‘আমাদের নেতাদের এই বয়সে ফাঁসি/জেল দিতে চায়,এই সরকারের মতিগতি ভালোনা।আল্লাহ-র লানত এদের উপর পড়ুক!এইরকম সুন্দর চেহারার দুইটা লোক,দেখলে মায়া লাগেনা বলেন?এতদিন পরে এসে এইসব বাজে ব্যাপার নিয়ে শাস্তি দেয়ার চিন্তা করা-কোন মানে হয় বলেন?কি লাভ এসব করে?’
কথাগুলো বলেছিলেন আমার এক এক্স-কলিগ,বছর দুই আগে।তিনি কাজের ফাঁকে খুব দুঃখ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন।আমি আমাদের দেশের নোংরা রাজনীতি নিয়ে কখনো,বিশেষ করে অফিসে কথা বলার পক্ষপাতী নই।তাই কথা না বাড়িয়ে নিজের ডেস্কে ফেরত গেলাম।কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে ভদ্রলোকের বলা কথাগুলো নিয়ে ভাবলাম,অবাক হলাম মানুষ নিজের মতাদর্শের ব্যাপারে কতো অন্ধ হতে পারে ভেবে!
এই অন্ধ মতাদর্শ যারা এই ভদ্রলোকের মতো আরও বহু মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন,তারা সার্থক বলাই যায়।মানুষকে এরকমের ভ্রান্ত এবং অন্ধ বানাতে পারা চাট্টিখানি কথা নয়!কিভাবে পারলেন তারা?
আসলে সময়ের কাজ সময়ে না হবার ফল এরকমই হবার কথা।১৯৭১-এ জন্ম নেবার পর এই দেশটির যখন এক অসম অসাধারণ যুদ্ধ জয়ের অনুপ্রেরণা বুকে নিয়ে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে সামনে এগুবার কথা ছিল,তখন অদ্ভুতভাবে সেই সামনে এগুবার জন্যে যে পথপ্রদর্শক আমাদের পাওয়ার কথা তা আমরা পাইনি। এবং অদ্ভুত হতভাগ্য জাতি আমরা যে আমাদের যুদ্ধকালীন কাণ্ডারি যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এক চরম ব্যর্থ রাষ্ট্রনায়কে পরিনত হলেন। আর তাঁর বহু ভুলের এক ভুল হয়ে দাঁড়ালো যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দেয়া,এদের বিচার না করা। তাঁর শাসনকাল এতোই বাজে হল যে তাঁকে পরিবারসহ এর পরিণাম ভোগ করতে হল।এরপর অনেক ধোঁয়াটে আর বিতর্কিত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে কিছু সময়ের জন্যে একজন ‘ভিশনারী’ নেতা আমরা পেলাম ঠিকই,কিন্তু ‘ব্যারাক’ থেকে বেরিয়ে রাজনীতি করার মাশুল দিয়ে তাঁকেও অস্বাভাবিকভাবেই চলে যেতে হল।যাবার আগে তিনিও মারাত্মক একটি ভুল করে গেলেন,এদেশের রাজনীতিতে ১৯৭১-এর রাজাকারদের পুনর্বাসন করে গেলেন।হা হতোস্মি!আর এরপরের ইতিহাসে স্বৈরাচার শাসন-শোষণ,স্বৈরাচারের পতন...এরপর গণতন্ত্র?নাহ!গণতন্ত্র নামক প্রহসনের মাধ্যমে আমরা এরপর দুই নারীর বাপ এবং স্বামীকে নিয়ে চুলাচুলি ছাড়া আর তাদেরকে আঁকড়ে ধরে স্বৈরাচার এবং রাজাকারদের শক্তিশালী হওয়া(ধর্মের কথা বলে রাজাকাররা এখন স্বৈরাচারীর চেয়ে শক্তিশালী),পুনর্জীবন লাভ করা ছাড়া কি পেয়েছি?হ্যাঁ,সীমাহীন দুর্নীতি আর ব্যর্থ রাষ্ট্রযন্ত্র পেয়েছি।
এই হ-য-ব-র-ল অবস্থা যে দেশের সে দেশে আমার উপরোল্লেখিত কলিগের মতো লোক থাকাই স্বাভাবিক।যে দুই নেতার কথা ভদ্রলোক বলেছিলেন,তাদের কথা মনে হলেই কিছু প্রশ্ন মাথায় ঘোরাফিরা শুরু করে দেয়।আজকাল বন্দী এই দুই নেতাকে কিছু প্রশ্ন করার ছিল আমার,যা তাদেরকে সামনাসামনি কখনো করা হবেনা বোধ হয়।তাই ব্লগের মাধ্যমেই তাদেরকে জিজ্ঞেস করছি-
a. এদেশের ক্রান্তি লগ্নে যখন দেশটির প্রতি আনুগত্যবোধ,মমত্ববোধ দেখানোর সময় এসেছিল তখন কোন যুক্তিতে দেশটিকে আর তার স্বাধীন হবার চেতনাকে পায়ে ঠেলেছিলেন আপনারা? জানি বলবেন,মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন আপ্নারা।কিন্তু প্রতি-প্রশ্ন হল,কিসের ভ্রাতৃত্ববোধ টিকে ছিল আমাদের সাথে তাদের যেখানে আপনাদের আরাধ্য ভাইয়েরা সৎ ভাইয়ের চেয়েও জঘন্য আচরণ করে যাচ্ছিল সেই পাকিস্তান নামক দেশটির জন্মলগ্ন ১৯৪৭ সাল থেকেই?আপনারা ইতিহাস জানতেন না?আশেপাশে কি হচ্ছে,কিছুই না জেনে রাজনীতি করতেন?
