ডোরবেল দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, যে ভদ্রলোক দরজা খুললেন, তার বয়স অনূর্ধ্ব তিরিশ, চশমা পড়া ভাল মানুষের মত চেহারা, আমি চিনলাম, ইনিই শামিম। পাঁচ বছর পর প্রাক্তন প্রেমিকার বাসায় গেলে যদি প্রথমেই তার স্বামীর মুখোমুখি হতে হয় তবে যে কেউই বিব্রত বোধ করবে, আমি করলাম না, আমি মনে মনে এটাই চাইছিলাম।
আমি অত্যন্ত বিনীত গলায় সালাম দিলাম, তারপর বললাম,"শামিম ভাই, আমার নাম জায়েদ, আপনি বোধ হয় আমাকে চেনেন না, আমি মুক্তার ফ্রেন্ড, মানে কলেজ লাইফের ফ্রেন্ড, ওদের পাড়াতেই থাকতাম..."
শামিম ভাল মানুষের মত হেসে বলল,"আমি আপনাকে চিনি, মুক্তার কাছে আপনার কথা শুনেছি। আসুন, ভিতরে আসুন।"
আমার মাথায় চড়াং করে একটা রাগ নাড়াচাড়া দিয়ে উঠল। মুক্তার কাছে শুনেছে? কি শুনেছে? কি বলেছে মুক্তা আমার নামে?
রাগ চেপে ভেতরে গিয়ে বসলাম, শামিম মুক্তা কে ডেকে আনল, হাসিমুখে বলল,"দেখ, কে এসেছে ।"
মুক্তা একটা তোয়ালেতে ভেজা হাত মুছতে মুছতে ড্রয়িং রুমে আসছিলো, আমাকে দেখেই থমকে গেল, "ওমা জায়েদ, তুমি হঠাৎ? কেমন আছ?" অবাক হলেও শামিমের মত মুক্তাও আমাকে হাসিমুখে গ্রহন করেছে। এতদিন পর আমাকে দেখে এরা এমন আন্তরিক আচরণ করছে যেন আমি আসলেই এদের আপন কেউ। ভাল, এটাই তো আমার চাই।
আমি একটু হাসলাম, "ভাল, তোমরা কেমন আছ?" তারপর খুব অপরাধীর গলায় বললাম, "আসলে এভাবে এসে তোমাদের বিরক্ত করতে চাইনি, কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে ঢাকায় আসিনা, এর মধ্যে কাল অফিসের একটা সাপ্লাই ঢাকা পৌছায়নি, সেটা দেখার দায়িত্ব আমার ওপরেই পড়ল, তাই ভাবলাম, আজ রাত টা এখানে কাটিয়ে কাল নাহয় কোন হোটেলে উঠে যাবো..."
শামিম হাহা করে উঠল, "ছিছি, আমরা থাকতে আপনি হোটেলে উঠবেন? এটা একটা কথা? আপনি যতদিন ইচ্ছা থাকুন না... তারপর আপনার কোন অসুবিধা হলে আমাকে একটা চড় মেরে যাবেন...এই মুক্তা, তুমি বল না জায়েদ ভাই কে..."
মুক্তা বলল ,"তুমি চাকরি করছ নাকি? কি চাকরি? কোথায়? "
"সিলেটে, একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে।"
মুক্তা এবার অমলিন হাসি হাসল, আমাকে বলল, "হ্যাঁ, ও ঠিকই বলেছে, আমরা থাকতে তুমি হোটেলে উঠবে কেন? তোমার যতদিন মন চায় থাকো...তা বাসা চিনতে কষ্ট হয়নি তো? এই গলিটা আবার অনেকেই খুঁজে পায়না...আর তুমি এতো দূরে চাকরি নিয়েছ কেন? বাসার সবাই কেমন আছে?..."
