নিশ্চয়ই বিদ্যানন্দ ভালো কাজ করছে। ভালো কাজে নিয়োজিত প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু কোন প্রতিষ্ঠান তাদের ভালো কাজগুলোর কারণে তাদের ভুল কাজের দায় থেকে মুক্তি পেতে পারে না। ভুল নিয়ে চলার চেয়ে সংশোধনই কাম্য।
দেখুন, আপনি আমার এই পোস্টটি পড়ার পূর্বেই জেনে রাখুন, আমি বিদ্যানন্দের বিরোধী কেউ নয়। আমি ধর্মান্ধদের দলেও নয়। আমি তো কেবল বিদ্যানন্দের চোখে দেখা যাকাতকে মুসলিমদের চোখে যেভাবে রয়েছে সেভাবেই তুলে ধরছি।
আমি আমার এই লেখায় খুব সংক্ষেপে যাকাত ও দানের পার্থক্য এবং যাকাত কাদেরকে দেওয়া যাবে ও কাদেরকে দেওয়া যাবে না সে বিষয়ে লিখবো; যার রেফারেন্স নিম্নে দেওয়া থাকবে। এই বিষয়ে এটাই যে প্রথম লেখা তা নয়। ইতিপূর্বে এ বিষয়ে অনেক লেখাই প্রকাশ পেয়েছে।
দয়া করে, লেখাটি না পড়ে মন্তব্য করবেন না। আমি এখানে কোন মতবাদের পক্ষে বা বিপক্ষে লিখতে আসিনি। আমি কেবল আমার আপনজনদেরকে তাদের ভুলে যাওয়া বিষয়গুলো স্মরণ করিয়ে দিতে চাচ্ছি। যাই হোক, সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা শুরু করা যাক।
প্রথমত আমাদের জানতে হবে, যাকাত কী? যাকাত হচ্ছে মুসলিমদের আবশ্যক পালনীয় বিধানগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। যে সম্পর্কে মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআনে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে,
وَ اَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوةَ ؕ وَ مَا تُقَدِّمُوْا لِاَنْفُسِكُمْ مِّنْ خَیْرٍ تَجِدُوْهُ عِنْدَ اللّٰهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِیْرٌ۱۱۰
তোমরা সালাত আদায় কর এবং যাকাত প্রদান কর। তোমরা যে উত্তম কাজ নিজেদের জন্য অগ্রে প্রেরণ করবে তা আল্লাহর নিকটে পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখছেন। -সূরা বাকারা : ১১০
وَ الْمُقِیْمِیْنَ الصَّلٰوةَ وَ الْمُؤْتُوْنَ الزَّكٰوةَ وَ الْمُؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ ؕ اُولٰٓىِٕكَ سَنُؤْتِیْهِمْ اَجْرًا عَظِیْمًا۠۱۶۲
‘এবং যারা সালাত আদায় করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে আমি তাদেরকে মহাপুরস্কার দিব।’ সূরা নিসার ১৬২ নং আয়াত।
আরো জানতে পড়ুন→
উপরের দু'টি আয়াত থেকে যাকাতের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা এবং এর সুফল ও উপকারিতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেল।
নেসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়ার পরও যারা যাকাত আদায় করে না, তারা যাকাতের সকল সুফল থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি আল্লাহর আদেশ অমান্য করার কারণে যে মর্মন্তুদ শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে তা-ও কুরআন মজীদে বলে দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
وَ لَا یَحْسَبَنَّ الَّذِیْنَ یَبْخَلُوْنَ بِمَاۤ اٰتٰىهُمُ اللّٰهُ مِنْ فَضْلِهٖ هُوَ خَیْرًا لَّهُمْ ؕ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ ؕ سَیُطَوَّقُوْنَ مَا بَخِلُوْا بِهٖ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ ؕ وَ لِلّٰهِ مِیْرَاثُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ ؕ وَ اللّٰهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِیْرٌ۠۱۸۰
আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তোমাদেরকে দিয়েছেন তাতে যারা কৃপণতা করে তারা যেন কিছুতেই মনে না করে যে, এটা তাদের জন্য মঙ্গল। না, এটা তাদের জন্য অমঙ্গল। যে সম্পদে তারা কৃপণতা করেছে কিয়ামতের দিন তা-ই তাদের গলায় বেড়ি হবে। আসমান ও যমীনের স্বত্ত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহরই। তোমরা যা কর আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবগত। -সূরা আলইমরান : ১৮০
হাদীস শরীফে এসেছে- ‘যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু সে তার যাকাত দেয়নি কিয়ামতের দিন তা বিষধর স্বর্পরূপে উপস্থিত হবে এবং তা তার গলায় পেঁচিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার উভয় অধরপ্রান্তে দংশন করবে এবং বলবে, আমিই তোমার ঐ ধন, আমিই তোমরা পুঞ্জিভূত সম্পদ।’ -সহীহ বুখারী
এই আয়াতটি দেখুন, বলা হয়েছে
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تُبْطِلُوْا صَدَقٰتِكُمْ بِالْمَنِّ وَ الْاَذٰی ۙ كَالَّذِیْ یُنْفِقُ مَالَهٗ رِئَآءَ النَّاسِ وَ لَا یُؤْمِنُ بِاللّٰهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ ؕ
‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা অনুগ্রহ ফলিয়ে ও কষ্ট দিয়ে তোমাদের দান-সদকাকে বিনষ্ট করো না। ওই লোকের মতো যে লোক দেখানোর জন্য সম্পদ ব্যয় করে আর ঈমান রাখে না আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের উপর।-সূরা বাকারা : ২৬৪
এখানে পরিস্কারভাবে বলা হয়েছে, যাদের উপর যাকাত ফরজ হয়েছে তারা তা যেন অনুগ্রহ কিংবা কষ্ট দেয়া বা লোক দেখানোর জন্য যাকাত আদায়ের চেষ্টা না করেন। আর বলা হয়েছে, যাকাত আদায় করার জন্য মুসলিম হওয়া শর্ত।
দ্বিতীয় আমরা জানি, মুসলিমরা তাদের ধর্মের সৃষ্টি থেকে নিয়েই দান খয়রাতে যথেষ্ট আগ্রহী। দানের বিষয়ে তাদের ধর্মগ্রন্থ আল কুরআনে বলা হয়েছে,
وَ لَا تَجْعَلْ یَدَكَ مَغْلُوْلَةً اِلٰی عُنُقِكَ وَ لَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُوْمًا مَّحْسُوْرًا.
