চলুন কল্পনা করি, হুমায়ুন আহমেদের কখনও জন্মই হয়নি। আজকালকার ছেলেমেয়েরা কোন হিমু-মিসির আলিকে চেনে না। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া বড়লোকের সন্তানেরা শুধু টেক্সটবুকে রাখা শেক্সপিয়ার পড়ে। মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীদের সাহিত্য চর্চা থেমে আছে শরৎচন্দ্রে, কদাচিৎ রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে। সদ্য কৈশোরে পা দেয়া ভাই বা বোনটিকে কম টাকায় একটা উপহার দিতে আপনি হিমশিম খাচ্ছেন, কারন উপহারের তালিকায় নেই কোন বাংলা বই, যা সহজপাঠ্য ও বয়স উপযোগী। ভাবুক তরুণ কবিরা এখনও কবিতা লেখে, কিন্তু গায়ে জোছনা মাখা অথবা বৃষ্টি বিলাস সম্পর্কে তাদের ধারণা অস্বচ্ছ।
এই সবই আমরা পেয়েছি হুমায়ুন আহমেদের কাছ থেকে।একজন লেখক যে শুধু সাহিত্য ভাণ্ডার কেই সমৃদ্ধ করেন না, সামাজিক জাগরণেও অনেক বড় ভুমিকা রাখতে পারেন, তার বড় উদাহরন তিনি। কিন্তু এরপর কি? আর কি কেউ বাংলা গল্প-উপন্যাস লিখবেন না? হুমায়ুন আহমেদের জনপ্রিয়তার মূল উৎস ছিল তার সহজ সাবলীল ভাষা, সাধারণ বর্ণনাভঙ্গি। কিন্তু কেউ যদি এখন সহজ ভাষায় সুন্দর লেখা উপহার দেয়, তাকে কি আমরা হুমায়ুন আহমেদের নকল বলব? হুমায়ুন আহমেদ লেখার একটা ধারা তৈরি করে দিয়ে গেছেন, সুতরাং বর্তমান সাহিত্যে যে কিছুটা ঐ ধারার ছাপ পড়বে তা তো স্বাভাবিক। এখানে নকল, অনুকরণ এসব ভাবার তো কোন অবকাশ নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, হুমায়ুন আহমেদ মারা গেছেন, তার অসাধারণ সৃষ্টিকর্ম রেখে গেছেন, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের গতি হুমায়ুনের সাথে থেমে থাকবেনা, এখানে নতুন অনেক লেখক আসবেন, তাদের সুযোগ করে দিতে হবে, যাতে তারাও মৃত্যুর সময় কিছু রেখে যেতে পারেন।
বাক্তিগতভাবে আমি হুমায়ুন আহমেদের ঠিক ফ্যান ছিলাম না, এখনও নই। তিনি লেখক হিসেবে অসাধারন, কিন্তু সব মানুষের নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ থাকে, আমি কখনই তার লেখা ঠিক পছন্দ করতাম না। অনেকেই বিশ্বাস করবেন না, আমি জীবনেও বই মেলা থেকে তার কোন বই কিনিনি, আর শুধু বই মেলা বলছি কেন, কোন জায়গা থেকেই কিনিনি। এই মহান লেখকের বিরাট সৃষ্টির মধ্যে থেকে চার-পাঁচটি বই আমি পড়েছি। এর মধ্যে মিসির আলির কাহিনি একটাও ছিলনা। আমি জানিনা মিসির আলি কি করে, কেমন করে কথা বলে, কি খায়, কেমন করে ঘুমায়, অথবা ঘুমায় না। এই নিয়ে আমার কোন আফসোসও নেই, আমি ভাললাগার জন্য পড়ি, আজ পর্যন্ত হুমায়ুন আহমেদের লেখা পরার আগ্রহ জন্মায়নি, যদি কোনদিন জন্মায়, অবশ্যই পরব।
কিন্তু তার আগেই ক্যারা লেগে গেছে। আমাকে অনেকে বলেছেন, আমি নাকি হুমায়ুন আহমেদ এর লেখা নকল করি, এই ব্লগে প্রকাশিত আমার আগের লেখা "সিজোফ্রেনিক" নিয়ে অনেক কথা শুনতে হয়েছে, অনেক সহৃদয় পাঠক কষ্ট করে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, আমার লেখার ঠিক কোন অংশ হুমায়ুন আহমেদ এর কোন লেখার মত, আর গল্পে মিসির আলি'র প্রভাব নাকি খুবি বেশি। মিসির আলি এত জনপ্রিয় চরিত্র যে কেউ সেটা পড়েনি, ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য না। কিন্তু আমি তো জানি যে, আমার লেখায় ঐ চরিত্রের কোন ছাপ পড়তে পারেনা। আর সত্যি বলতে কি, সেরকম কিছু হলে আমি অখুশি হতাম না, হাজার হোক, হুমায়ুন আহমেদ এর সাথে তুলনা, চাট্টিখানি কথা না।
আর একটু আধটু মিল তো থাকতেই পারে। কারো সাথে কি কারও লেখা মিলে যায় না? কিন্তু মানুষ হুমায়ুন আহমেদ এর জন্য এত অন্ধপ্রেম কেন দেখাবে যে, যা দেখবে তাকেই নকল বলবে? আমাদের দেশে কি আর কোন লেখকের প্রয়োজন নেই? আমি লেখালেখিতে একেবারেই কাঁচা। এখনও প্রচুর পড়ছি, কোনদিন যে পাকা হতে পারব সেই আশাও করিনা, নিজের আনন্দের জন্য মাঝে মাঝে লেখার চেষ্টা করি, কিছুই হয়না। এইরকম উদ্ভট মন্তব্য পাওয়ার পরে কোনদিন যে হবে তাও আশা করিনা।
পরিশেষে, একটা প্রশ্ন মাথা থেকে যাচ্ছেনা। যদি আমার জন্ম পঞ্চাশ বছর আগে হত, লেখাগুলো ১০-২০ বছর আগে লিখতাম, আজকে হুমায়ুন আহমেদ এর লেখা পড়ার পর সবাই তাকে কি বলত?