কি অবস্থা! এরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই এমন বোকা কেন? এত বোকা মানুষ দিয়ে কি দুনিয়া চলে? কেমন সহজেই আমার সব কথা বিশ্বাস করে ফেলল। মুক্তা ভাবল কি করে যে আমি সত্যি সত্যি চাকরি করছি? আর শামিম যে একটা গাধা তা তো আমি প্রথম দর্শনেই বুঝে ফেলেছি। নইলে এত সহজে আমাকে থাকতে দিতে রাজি হয়। অবশ্য এতে আমারই লাভ, ওরা আমার কথা বিশ্বাস না করলে বা আমাকে থাকতে না দিলে আমাকে ব্যাকআপ প্ল্যান ব্যবহার করতে হত, এত ঝামেলায় যেতে হলনা বলে আমি মনের খুশিতে খুক খুক করে একটু হাসলাম, শামিম ভাবল ওর কোন বস্তাপচা জোকসে হেসেছি, তাই সেও ঘর ফাটিয়ে হাসতে লাগলো।
রাতের খাবারের মেনু হল ভাত, আলু ভাজি, ছোট মাছের তরকারি আর ডিম ভুনা। মুক্তা জানে আমি ছোট মাছ খাইনা, কাঁটা বাছার ধৈর্য আমার নেই, তাই আমার জন্য বিশেষভাবে ডিম ভুনা করেছে। খেতে খেতে ওদের বিভিন্ন কথার জবাব দিচ্ছি আমি, আমি জানতাম ওরা এই প্রশ্নগুলোই করবে, তাই সযত্নে উত্তরগুলো সাজিয়ে এনেছি। এই উত্তর পেয়ে ওরা ভীষণ খুশি। শামিম জোর করে আমার প্লেটে দুচামচ অতিরিক্ত ভাত দিয়ে দিল, রাগে মাথাটা ঝিন ঝিন করে উঠল, ইচ্ছে করছিল এখনি...... কিন্তু অতি কষ্টে নিজেকে সামলালাম, মাথা গরম করে একটা ঝামেলা করে ফেললে সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে। যা করার সব ধীরে সুস্থে করতে হবে। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা তো বাকি।
বেশ সাজানো গোছানো ফ্ল্যাট মুক্তার। শামিম ভালই আয়-রোজগার করে বোঝা যায়। মুক্তার মত সুন্দরী, লক্ষী বউ এসে সংসারটা আরও গুছিয়ে রেখেছে। এই বউ, এইরকম সংসার আমারও থাকতে পারত। আর থাকতে পারতো বলছি কেন, আমারই তো হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেকথা ভেবে আমার কষ্ট লাগেনা, বরং কি হতে যাচ্ছে তা ভেবে আমি একরকম উত্তেজনা বোধ করি। তারপর মনের আনন্দে আবারও খুক খুক করে হাসি ।
মুক্তা যত্ন করে ওদের গেস্ট রুমটা আমাকে গুছিয়ে দিয়ে গেছে। খাওয়ার পর ও আমাকে রুমে পানি দিতে এল। আমি ভান করলাম যেন খুব ঘুম পেয়েছে। আমি যে রাতে ঘুমাইনা তা তো ওদের বুঝতে দেয়া যাবেনা। আজ রাতে বোধ হয় মা আর আসবেনা।
আমার মা, যে কিনা সাতাশ বছর আগে আমাকে জন্ম দিয়ে মারা গিয়েছিল, সে প্রতিদিন আমার কাছে আসে । আমার সাথে কথা বলে, আমাকে বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন বুদ্ধি পরামর্শ দেয়। বেঁচে থাকলে যা যা করতো মরে যাওয়ার পরেও তা করে। জানি এটা স্বাভাবিক না, অন্য কারও মা এরকম করেনা, কিন্তু কে বলেছে আমি আর আমার মা আর সবার মত সাধারণ মানুষ? আমরা হলাম আলাদা, স্পেশাল।
একথা মা নিজে আমাকে বলেছে, বলেছে, আমি যে মায়ের সাথে কথা বলি একথা যেন কাউকে না বলি, তাহলে ওরা মাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবে, আমাকে পাগল বলবে, ডাক্তার দেখাবে, ডাক্তার আবার একে একটা গালভরা নাম দিয়ে অনেক রকম ব্যবসা করবে, যেমনটি ওরা করেছিল মায়ের সাথে।
মা'র বিশেষ ক্ষমতা ছিল, আমি তো শুধু মাকে দেখতে পাই, মা এমনি আরও কত জনকে দেখতো। বাবার যে আরেক মহিলার সাথে সম্পর্ক আছে তা তো মা এভাবেই জেনেছিল। তাইতো মা বাবাকে সবসময় সন্দেহ করতো। সবাই শুধু শুধু আমার মাকে পাগল ভাবল। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় প্রথম এক জায়গায় পড়লাম, আমি যেমন মাকে দেখি, এরকম অনেকেই দেখে, একে নাকি হ্যালুসিনেশন বলে, আর এই রোগের নাম নাকি সিজোফ্রেনিয়া। মা'কে একথা বলতেই মা আমাকে সাবধান করে দিল, আমি যেন কক্ষনও এসব কথা বিশ্বাস না করি, ওরা নাকি মাকেও এসব কথা বলত। মাকে কারও সাথে কথা বলতে দিত না, বড় বড় ইনজেকশন দিত, শেষ দিকে নাকি বেঁধেও রেখেছিল।
