মাওলানা ইলিয়াছ সাহেবের ‘মালফুজাত’সহ আরো কিছু কিতাবে লিখিত আছে যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত অনন্য ধর্মীয় ত্বরীকা, যা সকল দ্বীনি আন্দোলনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত, যার থেকে ভাল ত্বরীকা আর হতে পারেনা।
(হযরতজীর মালফুজাত-২৯, পৃষ্ঠা-২২; তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব, পৃষ্ঠা-৮৫; দাওয়াতে তাবলীগ কি এবং কে?, পৃষ্ঠা-৪৯, লেখক- ওবায়দুল হক; তাবলীগ জামায়াতের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৫৬, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-২৯, লেখক- মৌলুবী মুঃ ইব্রাহিম)
----------------------------------------------------------------------------------
তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই মিথ্যা, বানোয়াট ও বিভ্রান্তিকর, কেননা প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতে যে দ্বীনি তা’লিম দেয়া হয়, তা পরিপূর্ণ দ্বীনি তা’লিম হতে নিতান্তই কম এবং সেটাকেই তারা পরিপূর্ণ ও যথেষ্ট মনে করে থাকে। অথচ দ্বীন ইসলাম ও তার শিক্ষা অত্যন্ত ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ। যেমন- পরিপূর্ণ দ্বীনি শিক্ষার বিষয় উল্লেখপূর্বক আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
“মু’মিনদের প্রতি আল্লাহ পাক-এর ইহ্সান, তাদের মধ্য থেকে তাদের জন্য একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, তিনি কিতাব শিক্ষা দিবেন, হিকমত শিক্ষা দিবেন ও তাদেরকে তাযকিয়া (পরিশুদ্ধ) করবেন। যদিও তারা পূর্বে হিদায়েতপ্রাপ্ত ছিলনা।” (সূরা আল ইমরান ১৬৪)
এ আয়াত শরীফে, আয়াত শরীফ তিলাওয়াত করে শুনানো, কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে ইল্মে জাহির বা ইল্মে ফিক্বাহ-এর অন্তর্ভূক্ত, যা দ্বীনের যাবতীয় হুকুম-আহ্কাম পালন করার জন্য ও দৈনন্দিন জীবন-যাপনের জন্য প্রয়োজন। আর (তাযকিয়া) পরিশুদ্ধ ও সংশোধন করার দ্বারা ইল্মে বাতিন বা ইল্মে তাছাউফ উদ্দেশ্য, যার মাধ্যমে মানুষের ক্বাল্ব বা আভ্যন্তরীণ দিক শুদ্ধ হয়। অনূরূপ সূরা বাক্বারা-এর ২৯ ও ১৫১তম আয়াত শরীফে এবং সূরা জুমুয়া-এর ২য় আয়াত শরীফে উপরোক্ত আয়াত শরীফের সমার্থবোধক আরো ৩খানা আয়াত শরীফ উল্লেখ আছে। (তাফসীরে মায্হারী, রুহুল বয়ান, ফতহুল ক্বাদীর, খাযিন, বাগবী, কুরতুবী, ইবনে কাছীর, কবীর, দুররে মানছূর, আবী সউদ, রুহুল মায়ানী, তাবারী, মায়ারিফুল কুরআন ইত্যাদি)
মূলতঃ এ ক্বাল্ব বা অন্তর পরিশুদ্ধ করার শিক্ষাই হচ্ছে মূল শিক্ষা। কেননা ক্বাল্ব শুদ্ধ না হলে মানুষের কোন ইবাদত-বন্দেগী, ধন-সম্পদ, প্রতিপত্তি আল্লাহ পাক-এর নিকট কবুলযোগ্য হয় না। ফলে সে পরকালে কোন ফায়দা বা উপকারও হাছিল করতে পারবেনা।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক বলেন,
“ক্বিয়ামতের দিন কেউ তার ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা ফায়দা বা উপকার হাছিল করতে পারবেনা। একমাত্র ঐ ব্যক্তি ব্যতীত, যে প্রশান্ত বা পরিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে উপস্থিত হবে।” (সূরা শুয়ারা ৮৮-৮৯)
আর অন্তর বা ক্বাল্ব প্রশান্ত ও পরিশুদ্ধ হয় একমাত্র আল্লাহ পাক-এর যিকিরের মাধ্যমে। আল্লাহ পাক বলেন,
“সাবধান! আল্লাহ পাক-এর যিকিরের দ্বারাই অন্তর প্রশান্তি লাভ করে।” (সূরা র’দ ২৮)
হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে,
“নিশ্চয়ই (মানুষের) শরীরে এক টুকরা গোশ্ত রয়েছে। সেটা যদি পরিশুদ্ধ হয়, তবে গোটা শরীরই পরিশুদ্ধ হয়ে যায়। আর সেটা যদি বরবাদ হয়ে যায়, তবে গোটা শরীরই বরবাদ হয়ে যায়। সাবধান! সেই টুকরা গোশ্তের টুকরাটির নাম হচ্ছে ক্বাল্ব বা অন্তর।” (বুখারী শরীফ)
