ছোটবেলা থেকে সবচে কম গুরুত্ব দিতে শিখেছিলাম যাতে সেটা হলো ধর্ম।আমি সত্যিকার প্র্যাকটিসিং মুসলিম ফ্যামিলি থেকে আসিনি,মানে এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ পরিবার যেমন হুজুরের কাছে শিখে নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, হুজুর যেভাবে কোরআন শরীফ পড়া শিখায় সেভাবে মাঝে মাঝে কোরআন শরীফের শব্দগুলো আওড়ায় (বুঝাবুঝির বালাই নাই),হুজুর যা বলে/যেভাবে যত বলে ততই যাকাত দেয়(কখনো দেয়,কখনো দেয়না)..ঠিক সেরকম ফ্যামিলি থেকেই এসেছি।মানে হুজুরের বাইরে ধর্ম জানার-বোঝার কিছু হতে পারে,জীবনের সবকিছুতে তার প্রয়োগ হতে পারে,এ আমার বোধগম্যতার বাইরে ছিলো।
তো এরকম একটা ফ্যামিলি থেকে এসে ইউনিভার্সিটি লাইফে প্রথমবার দুইজন বোরখা পড়া(নেকাবী) মেয়ে আমার ক্লাসমেট হলে তারা আমাকে বড়ই কৌতুহলী করে তুলতে লাগলো।আগে আমার ধারণা ছিলো বোরখা পড়া মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়েনা,তারা গ্রাম্য হয়,বড়জোর বি.এ পাশ করে বিয়ে হয়ে ঘর-বাচ্চা (অবশ্যই অনেকগুলো) সামলায়..এখন দেখলাম,এরা ড্রেস-আপ ছাড়া বাকি সবকিছুতে ভালই স্মার্ট(বোরখা তো আর স্মার্ট ড্রেস-আপ হতে পারেনা নন-হিজাবী মেয়ের কাছে)।
এরা প্রথম এক বছর আমাকে ভালই পজিটিভ ধারণা দিচ্ছিলো নিজেদের ব্যাপারে।কেমন?ওয়েল,তাদের দেখে আমি প্রথম জানলাম ধর্ম জীবনের সব অংশকে প্রভাবিত করবেই,এটাই আমার ধর্ম বলছে।পরীক্ষার মাঝে হল থেকে বেরিয়ে 'মূল্যবান' সময় নষ্ট করেও নামাজ পড়তো তারা,আমি অবাক হতাম।একবার দেখলাম রিকশায় বসেই নামাজ পড়ছে!এরা আমাদের সাথে আড্ডা দিতো,পিকনিকেও যেতো,আবার ধর্মীয় সব অনুশাসনও মেনে চলতো।তবে বছরখানেক পরে এরা শিবিরের মেয়েদের সংস্করণের (ছাত্রী সংস্হা) সাথে জুটে যাওয়ায় আমাদের সাখে মিশা বন্ধ করে দিলো,আমার সাথে একজন একদিন জামায়াতী ইসলামীর পক্ষ নিয়ে তুমুল ঝগড়া করে ফেললো..ওরা আমাকে আর আকর্ষণ করতোনা এরপর,বিশেষ করে পড়াশোনা বাদ দিয়ে দলের কাজ করে বেড়ানো আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর ছিলো,এখনো আছে।তবে এরপরও মানুষ হিসাবে চমৎকার এই মেয়ে দুটি পরবর্তীতে আমার হিজাবী হবার একরকমের অনুপ্রেরণা ছিলো।
কিন্তু আমি ধর্মীয় অনুশাসনে অনুরক্ত হওয়ার পর আবিষ্কার করলাম আমার হঠাৎ পরিবর্তন আত্মীয়-স্বজনরা ভালভাবে নিলেন না,অনেকেই জামায়াতী ইসলামী হয়ে গেলাম কেন সরাসরি জানতে চাইতেন,কেউ আবার চোখ কুঁচকে নামাজ-রোজা ঠিক রাখলেই চলে বলে 'স্কলারলি' মতামত দিতে লাগলেন।মজার ব্যাপার হলো,যারা খুশী হলেন তারা দেখলাম জামাতকে অপছন্দ করেননা!তবে দিন যত যেতে লাগলো লোকজনের আমাকে জামাতী ভাবার পরিমাণ বাড়ায় এই দলটির প্রতি আমার রাগও ততই বাড়তে লাগলো।
যাই হোক,এরপর ব্যাংকে জয়েন করলাম।প্রথম ব্যাংকের ব্রান্চটি ছিলো নতুন,উদ্বোধনের দিন যাতে মেয়েরা শাড়ী পরে আসে সেজন্য ম্যানেজার খোদ নির্দেশ দিলেন।তা,আমি ভাবলাম 'খাড়ুস' (হিন্দি শব্দ,আমরা তাঁকে তাই ডাকতাম!)আমার কথা ভুলে গেছে,মনে করিয়ে দিতে গেলাম,'স্যার,আমি তো আর শাড়ী পরে আসতে পারবোনা...'
