শুধু আমাদের আম্মা। আর আমাদের আম্মা কে যারা চেনে তারা শখ করে কখনো এই বাসায় বেড়াতে আসবে না। আমি মেয়েটার সামনেই ভাই কে বললাম,"কি হইসে ভাই? কোন প্রবলেম? এইটা কে?"
ভাই বাংলা সিনেমার নায়কদের মত বলল, "এটা তোদের ভাবি, সালাম কর।" যদিও বাংলা সিনেমাতে ভাবিরা সালাম করে থাকে, এক্ষেত্রে ঘটনা উল্টা। তবে আমি সালাম এর বিষয়টাকে বিশেষ পাত্তা দিলাম না। আমি তখন রীতিমতো আতংকিত, চোখ কপালে তুলে বললাম," ভাই তুমি গার্ল ফ্রেন্ড নিয়া বাসায় আসছ? আম্মা জানলে..." আমি বাক্য শেষ করতে পারলাম না, নতুন ভাবি আমার কথা কেটে দিয়ে বলল," আমরা ভিতরে আসি? ভিতরে এসে কথা বলা যাক।"
ভাবিই আগে ঢুকল , তার পিছে ন্যাজ তোলা বিলাই এর মত ভাই। আমি তখন ও হতভম্ব হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে। আমি কি স্বপ্ন দেখছি? মেয়েটা কি ভাই কে জাদুটোনা করল? ভাই এর কি স্মৃতি শক্তি হারিয়ে গিয়েছে? ভাই কি ভুলে গেছে আমাদের আম্মা কি চীজ? ইতোমধ্যে ঘর থেকে বাবা আর মেজ ভাই বের হয়ে এসেছে, বাসার ভিতর মেয়ে দেখে তারাও যারপরনাই আতঙ্কিত। নতুন ভাবি আর ভাই তোতলাতে তোতলাতে (তোতলানোটা শুধু ভাই এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) যা বলল, তার সারমর্ম হচ্ছে, ভাই এর সাথে ভাবির মেডিকেল এর ফার্স্ট ইয়ার থেকে পরিচয়। আমার বেকুব ভাই মেয়ে তো দুরের কথা, ছেলেদের সাথেই ঠিক মত কথা বলতে পারেনা। কলেজ এ ভাই এক কোণায় চুপ করে বসে থাকতো, ভাবি ই একদিন আগ বাড়িয়ে পরিচয় করে । তারপর সাত বছরের প্রেম। এখন দুজনেই ডাক্তারি করছে । তাই আমার বুদ্ধিজীবী ভাবির ধারনা তারা বিয়ে করে ফেলতে পারে । তিনি কোন এক অসাধ্য উপায়ে ভাইকে রাজি করিয়ে ফেললেন । যেহেতু কোন পরিবারই রাজি হবে না, তাই পাড়ার কাজি অফিসই ভরসা । আর যেহেতু বিয়ের পর মেয়েদের ঠাঁই শ্বশুর বাড়িতে, তাই বিয়ে করে সোজা আমাদের ঘরে পদার্পণ । ওহ, একটু ভুল বললাম, আসার পথে তারা কষ্ট করে মিষ্টির দোকান ঘুরে এসেছে এবং এক কেজি ছানার মিষ্টি এনেছে। ধন্য আমরা এমন ভাই আর ভাবি পেয়ে।
এহেন কাহিনী শুনে যখন আমরা নির্বাক হয়ে গরুর মত ফ্যালফ্যালে নয়নে তাকিয়ে আছি, তখন বাবা নীরবতা ভেঙ্গে বললেন, "তোমাদের মাকে তো জানাতে হয়।"কোন এক অজ্ঞাত কারণে সবাই আমার মুখের দিকে তাকাল, আসন্ন বিপদ অনুধাবন করতে পেরে আমার মুখ আতংকে লাল-নীল-বেগুনি হয়ে গেল। আমি অতি ভয়ে ভয়ে বললাম, "বড় ভাইয়ের ব্যাপার,সেই বুঝুক।আমাকে আবার এর মধ্যে টানা কেন?" সাথে সাথে ভাবি বলে উঠলেন, "তোমার নাম তো সাফু, থার্ড ইয়ার এ পড়ছ, তাই না? রাতু আমাকে তোমার কথা বলেছে, তুমি নাকি তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট?" মিষ্টি একটা হাসি দিলেন ভাবি, যা আমার কাছে নিমতিতা লাগলো ।
হাহ! নতুন নতুন এসেই উনি আমাকে পাম্প দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন , কিন্তু আমি এত সহজে ভুলছি না। তবে শক্ত হয়ে কোন লাভ হল না, বাবা আর মেজ ভাই মিলে আমাকে দিয়েই কঠিন কাজটা সম্পাদন করালেন। কিন্তু বলাই বাহুল্য আম্মা আমার কথা বিশ্বাস করেননি। এখন উপায়?
