একটি ভালো টিভি রিপোর্ট তৈরীতে শুধু মাত্র টিভি রিপোর্টারই নয় , ক্যামেরাম্যান ও ভিডিও এডিটরের যেমন সমন্বয় থাকা প্রয়োজন তেমনি সমন্বয় থাকা দরকার রিপোর্টারের সাথে সাক্ষাতকার প্রদানকারীরও। সংবাদ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে একজন টিভি সাংবাদিকের যেমন শব্দের সাথে ছবি কিংবা দৃশ্য সংযোজনের সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়, তেমনি যারা মিডিয়াতে কথা বলবেন তাদেরকেও যথেষ্ট সর্তক থাকা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশের টিভি রিপোর্ট তৈরীতে সাক্ষাতকার প্রদানকারী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা অধীকাংশ সময় বক্তব্য প্রদানের সময় সতর্ক ভাবে সাক্ষাতকার প্রদান করেন না। সংবাদপ্রত্রে যেমন ছাপা অক্ষরে অনেক কিছু উপস্থাপন করার সুযোগ রয়েছে টিভি সাংবাদিকের কিন্তু সেই সুযোগ নেই। একজন টিভি রিপোর্টারের সময় খুব সীমিত। অধীকাংশ সময় ১ মিনিট ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই তাকে যাবতীয় বক্তব্য উপস্থাপন করতে হয়। তাই যে সকল জনপ্রতিনিধি কিংবা সামজপতিরা প্রতিনিয়ত মিডিয়ার মুখেমুখি হচ্ছেন তাদের যদি এই বিষয়গুলো সর্ম্পকে পরিস্কার ধারণা থাকে তাহলে তখন রিপোর্টারের যেমন বক্তব্য ধারনে সুবিধা হয়, তেমনি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করতে চাইছেন সেটি সঠিক ভাবে প্রতিফলিত হয়।
একটি প্যাকেজ রিপোটে দুই থেকে তিনটি বক্তব্য প্রচার হতে পারে যাকে আমরা মিডিয়ার ভাষায় সাউন্ড বাইট বা সিংঙ্ক বলে থাকি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই দেখেছি অধীকাংশ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ’টু দ্যা পয়েন্টে’ কথা না বলে অনেকটা দায় সারা গোছের উত্তর দিয়ে ফেলেন অথবা দলীয় প্রধানকে খুশি করতে তোষামোদ শুরু করেন কিংবা অপর রাজনৈতিক দলের শাসনামলে কি কি হয়েছে বা হয়নি সেগুলো বলতে থাকেন,অনেকক্ষণ বলার পর তিনি মূল প্রশ্নের উত্তরে আসেন, অথচ ঐ কথাগুলো না বলেও তিনি সরাসরি প্রশ্নকর্তার উত্তর দিতে পারতেন। সেই গুরুত্বপূর্ণ সময়টি নষ্ট না হলে সাংবাদিক হয়তো আরো কয়েকটি প্রশ্ন করার সুযোগ পেতেন। এখন রিপোর্টারকে তার সেই দীর্ঘ বক্তব্য থেকে ২০ সেকেন্ডের একটা সাউন্ড বাইট নির্বাচন করতে হয় সংবাদ তৈরীর জন্য। সংবাদ প্রচারের পর সংশিষ্ট ব্যক্তি বুঝতে পারেন তিনি আসলে ঐ বক্তব্যটি ঐভাবে বলতে চাননি। দু’একটা উদাহরণ দেই. বিগত জোট সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছিলেন , আল্লাহ’র মাল আল্লায় নিয়ে গেছে, আর বর্তমান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন নির্বাচন পরবর্তী সহিংশতা বিএনপির আভ্যন্তরীন কোন্দল! উভয় মন্ত্রী এই কথাগুলো পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই বলেছেন । কোন কিছু না ভেবে মুখ ফসকে এমন উক্তি করার কারণে সাধারণ মানুষ এই ধরনের বক্তব্য ভালো ভাবে নেয়নি। এধরণের মন্তব্যের কারণে তাদের রাজনৈতিক দল যেমন ক্ষতির সম্মূখিন হয়েছে , তেমনি নিজেদের অবস্থানও স্থূলো হয়েছে। বাংলাদেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই বলে জামায়েত ইসলমীর সেক্রেটারী জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের একটি মন্তব্যই নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের রাজনীতির হিসাব নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। তাই একজন মন্ত্রী কিংবা জনপ্রতিনিধি দিনের কার্যসূচীতে অবশ্যই তাঁর কাজের তালিকা লিপিবদ্ধ করবেন এবং সেই কাজের সাথে সঙ্গতি রেখে সংশিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে যদি মিডিয়ার মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে তিনি মিডিয়াতে কি বলবেন সেই প্রস্তুতিটিও তাঁর থাকা প্রয়োজন।