"অগো আসলে এইরকম কুনু ক্ষমতা নাইতো, তাই অরা তর-আমার ক্ষমতা কাইড়া নিবার চায়, কাউরে কইস না বাপ, কাউরে কুনদিন কইস না, শেষ কইরা দিব তরে আমার মতন", মা বলেছিল আমাকে।
কিন্তু আমি মায়ের কথা রাখতে পারলাম কই? কলেজ এ ভর্তি হওয়ার পর মুক্তার সাথে সম্পর্ক হল। সেই মুক্তাই সব সর্বনাশ করে দিল, ও কি করে জানি টের পেয়ে গিয়েছিল আমার মধ্যে কোন এক বিশেষ ক্ষমতা আছে, জিজ্ঞাস করতেই আমিও বলে দিলাম মায়ের সাথে আমার কথা হওয়ার ব্যাপারটা, আমি ওকে কত বিশ্বাস করেছিলাম, ভেবেছিলাম শুনে ও মুগ্ধ হয়ে যাবে, আমাকে আরও ভালবাসবে, কিন্তু ও কিনা আমাকে পাগল ভাবল! বাবার সাথে দেখা করে সব বলে দিল, বাবা আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেন। হাসপাতালে আমার সেকি কষ্ট, ডাক্তাররা আমার সাথে সাথে আমার মাকেও পাগল বানাল, বলল, এই রোগ নাকি বংশগত, মায়ের ছিল, তাই আমারও হয়েছে। ওরা আমাকে জোর করে ঘুমের ওষুধ খাওয়াত। খেতে না চাইলে ইনজেকশন দিত, তার চেয়েও বড় কথা হাসপাতাল এ মা আসতো না, আমি তখন কি অসহায়...কথা বলবার কেউ নেই। মুক্তা অবশ্য মাঝে মাঝে আমাকে দেখতে আসতো। কিন্তু ওকে দেখলে আমার মাথায় খুন চেপে যেত, ইচ্ছে করত ওকে শেষ করে ফেলি। ডাক্তাররাও ওকে আসতে মানা করল। বলল, ওকে দেখলে নাকি আমি ভায়োলেন্ট হয়ে যাই।
আমার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেল, দিন, মাস, বছর কেটে যেতে লাগলো। মা যখন আর অনেক দিন আসেনা, তখন আমাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিল। বাড়িতে বাবার কাছে ফিরে এলাম, কিন্তু এসে দেখি সব বদলে গেছে, বাবা অসুস্থ, বন্ধুরা সব ভার্সিটিতে পড়ছে, আর মুক্তা? সে বিয়ে করে ফেলেছে। যেদিন এ খবর শুনলাম, সেদিন রাতে মা আবার ফিরে এল আমার কাছে, বলল, "তর উপর রাগ হইছিলাম, তাই এদ্দিন আহি নাই, তুই কেমন আছোস বাবা?" আমি কাঁদতে কাঁদতে মাকে বললাম মুক্তার কথা, বললাম, মুক্তা আমাকে ছেড়ে চিরতরে চলে গেছে, সাথে দিয়ে গেছে পাগল উপাধি। সেইদিন মায়ের সাথে আমার চুক্তি হল, আমি আর কক্ষনও কাউকে মায়ের কথা বলব না, মাও আমাকে ছেড়ে যাবেনা । আমরা দুই মা-ছেলে চিরকাল একসাথে থাকব। আর কাউকে প্রয়োজন নেই আমাদের।
ভালই ছিলাম আমরা, আমি ঘুমাতাম না, রাতভর জেগে থাকতাম আর মায়ের সাথে কথা বলতাম, দিনের বেলাও মায়ের বিভিন্ন আদেশ পালন করেই কেটে যেত । কিছুদিন আগে মায়ের মাথায় এক বুদ্ধি আসল, আমার সাথে এত বড় অন্যায় করে মুক্তা পার পেয়ে যাবে কেন? আমি তো যেনতেন মানুষ না, মুক্তাকে এর শিক্ষা দিতেই হবে। সাথে মুক্তার স্বামীকেও, সেই তো কেড়ে নিয়ে গেছে মুক্তাকে আমার কাছ থেকে। মা আর আমি দু'জনে মিলে মাস্টার প্ল্যান করলাম, সেই প্লান সফল করতেই আজ আমি এখানে।
দেয়াল ঘড়িটা টিকটিক করে জানান দিচ্ছে সাড়ে বারোটা বাজে,আমার জন্য এটা অবশ্য কোন রাতই না। চারদিক নির্জন, খালি ড্রয়িং রুম থেকে হালকা কথাবার্তা আর টিভির আওয়াজ আসছে, তার মানে ওরা এখনও ঘুমায়নি। আবার ঘড়ি দেখলাম, সময় হয়ে গেছে। আমি আস্তে করে দরজা খুলে করিডোরে বের হলাম, তারপর পা টিপে টিপে রান্নাঘরে গেলাম, এখান থেকে ওদের দেখা যাচ্ছে, আমার থেকে পিছন ফিরে ওরা টিভি দেখছে, রান্নাঘরটা আগেই ভাল করে দেখে রেখেছি, খাওয়ার পর এখানে প্লেট রাখতে এসেছিলাম, তখন ফল কাটা ছুরিটাও লক্ষ করে গেছি, আস্তে করে ছুরিটা হাতে তুলে নিলাম, তারপর পা টিপে নিঃশব্দে এগিয়ে চললাম ওদের দিকে...চোখের কোনা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, মাও আছে আমার সাথে, আমাকে ফিসফিস করে বলছে," যা বাবা, যা, শ্যাষ কইরা দে..."