'খাড়ুস' কম্পিউটার থেকে মুখ তুলে(বজ্রকন্ঠে):হোয়াই ক্যান্ট ইউ?
আমি:আমি তো হিজাব করি।
খাড়ুস:শাড়ী পড়েন একদিন।
আমি:সরি স্যার,আই ক্যান্ট।
খাড়ুস(বিরক্ত হয়ে):পড়েন তাহলে যা খুশী..
আমার মনটা খারাপ হলো,মনে হলো বস্ আমার ড্রেসআপকে অপমান করলেন বিরক্ত হয়ে।মনে প্রশ্ন এলো,প্রকারান্তরে তিনি কি আমার ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করলেন না?কিন্তু একসময় দেখলাম এই দুঃখ আমার প্রাপ্য ছিলো।কারণ,মুসলিমপ্রধান দেশ হবার পরেও এই বিরক্তি অনেকের মাঝেই কাজ করে;হিজাবকে 'মেয়েদেরকে শৃংখলিত করার অগ্রধাপ' বিবেচনা করে।আর তার পিছনে আসল দায়ী ব্যাক্তি আমার মতো 'প্র্যাকটিসিং মুসলিমরাই'!
একসময় আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে আমি যতদূর বুঝলাম তাতে স্যাকুলার দৃষ্টিকোণ থেকে হিজাব মানেই শৃংখল,এটা বাস্তবতার নিরিখে এদেশে যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি।এরকম যারা ভাবেন(আমার এক্স-বসের মতো লোকজন) তাদের ব্যাপারে তাই এখন আর আমার অভিযোগ নেই।কারণ এদেশে হিজাব মানে,ধর্ম মানে আসলেই কিছু নির্দিষ্ট গন্ডিতে গিয়ে ঠেকেছে।কবে থেকে এর শুরু আমি জানিনা,সেই হিস্টরি জানতে আমার আগ্রহও নেই।তবে 'আব্দুল্লাহ্' উপন্যাস আমল থেকেই ইসলাম এদেশে (উপমহাদেশেও) অন্ধকারের পকেটে ঢুকে বসে আছে।সেই অন্ধকার থেকে বেরোবার উপায় হিসাবে কেউ যদি ধর্ম থেকেই দূরে সরে যায় তো তাকে নাস্তিক বলে গালি না দিয়ে,তার সমালোচনা না করে নিজেদের দিকে তাকানো উচিত।নিজের কোন্ বাজে আচার-আচরণ/ধর্মীয় কোন্ অনুশাসনের ভুল প্রয়োগের কারণে তাকে ধর্ম থেকে দূরে সরে যেতে হয়েছে সেটা খতিয়ে দেখা উচিত।মেয়েদেরকে ধর্মের নামে,হিজাবের নামে ঘরে আটকে রাখার জন্যে,মানবাধিকার রহিত করে রাখার জন্যে কোনো নাস্তিক তো দায়ী ছিলোনা কখোনো,তথাকথিত মুসলমানরা/আলেম নামের কলংকরা/অশিক্ষিত/অর্ধশিক্ষিত/কুশিক্ষিত মোল্লারাই দায়ী ছিলেন,এখনো আছেন।যেখানে ইসলামে মেয়ে স্কলারের একসময় কমতি ছিলোনা,যেখানে মেয়েরা নবীর আমলের জাহিলিয়াত আরবে ছেলেদের পাশে যুদ্ধ করেছেন সেখানে আজ ১৫০০ বছর পর এসে এদেশে মেয়েদের অবস্হা কেমন?যেসব পরিবার ইসলামিক অনুশাসন ঠিকঠাক মেনে চলে তাদের অবস্হা কেমন?আমার অভিজ্ঞতা বলে:
প্রধাণত: এইসব পরিবার হয় জামায়াতী ইসলামী মনোভাবের,যেন জামায়াতী ইসলামী এদেশে
ইসলামের সোল এজেন্ট!এসব পরিবারের কর্তারা এদেশে থেকেও এদেশের স্বাধীনতা/স্বাধীনতা যুদ্ধকে স্বীকার করেননা,এসব তাদের কাছে 'ইন্ডিয়ার ষড়যন্ত্র'।আর যদিবা স্বীকার করেন,তাহলেও শেখ মুজিব নাম শুনলেই নাক কুঁচকান।যুদ্ধাপরাধীদের তারা মহান মুসলমান মনে করেন যাদের আনুগত্য ত্যাগ করা মানে যেন আল্লাহর আইন ত্যাগ করা!স্বভাবতঃ এসব পরিবারের মেয়েদেরও এই-ই ধ্যান-ধারনা গড়ে উঠে,কেন যেন এর বাইরে চিন্তা করার শক্তিও তাদের খাকেনা।কারণ তারা কেউ কেউ মাদ্রাসার(দ্রষ্টব্য:মাদ্রাসা শিক্ষায় সমস্যা নেই,সমস্যা আমাদের দেশের কুপমন্ডুক মাদ্রাসা শিক্ষায়।নাহলে মাদ্রাসা শিক্ষা এখন সিঙ্গাপুরের মতো জায়গায় সঠিক ভাবে,জনপ্রিযভাবে চালু হতোনা।)বাইরে পড়াশোনা যদি করেও,খুব কম সংখ্যকই উচ্চশিক্ষা পায়।দুঃখজনকভাবে যারা উচ্চশিক্ষা পান তারাও পরিবার থেকে ছাত্রী সংস্হা বগলদাবা করে 'শিক্ষিত' হোন,যে কারণে মানসিকতার বিন্দুমাত্র উত্তরণের মাধ্যমে জামায়াতী ইসলামী আর যুদ্ধাপরাধীদের কবল থেকে মুক্ত হতে পারেননা।
এই হলো যেসব ইসলামিক ধ্বজাধারীরা মেয়েদের পড়াশোনা করান তাদের হিজাব/নিকাবধারীদের অবস্হা।কিন্তু বেশীরভাগই মেয়েদেরকে পড়াননা,আর সেসব হিজাব/নিকাবধারীদের অবস্হা সকরুণ।আমি নিজের আত্মীয়দের দেখেছি যাদের ছেলেরা ঢাকা ইউনিভার্সিটি পাশ করা,আর মেয়েরা সেভেন/এইট/টেন পাশ করে ছয়/সাতটা বাচ্চার মা।এমন লোকও দেখেছি যিনি একমাত্র ছেলেকে মাদ্রাসায় তো অন্ততঃ পড়ালেন,কিন্তু মেয়েগুলোকে কিছুই পড়ালেননা।তাঁর মেয়েগুলোর পড়ার এতোই ইচ্ছা ছিলো যে তারা বাপকে লুকিয়ে স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করেছেন।কি করুণ দশা!এই ভদ্রলোক ইসলামকে কতদূর জানতে পারলেন?তিনি কি ইসলামিক স্কলার ফাতিমা সা'দ আল খায়ের,ফাতিমা আল-জুযাদনিয়াহ্,যায়নাব বিনতে কামাল,ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ আল সামারকাজি,উম্ম আল দারদার মতো মহিলাদের নামও জেনেছেন কখনো?হাজারো মুসলিম মহিলা হাদিস স্কলারের কথা জেনেছেন?এরাতো মেয়ে ছিলেন!