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এত সময় তিনি কোথায় পাবেন ? এক্ষেত্রে মন্ত্রী বা এমপিদের হয়ে এই কাজ গুলো করে দেবেন তার প্রেস অফিসার। প্রেস অফিসার কিংবা মিডিয়া উপদেষ্টারা ঠিক করে দেবেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা জনপ্রতিনিধি মিডিয়াতে কি বলবেন, সাংবাদিকদের তরফ থেকে কি ধরণের সম্ভাব্য প্রশ্নের মুখোমুখি তিনি হতে পারেন এ সংক্রান্ত একটি সম্ভাব্য প্রশ্ন তালিকাও সংশিষ্ট প্রেস অফিসার তৈরী করে দেবেন। সাক্ষাতকার প্রদানকারী যদি প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের উত্তর না জানেন এক্ষেত্রে তিনি সরাসরি বলতে পারেন বিষয়টির তথ্য এই মূহুর্তে তার জানা নেই অথবা এই বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে না চাইলে বলতে পারেন - এ বিষয়ে তিনি এই মূহুর্তে কোন মন্তব্য করতে পারছেন না। পরবর্তীতে তিনি অফিসে ফিরে গিয়ে প্রশ্নকর্তার বিষয় সম্পর্কে তথ্য জেনে সংশিষ্ট গনমাধ্যমে সেই তথ্য প্রেরণ করতে পারেন। তবে কোন ভাবেই অনুমান নির্ভর কিংবা অবিবেচনা প্রসূত মন্তব্য মিডিয়াতে না করাই সমিচীণ।
টিভি রিপোটিংএ একজন বক্তার জন্য বরাদ্ধ থাকে ১৫ থেকে ২০ সেকেন্ড, ক্ষেত্র বিশেষে ৩০ সেকেন্ড। একজন রিপোটার এই রকম তিনজনের বক্তব্য দিতে হলে সময় চলে যায় ৬০ সেকেন্ড, বাকী ৩০ সেকেন্ডে রিপোর্টার তার রিপোর্টের বিষয়বস্তু উপস্থাপন করবেন। যদিও বিশেষ রিপোর্ট কিংবা অনুসন্ধানী রিপোর্টের ক্ষেত্রে রিপোর্টের বি¯ৃ—তি ৩ মিনিট অথবা তার বেশীও হতে পারে। তবে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ভাষায় দেড় মিনিটের সংবাদকেই স্ট্যান্ডার্ড রিপোটিং বলা হয়ে থাকে। তাই একজন বক্তা কি বলবেন, তাঁর ঐ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি মিডিয়াতে কোন বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতে চান সেটি সর্ম্পকে যদি বক্তা পরিস্কার থাকেন, তাহলে একটি ভালো রিপোট তেরী করা সম্ভব। অধীকাংশ বক্তাই এই বিষয়গুলো বিবেচনা না করেই মিডিয়াতে কথা বলেন এবং নিঃশ্বাস না ফেলেই অনবরত বলতে থাকেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি আমার টিভি সাংবাদিকতার চার বছর সময়কালের মধ্যে মাত্র একজন ব্যক্তিকে পেয়েছিলাম যিনি বক্তব্য দেয়ার আগে বলেছেন আমি কত সেকেন্ডের বক্তব্য চাই! পরে তার পরিচয় জানতে চাইলে ক্যারোলিন হাওই বলেন, তিনি বিবিসি’র হেড অব নিউজের দায়িত্ব পালন করেছেন ৫ বছর। ক্যারোলিন পরে আমাকে হেসে বললেন, ”তুমি তো ২০ সেকেন্ডের বেশী বক্তব্য ব্যবহার করতে পারবেনা তাই বেশী বলে কি লাভ বরং প্রয়োজনীয় কথাটাই তোমাকে বলি”। তার অর্থ এই নয় সকল উত্তরদাতাকে ২০ সেকেন্ডের উত্তর দেয়ার জন্য অনুশীলন করতে হবে। বিষয়টি উল্লেখ করার কারন হলো উত্তরগুলো যতটা সম্ভব ছোট, গঠনমূলক ও টু দ্যা পয়েন্টে হওয়া উচিত।
