কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা ছবি খুব ভাইরাল হয়েছিল। একটি নামকরা কলেজের নোটিশ বোর্ডর ছবি। সেখানে ছয়জন শিক্ষার্থীর ছবি সহ নাম আর রোল টানিয়ে দেয়া । প্রথম তিনটি ছবির উপরে লেখা মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী তালিকা এবং শেষের তিন শিক্ষার্থীর নামের উপরে লেখা দুর্বল ছাত্র-ছাত্রীর তালিকা।
বাহ্ ! কি চমৎকার ভাবে সিলগালা করে দিল ! আর জনসমক্ষে একদলকে মাথায় তোলা হলো আর আরেকদলকে চরম অপমান করা হলো। বড়ই সোন্দর্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা !
আমাদের সবারই স্কুল লাইফে শোনা একটা খুব কমন প্রশ্ন ছিল। নতুন কোন আঙ্কেল-আন্টির সাথে পরিচয় হলে বা কোন মেহমান বাসায় বেড়াতে আসলে নাম আর কোন ক্লাসে পড় এই দুইটা প্রশ্নের পরপরই যে প্রশ্নটা আসতো সেটা হচ্ছে “তোমার রোল নাম্বার কত”? যদি ১/২ হয় তাহলে তো ভালো দশের মধ্যে থাকলেও চলবে কিন্তু যদি কোনক্রমে দশের বেশি হয় তাহলেই শুরু হবে বাচ্চাটাকে শেমিং করা। অচেনা অজানা একটা মানুষ এসে তাকে দুনিয়ার জ্ঞান দেয়া শুরু করবে। আর মেহেমান যাওয়ার পর এই বাচ্চাটা মা-বাবার কাছে আরেক ধাপে বকা খাবে যে তোর জন্য আমাদের মানুষের কাছে মুখ থাকেনা।
আচ্ছা এই প্রশ্নের একটা সংখ্যাবাচক উত্তরের আসলে আপনারা ঠিক কি জানতে চান ? এক কথায় উত্তরে এটা মেপে নিতে চান বাচ্চাটা মেধাবী কি অমেধাবী ? আর একটা শিশুকে লজ্জায় ফেলে আপনারা খুব বিকৃত আনন্দ পান তাই না ? বাচ্চাদেরকে রোল নাম্বার জিজ্ঞেস করাও কারো স্যালারি জানতে চাওয়ার মতো একটা ব্যাড ম্যানার।
রোল নাম্বার নিয়ে ছোটবেলার তিক্ত / মধুর অভিজ্ঞতা জানতে ফেসবুকে আর অফলাইনে বেশকিছু মানুষকে প্রশ্ন করেছিলাম। কিছু উল্লেখযোগ্য মন্তব্য দিচ্ছি –
প্রবাসী শিক্ষার্থী 'দিনা ফেরদৌস' বলেন,ভাল স্টুডেন্ট না হওয়ায় পিছনের বেঞ্চিতে বসতাম আমরা বান্ধবীরা। একবার নতুন এক টিচার আসলেন ।তিনি বললেন, ভাল স্টুডেন্ট যেখানেই বসুক সে ভাল, তাই এখন থেকে তারা পিছনে বসবে। আর যারা ভাল না, তারা সামনের বেঞ্চিতে বসবে। পরের দিন সকালে এসে সামনের বেঞ্চিতে স্কুল ব্যাগ রেখে পিটিতে চলে যাই। সেদিন ক্লাস ক্যাপ্টেন পিছনের বেঞ্চিতে বসে জায়গা না পেয়ে। আমাকে সামনের বেঞ্চিতে দেখে ক্লাস টিচার একটু কেমন যেন হলেন। পরে পড়া ধরলেন। উনার মুখের দিকে তাকিয়ে মুখস্ত পড়া ভুলে গেলাম বললেন;পড়া পারো না আবার সামনের বেঞ্চিতে বসছো ,পিছনে যাও। ক্লাস ক্যাপ্টেন কোথায়? ক্যাপ্টেন হাত তোললে,বললেন সামনে এসে বস। সেদিন নিজেকে কঠিন অপমানিত মনে হয়েছিল।
বিতার্কিক জুথী বলেন, আমার স্কুল লাইফে বরবরই রোল নাম্বার ছিল ১।এটাকে একসময় আমি আমার জাতীয় পরিচয় বানিয়ে নিলাম। বাবাকে তখন নিয়মিত চিঠি লিখতাম। চিঠির নিচে লিখতাম-ইতি তোমার প্রিয় মেয়ে;নাদিয়া পারভীন জুথী;ক্লাস সিক্স,রোল- ১।এমনকি খামের উপরেও লিখতাম রোল-১।কেউ যদি নাম জিজ্ঞেস করতো বলতাম- আমার নাম জুথী,রোল- ০১।এই বিষয় গুলা মনে পরলে এখন খুবই হাসি আসে,কি লেইম ছিলাম। কিন্তু ছোট বেলার আবেগ বলে কথা।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সুজন বলেন, ছোট বেলা থেকেই বই পড়তে খুব পছন্দ করতাম। স্কুলের পড়ার অমনযোগী ছিলাম দেখে বাবা আউট বই পড়তে দিতো না। আমাদের বিদায়ের দিন বাংলা স্যার আমাদের ফার্স্ট গার্লকে সঞ্চিতা আর সঞ্চয়িতা গিফট করেছিলেন। আমার মন পরে ছিলো ঐ বই দুটোর দিকে, কিছুদিন পর আমি তাকে জিজ্ঞেস করি তুমি এই বই দুইটা পড়েছ ? তখন মেয়েটা বলে আরে এইসব বোরিং জিনিস কে পড়ে !