এসব ইসলামিক ধ্বজাধারীরা বলেন শরীয়াহ্ প্রয়োগ হতেই হবে,বলে মেয়েদের দোর্রা মারেন,পাথর ছুড়েন..ইসলামের নামে মানুষের মনে এরা ভয় ঢুকিয়ে দেন,শরীয়াহ্-কে প্রস্তরযুগের নিয়ম বানিয়ে ছেড়েছেন এরা।আরে,যে সমাজ ইসলাম চিনেইনা,যা চিনে তা অতি নগণ্য,ভুলভাবে চিনে,সেই সমাজে কিসের শরীয়াহ্ আইন??কোন যুক্তিতে সেই সমাজে শরীয়াহ্-র একটা অংশের বাজে প্রয়োগ?যে দেশ পারেফক্ট ইসলামিক রাষ্ট্রই না সেখানে হঠাৎ করে কিসের শরীয়াহ্ প্র্যাকটিস?মজার এবং দুঃখজনক ব্যাপার হলো,তারিক রামাদান বা ইউসুফ আল কারাদাওয়ির মতো স্কলাররা এখন বলেন,যেহেতু সত্যিকার ইসলামিক আদর্শের রাষ্ট্র এখন বিশ্বের কোথাও নেই,সেহেতু শরীয়াহ্ আইনের নামে সৌদি আরব বা অন্যান্য দেশে করপোরাল পানিশম্যান্ট,স্টোনিং এগুলো বন্ধ রাখা উচিত(যেহেতু বিচার ব্যবস্হা এবং খোদ রাষ্ট্র এসব ব্যাপারে সৎ থাকছেনা)।
আর এরপর যদি আমার মতো হিজাবীরা স্যাকুলারদের রোষানলে পড়েন আর হিজাব/নিকাব নিয়ে ব্যাঙ্গ শোনেন তো সেটা আমাদের পাওনাই বলা ভালো।আমরাই আমাদের এই অবস্হা ডেকে এনেছি।এর বড় উদাহরণ,যেসব হিজাবী জামায়াতী ইসলামের মেয়েরা ধরা পড়েছেন গোপন মিটিং করার দায়ে তারা।তাদের উপর অত্যাচার/অন্যায় হয়ে থাকলেও তাদের হয়ে যদি নারী অধিকারের পক্ষে সবসময় গলা ফাটানো লোকেরা কিছু না বলেন তো দোষ সেই নারীবাদীদের নয়।দোষ আমাদের মতো তথাকথিত মুসলিম নামধারীদের যারা বহু বছর ধরে ধর্মকে একটি বিশেষ দলের করে তুলেছি।এই মেয়েরা যত ভয়ংকর অপরাধ-ই করে থাকুক না কেন,নারী হবার সম্মানটুকু তাদের অবশ্যই প্রাপ্য,একজন অন্ত:সত্তা হওয়ায় তার আরও বেশী প্রাপ্য,সারা দুনিয়ার সভ্য দেশে তাই-ই হয়;এই সহজ সত্যটুকু আমার দেশে বিএনপি-জামাতের দুর্বল সহচররা ছাড়া আর কেউ বলছেননা কেন?কারণ ইসলাম নামের অপপ্রয়োগকারীরা এমন অবস্হা তৈরী করে রেখেছেন যে এই মেয়েদের হয়ে কথা বলা মানেই সবার চোখে জামায়াতী হয়ে যাওয়া!(যদিও 'নারীবাদীদের' এই ন্যাক্কারজনক ভীতু রুপকে,চুপ থাকাকে আমি সমর্থন করছিনা।)
বোরখা মানেই পশ্চাদপদতা,নেকাব মানেই জামাত,দেশের জন্মদাতাকে অস্বীকার করা,পাকিস্তানের অন্ধ সাপোর্টার হওয়া,ইউনিভার্সিটি ক্লাসে নিজের মতো ছাড়া বাকীদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা আর হলের মেয়েদের হাতে গোলাম আজমের/মওদুদীর বই ধরিয়ে দিয়ে পড়ার অনুরোধ করা..এই ট্যাগ আর কতদিন?বলা হয় শিক্ষিত মা শিক্ষিত জাতি গড়ে,আর তাই শিক্ষিত মুসলিমাদের অনেক কিছু করার আছে যাতে তারা মনোযোগী হচ্ছেননা।দেশকে/দেশের আঁধারের গহ্বরে থাকা মেয়েদের প্রকৃত মুসলিম শিক্ষায় শিক্ষিত করার তাদের এখন-ই সময়।তাদের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ,নিজেদের জামাতী ট্যাগ থেকে বের করে আনুন।নাহলে বোধ করি ধর্মের ব্যাপারে অজ্ঞতা/মুর্খতার পাশাপাশি এদেশে ইসলামের সবচে বড় শত্রু জামায়াতী ইসলামের দুষ্ট চক্রের মাঝে পড়ে প্রকৃত ইসলামিক শিক্ষা একসময় কালের গহ্বরে হারিয়ে যাবে।দেশের নারীদের জন্যে ধর্মহীনতাকে আমরাই ডেকে আনছি,এটা উপলব্ধি করার এখনই বোধহয় শেষ সময়।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ৯:৩১