(দান না করে) তুমি তোমার হাতকে গলায় আটকে রেখো না, আবার তা সম্পূর্ণরূপে বিছিয়েও দিয়ো না। অন্যথায় তুমি তিরস্কৃত ও নিঃস্ব হয়ে পড়বে। -সূরা ইসরা (১৭) : ২৯
হাদিসে এসেছে,
رَجُلٌ تَصَدّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ.
এমন ব্যক্তি, যে এতটাই গোপনে দান করে, তার ডান হাতের দান বাম হাতও জানতে পারে না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪২৩
অন্য হাদিসে বলা হয়েছে,
جَهْدُ الْمُقِلِّ وَابْدَأْ بِمَنْ تَعُولُ.
অর্থসম্পদ যার কম, যে অসচ্ছল, কষ্ট করে সে যা দান করে (সেটাই সর্বোত্তম সদকা)। আর তুমি তোমার অধীনস্তদের দিয়ে শুরু করো। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৬৭৯
তৃতীয়ত, যাকাত অস্বীকার করার কারণে যেরকম শাস্তির বিধান পবিত্র কুরআনে রয়েছে, দান না করার কারণে সেরকম কোন বিধান নেই। যার কারণে স্পষ্ট হয়, দান এবং যাকাত সমান নয়।
আমাদের অনেক ব্লগার ভাইয়েরা, দান এবং যকাতের পার্থক্য বুঝেও না বুঝার ভান করেন যা খুবই লজ্জার।
চতুর্থত যাকাত পাওয়ার হকদার কে। এই বিষয় নিয়েই আমরা অধিক প্যাচালগ্রস্থ। যাই হোক, এই বিষয়ে বিস্তারিত এভাবে বলা হয়েছে যে,
যাকাত শুধু মুসলমানদেরকেই দেওয়া যাবে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান বা অন্য কোনো অমুসলিমকে যাকাত দেওয়া হলে যাকাত আদায় হবে না। তবে নফল দান-খায়রাত অমুসলিমকেও করা যায়। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭১৬৬,৭১৬৭, ৭১৭০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৫১৬-৫১৭
যাকাতের টাকা যাকাতের হক্বদারদের নিকট পৌঁছে দিতে হবে। যাকাতের নির্ধারিত খাতে ব্যয় না করে অন্য কোনো জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হলে যাকাত আদায় হবে না। যেমন রাস্তা-ঘাট, পুল নির্মাণ করা, কুপ খনন করা, বিদ্যুত-পানি ইত্যাদির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
যাকাতের টাকা দ্বারা মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করা, ইসলাম প্রচার, ইমাম-মুয়াজ্জিনের বেতন-ভাতা দেওয়া, ওয়াজ মাহফিল করা, দ্বীনি বই-পুস্তক ছাপানো, ইসলামী মিডিয়া তথা রেডিও, টিভির চ্যানেল করা ইত্যাদিও জায়েয নয়।
মোটকথা, যাকাতের টাকা এর হক্বদারকেই দিতে হবে। অন্য কোনো ভালো খাতে ব্যয় করলেও যাকাত আদায় হবে না।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৬৯৪৭,৬৯৪৮, ৭১৩৭,৭১৭০
দান যে কাউকে দেওয়া যায়। কিন্তু যাকাত যে কাউকে দেওয়া যায় না। দান আপনি আপনার বিধর্মী ভাইকে করতে পারেন। কিন্তু যাকাত নয়।
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হলো যে, বিদ্যানন্দ বা বিদ্যানন্দের মতো মহৎকাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দান খয়রাতের পুরো অংশই দেওয়া যাবে। তবে যাকাত আদায়ের উদ্দেশ্যে কেউ এরকম প্রতিষ্ঠানে কোন কিছু দিতে চাইলে তার যাকাত আদায় হবে না।
ছবি: ইন্টারনেট
তথ্যসূত্রঃ মাসিক আল কাউসার
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০২৩ সকাল ১০:১৩