তখন মনে হলো টিচাররা শুধু শুরুর দিকে রোল নাম্বার দের দিকেই খেয়াল করেন,হয়তো এমন কোন ব্যাক বেঞ্চার ছিল যে বইগুলোর মূল্য বুঝতে, কিন্তু টিচারের সময় কই তাদের দিকে খেয়াল করার।
একজন বলল তার বাবার বদলির চাকরির জন্য তার অনেক স্কুল বদলাতে হয়েছে এবং সে কারণে বেশিরভাগ সময়ই রোল নাম্বার পেছনে সারিতে ছিল। তাই দূরের অনেকে যখন রোল নাম্বার নিয়ে প্রশ্ন করত তখন তাকে ভুলভাবে জাজ করত।
ঢাকা বিস্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রনি বলেন, বেশিভাগ ক্লাসেই ক্লাস ক্যাপ্টেন ছিলাম। তখন আমার সাথে সেধে সেধে সবাই মিশতে চাইতো কারন ওদের মা বাবা বলে দিতো যেন রোল একের সাথে বন্ধুত্ব করে আর খারাপ ছাত্রদের সাথে না মেশে। তখন আমার ভাবই ছিলো আলাদা । যাদের সাথে আমার বনিবনা হতো না তাদের নামে টিচারের কাছে বিচার দিয়ে মার খাওয়াতাম আর আমার বন্ধুরা দুষ্টুমি করলেও টিচারকে বলতাম না। এখন এগুলো ভাবলে খুব হাসি পায়। এখন বুঝি ভাল ছাত্র হলেই যে ভাল লিডারশিপ কোয়ালিটি থাকবে এমনটা ভাবা আসলে ঠিক না।
শাহীন কলেজের জয়া বলেন, বেশ কিছু স্কুল পরিবর্তলে এটা বুঝেছি রোল নাম্বারের মান স্কুল টু স্কুল ভ্যারি করে। অনেক ভালো স্কুলের রোল পঞ্চাশ রোলও কিছু কিছু ইস্কুলের পাঁচ রোলের থেকে বেশি মেধাবী।
বিভিন্ন মানুষের অভিজ্ঞতা শুনতে শুনতে মনে হলো দেশের বাইরে কি অবস্থা একটু জেনে নেই। অবাক করা
বিষয় হলো বিশ্বের সিংহভাগ দেশেই এই বাচ্চাদের রোল নাম্বার দিয়ে লেবেলিং সিস্টেমটা নাই। কথা হয় দুবাই, জার্মান, ফ্রান্স, লন্ডন, আমেরিকা, দার্জিলিং এবং মালয়েশিয়ার স্কুলে পড়েছে এবং ওখানকার ইস্কুলে বাচ্চা পড়ে কথা এমন কিছু মায়েদের সঙ্গে। তারা সবাই জানায় যে তাদের রোল নাম্বার সিস্টেম ছিল না এবং নেই। রেজাল্ট শুধু ঐ স্টুডেন্ট, প্যারেন্টস আর টিচার জানে। বাচ্চাদের মূলত নাম ধরে ডাকা হয় আমেরিকায় মূলত লাস্ট নেম ধরে ডাকে। আমি বললাম তাহলে এটেন্ডেন্স নেয় কিভাবে, তারা বলে কোন ক্লাসেই বিশ জনের উপরে শিক্ষার্থী নেই , টিচার সবাইকে চেনে তাই সেভাবেই এটেন্ডেনস নিয়ে নেয়। দুবাই, জার্মানী আর ফ্রান্সের স্কুল শিক্ষার্থী জানায় হলে তাদের নাম একফাবেটিকালি সিরিয়ালকরে ডাকা হয়।
লন্ডনের স্কুল শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানান ওখানকার স্কুলে রোল নাম্বারের লেবেলিং নেই তবে মেধা অনুযায়ী গ্রুপে বিভক্ত করা হয় প্রয়োজনীয় কেয়ার দেয়ার সুবিধার জন্য।
ইন্ডিয়ায় দিল্লী আর দার্জেলিং বোর্ডিং স্কুলে পড়েছে আমার দুই বন্ধু বলে তাদেরো রেজান্ট অনুযায়ী রোল হতো না। ইন্ডিয়ার মর্ডান স্কুল গুলোতে এই সিস্টেম নেই। তবে পুরানো অনেক স্কুলে এখনো এই সিস্টেম রয়েছে।