b. মানলাম নাহয়,আপনাদের ভাই-ভাই থিওরি।কিন্তু ১৯৭১ এর ২৫ শে মার্চের পর সেই থিওরি একজন প্রকৃত মুসলিম কিভাবে মেনে নিতে পারে?এত বড় জঘন্য গণহত্যার অপরাধে আপনারা পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেননি?জানি বলবেন,আমরা ২৫শে মার্চ রাত সম্পর্কে জানতাম না।প্রতি প্রশ্ন-তবে কেন এর পরে করলেন?একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম(যা আপনারা নিজেদের দাবী করেন)কিভাবে ওই রাতের পর নিজ জাতির সাথে শত্রুতা/বিশ্বাস ঘাতকতা করতে পারে আর হানাদারদের সাহায্য করতে পারে?
c. মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস আপনারা রাজাকার হয়ে,আল-বদর ব্লা ব্লা হয়ে পাকিস্তানীদের সাহায্য করলেন,ওদের হয়ে মানুষ মারলেন,মেয়েদের ওদের হাতে তুলে দিলেন,নিজেরাও ধর্ষণ,লুটপাট করেছেন।অথচ এরপর সেই দেশ যখন স্বাধীন হয়েছে,তখন তাতে নির্লজ্জ বেহায়ার মতো বসতি স্থাপন-ই শুধু করেননি,সে দেশের ক্ষমতায় আরোহণ করার নজিরবিহীন স্বপ্নও দেখেছেন,এখনও দেখছেন!কিভাবে এতটা নির্লজ্জ হওয়া সম্ভব মানুষের পক্ষে?
d. এই দেশের ইতিহাস আপনারা বিকৃত করেছেন,মিথ্যাচার করেছেন ১৯৫২ থেকে শুরু করে ১৯৭১ পর্যন্ত সময়ের ইতিহাস নিয়ে।মুসলমান এই কাজ কিভাবে করে?
e. আপনাদের দলীয় লোকেরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মিথ্যাচার করে আজকের ধর্মপ্রাণ তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে।একটা উদাহরণ দেইঃএসব তরুণদেরকে আরও নানা মিথ্যার সাথে এও আপনাদের দল জানায় যে বিহারীদের প্রতি বাঙ্গালীদের চরম অত্যাচারের প্রেক্ষিতে ২৫ শে মার্চ রাতে এবং তার পরবর্তীতে পাকিস্তানীরা প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে হত্যা-লুণ্ঠন-ধর্ষণ করেছিল।এইসব হাস্যকর তথ্য আপনারা নেতারাই কি সাপ্লাই দেননি দলটিকে?কেয়া বাত হ্যায়!
f. স্বার্থোদ্ধারের জন্যে আপনাদের মিথ্যাচারের সাথে জড়িয়ে ইসলাম ধর্মকেও এদেশের মানুষের কাছে হেয় করার কাজটি কেন করেছেন?আপনারা কি একবারও ভাবেন এদেশের মানুষকে ইসলাম বিরোধী আপনারাই করে তুলছেন,এদেশের নতুন প্রজন্ম আপনাদের কারণেই ধর্ম সম্পর্কে বৈরি ধারণার বশঃবর্তী হচ্ছে?
এইসব প্রশ্ন নিজেদের করার সময় কি আপনাদের এখনও আসেনি? যদি সত্যিই আপনারা ধর্মপ্রাণ হন(আপনাদের দলের লোকেরা তাই বলে)এবং অনুশোচনা আপনাদের হয়েই থাকে,তবে শুধু আল্লাহ-র কাছে নয়,এদেশের মানুষের কাছে/যাদের প্রতি অন্যায় করেছিলেন তাদের কাছে নতজানু হয়ে ক্ষমাপ্রার্থী হন এবং এদেশ,এদেশের মানুষ যে শাস্তি নির্ধারণ করে দেয় তা মাথা পেতে নিন।দেশকে আপনাদের বিচার নিয়ে আরও সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়ে নিজেদের পাপের বোঝা আরও ভারী করবেননা।কেবল এই এক উপায়েই আপনাদের প্রকৃত মুক্তি সম্ভব,পাপ থেকে,কলঙ্কময় ইতিহাস থেকে;ইহকালে এবং সম্ভবতঃ পরকালেও।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৩:৫৯