বাংলাদেশে এই মুহুর্তে ১৩ টি টেলিভিশন চ্যানেল কাজ করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেশ কয়েকটি বাংলাদেশী টেলিভিশন চ্যানেল আলাদা অফিস নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে, সেই অবস্থার প্রেক্ষিতে বাংলা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিস্তৃতি একেবারে কম নয় বরং বলাযায় বিস্তৃতি বিশ্বময়। প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা যেমন বাড়ছে তেমনি দর্শকের প্রত্যাশাও কিন্ত বাড়ছে। ইউকে কিংবা আমেরিকায় একজন দর্শক যখন প্রতিনিয়ত বিবিসি, স্কাই , আইটিভি, সিএনএন কিংবা আল জাজিরার সংবাদ দেখে অভ্যস্ত হয়ে উঠে তখন সেই দর্শক বাংলাদেশের গনমাধ্যমের সংবাদ দেখে আঁড় চোখে তাকাতেই পারে ! আর একটি দেশের জন প্রতিনিধিদের বক্তব্য পুরো দেশের সামগ্রিক চিত্রকেই প্রতিনিধিত্ব করে।
বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর রিপোর্ট বিশ্লেষন করলে দেখা যাবে অধীকাংশ বক্তব্য প্রদানকারী জনপ্রতিনিধিরা মিডিয়াতে কি বলবেন এই বিষয়ে আগে থেকে প্রস্তুতি থাকেন না । কিন্তু পাশ্চ্যাতে আমরা দেখি ভিন্ন দৃশ্যপট, প্রধাণমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড মিলিব্যান্ড মিডিয়াতে কি বলবেন, সেটি তিনি আগেই প্রেসের কাছে পাঠিয়ে দেন। পরে আনুষ্ঠানিক ভাবে সেই বক্তব্য আবার বলেন( যদিও নিদের্শ থাকে বক্তব্য দেয়ার আগে প্রেরিত বক্তব্য প্রচার করা যাবেনা), আর সম্পূরক প্রশ্নের ক্ষেত্রে অনেক সময় তাদের প্রেস অফিসারকে আগে বলতে হয় ঐ সাংবাদিক সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা এমপিকে কিধরনের প্রশ্ন করবেন। তখন সেই প্রেস অফিসার মন্ত্রী বা এমপিকে খানিকটা ধারণা দিতে পারেন তাঁর বস কি ধরণের প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছেন । আর তাৎক্ষনিক বক্তব্যের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট উত্তরদাতার প্রতুৎপন্নমতিতাই ভরসা।
দীর্ঘ দিন একই বিটে কাজ করতে গিয়ে রিপোর্টার অনেক সময় বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমূখি হন। দেখা গেলো অনুষ্ঠানে অনেক মুখ চেনা রথি মহারথীরা হাজির, কার বক্তব্য ফেলে কার বক্তব্য দেবে রিপোটার ! এই নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় হামেশাই। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সাংবাদিকদের যেমন কঠোর হতে হবে, তেমনি আয়োজকদেরও ভাবতে হবে তাদের মিডিয়া মুখপাত্র কারা হবেন এবং বক্তব্য প্রদানের প্রয়োজন পড়লে তিনি কি বলবেন এবং কতটুকু বলবেন। এই সমন্বয় টুকু ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য খুবই জরুরী। তাছাড়াও সংবাদ তৈরীর সুবিধার্থে, রিপোর্টের সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে রিপোর্টার স্বাক্ষাতকার গ্রহনের ক্ষেত্রে তার নিজস্ব বিবেচনাকেই প্রাধ্যান্য দিয়ে থাকেন অধীকাংশ সময়। এক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি কিংবা মুখ চেনা লোকের স্বাক্ষাতকার গ্রহন কিংবা একই ব্যক্তিকে বার বার স্বাক্ষাতকারের জন্য বিবেচনায় আনলে রিপোর্ট বিতর্কীত হতে পারে।
মাত্র ৯০ সেকেন্ডের হিসাব নিকাশে অধীকাংশ সময়ই অনেক কিছু করা সম্ভব হয়ে উঠেনা। অন্যদিকে ঐ ৯০ সেকেন্ড সময়ের বিষয়টি মাথায় রেখে একজন রিপোর্টার যদি সব কিছুর উর্দ্ধে থেকে সাক্ষাতকার গ্রহনের সময় রিপোর্টের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য বের করে নিয়ে আসতে পারেন , তবেই সেই রিপোর্টার ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন তারকা সাংবাদিক।
তানভীর আহমেদ
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:৩৬