তখন মনে হলো বাংলাদেশী ইংলিশ মিডিয়াম গুলোতো বিদেশি কারিকুলাম ফলো করে দেখি ওদের অবস্থা কি। দীর্ঘদিন স্কলাস্টিকায় কর্মরত বর্তমানে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে অবস্থিত ‘আশরাফুন্নাহার’কে আপনাদের স্কুলে রোল নাম্বার ডাকার সিস্টেম আছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই তিনি উত্তর দেন না কোন ক্লাসেই নেই । উনাদের স্কুলের সবাইকে নাম ধরে ডাকা হয় রোল নাম্বার এর কারণে বাচ্চাদের মধ্যে ইনফিউরিটি কমপ্লেক্স এবং সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স তৈরি হয় এবং বাচ্চারা এনিয়ে প্রেসারে থাকে এবং তার মধ্যেও একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাই তাদের এখানে রোল নাম্বার এর সিস্টেম নাই।
বর্তমানে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে কর্মরত এবং পূর্বেও আরেকটি ইংলিশ মিডিয়ামে শিক্ষকতা করেছেন ‘শেখ নাজিয়া’ কে একই প্রশ্ন করলে তিনি বলেন যে তাদের স্কুলে বাচ্চাদের ভর্তি অনুযায়ী বা স্কুলের শাখা অনুযায়ী আইডি নাম্বার থাকে কিন্তু কোন রোল নাম্বার থাকেনা। ফাস্ট সেকেন্ড থার্ডর হয়না বাচ্চারা ভালো রেজাল্ট ও আরো বিভিন্ন গুণাবলীর জন্য বাৎসরিক পুরস্কার পেয়ে থাকে। রেজাল্ট শুধু ঐ স্টুডেন্ট, প্যারেন্টস আর টিচার জানে। মেরিট পজিশন সবাইকে ঢোল পিটিয়ে জানানো হয় না।
কথা হয় আরো কয়েকজন ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থী ও শিক্ষিকাদের সাথে।কিছু কিছু স্কুলে রোল আছে তা রেজাল্টের ভিত্তিতে না, আর বেশ কিছু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ট্রেডিশনাল ওয়েতে রেজাল্ট অনউযায়ী রোল দিয়ে রেজাল্ট পাব্লিশ করে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অনেক ঘাটতি রয়েছে সে আলাপ নাহয় পরে একদিন হবে। সরকারের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে চেষ্টার কোন ত্রুটি নেই। কিন্তু আমরা যতই নতুন নতুন পদক্ষেপ নেইনা কেন আমরা কিন্তু আমাদের শিশুদের ওপর থেকে বোঝা কমাতে পারছিনা। স্কুলটা আনন্দের করতে পারছিনা। আচ্ছা আমরা কি পারিনা এই রোল নাম্বার নামক লেবেলিং থেকে আমাদের শিশুদেরকে মুক্ত করতে। এর জন্য তা আলাদা করে বাজেটে বাজেট করতে হচ্ছে না বা কোনো টাকা-পয়সা খরচ হচ্ছে না। একটা শিশু তার সম্ভাবনাগুলো জানার আগেই আমরা ঘোষণা করে দিলাম তুমি অমেধাবী? কুড়ি থেকে ফুল হয়ে ফোটার আগেই সে হীনমন্যতা নিয়ে চুপসে যাবে এটা হতে পারে না।
আমাদের স্কুল গুলোতে যেহেতু অনেক শিক্ষার্থী তাই ভর্তির রোল অথবা এলফাবেটিকালি এটেন্ডেন্স নেয়া যেতে পারে। প্রতি বছর ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড থাকুক সেই সাথে বাচ্চারা সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিভিন্ন ভালো কাজ করার জন্য পুরস্কার পাক। অন্তত প্রাইমারি স্কুলে রোল নাম্বার নামক সিল তাদের কপাল থেকে মুছে যাক। শিশুরা গেয়ে উঠুক আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১২:১৪