আমরা সবাই মাথায় হাত দিয়ে ডাইনিং টেবিল এ বসে রইলাম, আর আম্মার আগমনের অপেক্ষা করতে লাগলাম । টেবিল এর মাঝখানে মিষ্টির প্যাকেটটা আমাদের দেখে ব্যাঙ্গের হাসি হাসতে লাগলো, আমার অন্তত তাই মনে হচ্ছিল।
আমাদের আম্মা একটা ছেলেদের স্কুল এর হেডমিস্ট্রেস। ছোটবেলা থেকেই অনেক মেধাবী আর তেজী ছিলেন বলে নানাজানের কলিজার টুকরো ছিলেন। শুনেছি তার নাকি এক প্রাণের বান্ধবী ছিল যে বেশিদূর পড়ালেখা করতে পারেনি । অল্প বয়সে তার বিয়ে হয়ে যায় । আম্মা তাকে কথা দিয়েছিলেন তার ছেলের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দেবেন। দুর্ভাগ্যক্রমে আম্মার তিন-তিনটি অভাগা পুত্র জন্ম নেয়। আর সেই মহিলার দীর্ঘদিন যাবত কোন ছেলে-মেয়ে হচ্ছিল না । শেষে এক কন্যার জন্ম দিয়ে তিনি মারা যান। আম্মা তখনি ঠিক করে ফেলেন, তার তিনটি পুত্রকেই তিনি ডাক্তার বানাবেন। আমরা ভাইয়েরা তার সেই আশা পূর্ণ করেছি । কিন্তু একটি কন্যা সন্তানের অভাব, আর বান্ধবীকে দেয়া কথা আজও আম্মা ভুলতে পারেন না। আমরা তিন ভাই আর বাবা আম্মা কে যমের মত ভয় পাই, অত্যন্ত কঠিন নিয়ম কানুনের মধ্যে দিয়ে আমরা বড় হয়েছি । কিন্তু আম্মার ভিতরের সেই কষ্ট টুকু আমরা ঠিকই বুঝতে পারি। আম্মার নিজের যতই মেয়ের শখ থাকুক, আমাদের কাউকে তিনি মেয়েদের সংস্পর্শে যেতে দেন নি। আজ অবধি আমরা সেই নিয়ম মেনে চলেছি, আজ বড় ভাই তার বাতিক্রম করল। আম্মা কি রাগটাই না করবেন!! যদি ভাই কে ঘর থেকে বের করে দেন? ভাই আর ভাবি মাত্র এমবিবিএস পাস করে ক্লিনিক এ চাকরি করছে। কি করে চলবে ওরা? ভাবির ফ্যামিলি ও তো মেনে নেবে না...আম্মা যদি বিয়ে ভেঙ্গে দেয়? যদি ডিভোর্স করিয়ে দেয়? ধুর! কি যা-তা ভাবছি। কিন্তু আম্মা বলে কথা, সম্ভাবনা গুলো উড়িয়েও তো দেয়া যায়না।
আম্মা এসেছেন,বরাবরের মত এবারও দরজা খোলার মহান দায়িত্ব আমাকেই পালন করতে হয়েছে। আম্মা ঘরে ঢুকে ভাবি কে আপাদমস্তক দেখলেন, তারপর বললেন, নাম কি? ভাবি নাম জানাল। এরপর আম্মা তার চোদ্দ গুষ্ঠির ঠিকুজি নিলেন,পাশাপাশি চলতে লাগলো জ্ঞান প্রদান- বাড়িতে জানে যে এই ঘটনা করেছ? জান,একটা মেয়ে মা-বাবার কাছে কি জিনিস? মেয়ে কে হারিয়ে তাদের কি অবস্থা তোমার ধারনা আছে? তোমার যদি কখন মেয়ে হয় তো বুঝবে । আর যদি না হয়, আমার মত, তবে আরও বেশি বুঝবে... ভাবি মাথা নিচু করে আছে।এদিকে আমি যত দোয়া দুরুদ জানি সব পড়ে ফেলেছি। বড় ভাইয়ের মুখটা শুকিয়ে আমচুর হয়ে গেছে। মেজ ভাই বোয়াল মাছের মত মুখ হা করে আছে । আর বাবা ভীষণ মনোযোগ দিয়ে চশমার কাঁচ মুছছেন , যেন এটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ।
তারপর বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ আমরা যেন নাটক দেখতে লাগলাম। আম্মা ভাবি কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন । বুদ্ধিজীবী ভাবিও ফোঁপাচ্ছে... তাদের উভয়ের মুখ দিয়ে কান্নার ফাঁকে ফাঁকে দুর্বোধ্য কিছু শব্দ বেরোচ্ছে , যা শুধু তারাই বুঝছে। আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। নারীদের ভাষা নাকি শুধু নারীরাই বোঝে । এখানে কি সেরকম কিছুই হচ্ছে ?
ডায়াবেটিস এর রুগি বাবা চুপি চুপি আমাকে বললেন, একটা মিষ্টি খাব নাকি রে সাফু? আর মেজ ভাই হাঁ করা মুখটা বন্ধ করে আমার কানে কানে বলল, এইরকম হবে জানলে আমি তো কবেই তোর মেজ ভাবি কে....."