অর্থাৎ ক্বাল্ব শুদ্ধ হলে মানুষের ঈমান-আক্বীদা, আমল-আখলাক্ব, সীরত-ছূরত সবকিছু শুদ্ধ হয়ে যায়। আর ক্বাল্ব অশুদ্ধ বা বরবাদ হলে সবকিছুই বরবাদ হয়ে যায়। মূলতঃ তখন বান্দার কোন কিছুই আল্লাহ পাক কবুল করেন না।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, অনন্য, শ্রেষ্ঠ, সম্মানিত ও কামিয়াব তারাই, যাঁরা ইল্মে ফিক্বাহ-এর সাথে সাথে ইল্মে তাছাউফ চর্চা করার মাধ্যমে নিজেদের ক্বাল্ব বা অন্তর ইছ্লাহ্ বা পরিশুদ্ধ করেছেন।
তাহলে ক্বাল্ব শুদ্ধকরণ ইল্ম বা ইল্মে তাছাউফ ব্যতীত শুধুমাত্র যৎসামান্য ইল্মে ফিক্বাহ শিক্ষা করে কিভাবে দাবী করতে পারে যে, “প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত অনন্য ধর্মীয় ত্বরীকা, যা সকল দ্বীনি আন্দোলনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত, যার থেকে ভাল ত্বরীকা আর হতে পারেনা।” মূলতঃ তাদের এই দাবী সম্পূর্ণ মিথ্যা, কল্পনা প্রসূত এবং কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের খিলাফ।
অপর পক্ষে শুদ্ধ ও সঠিক দাবী হলো তাদের, যারা উভয় প্রকার ইল্ম তথা ইল্মে ফিক্বাহ ও ইল্মে তাছাউফ-এর যথার্থ ও পরিপূর্ণ শিক্ষা অর্জনপূর্বক দ্বীনের তা’লীম-তালক্বীন ও তাবলীগের কাজে নিয়োজিত। এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে,
“ইল্ম দু’প্রকার, একটি হচ্ছে- ক্বালবী ইল্ম (ইল্মে তাছাউফ), যা উপকারী ইল্ম। অপরটি হচ্ছে- জবানি ইল্ম (ইল্মে ফিক্বাহ), যা আল্লাহ পাক-এর তরফ থেকে বান্দার প্রতি দলীল স্বরূপ।” (দারেমী, মিশকাত, আশয়াতুল লুময়াত)
এ হাদীস শরীফের ব্যাখ্যায় মালেকী মাযহাবের ইমাম, ইমামুর দাহ্র, ফখরুদ্দীন, শায়খুল মাশায়িখ, রহ্নুমায়ে শরীয়ত ওয়াত্ব তরীক্বত, ইমামুল আইম্মা, হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
“যে ব্যক্তি ইল্মে ফিক্বাহ শিক্ষা করলো, কিন্তু ইল্মে তাছাউফ শিক্ষা করলো না, সে ব্যক্তি ফাসেকের অন্তর্ভূক্ত। আর যে তাছাউফ করে অর্থাৎ মা’রিফাত চর্চা করে অথচ ইল্মে ফিক্বাহ শিক্ষা করে না অর্থাৎ শরীয়ত মানে না বা অস্বীকার করে, সে যিন্দিক বা কাফিরের অন্তর্ভূক্ত। আর যে উভয়টাই শিক্ষা করলো, সেই মুহাক্কিক অর্থাৎ সেই আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের ওয়ারিছ বা হক্কানী আলিম।” (মিরকাত)
সুতরাং প্রচলিত ৬ উছূলভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত সম্পূর্ণ তাছাউফ শুন্য হয়ে শুধুমাত্র যৎসামান্য ইল্মে ফিক্বাহ শিক্ষা করে কিভাবে দাবী করতে পারে যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতই শ্রেষ্ঠ, সম্মানিত ও অনন্য ধর্মীয় ত্বরীকা? মূলতঃ তাদের এ দাবী সম্পূর্ণই অবান্তর ও কল্পনা প্রসূত।
প্রকৃতপক্ষে ইল্মে ফিক্বাহ ও ইল্মে তাছাউফ সমন্বিত শিক্ষাই হচ্ছে- অনন্য, শ্রেষ্ঠ ও পরিপূর্ণ শিক্ষা, যা হক্কানী-রব্বানী আলিমগণ শিক্ষা দিয়ে থাকেন। কাজেই একমাত্র হক্কানী-রব্বানী পীরানে তরীক্বত, আউলিয়া-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিগণের দরবারেই পূর্ণ ইসলাম বা ইসলামী শিক্ষা হাছিল করা সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে অবিস্মরণীয় আলিম, মহা দার্শনিক, প্রখ্যাত ইমাম ও পঞ্চম হিজরী শতকের মুজাদ্দিদ, হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি, যাঁর ইল্মের তীব্রতা এত বেশী ছিল যে, সে তেজোচ্ছাটায় সবাই তটস্থ থাকতো। যাঁর সমঝের ব্যাপকতা ও ক্ষুরধার যুক্তি উপস্থাপনার এত দক্ষতা ছিল, যে কারণে সারাজীবনে সকলেই তাঁর কাছে বাহাছে পরাজিত হয়েছে। অপরদিকে যিনি এত অল্প সময়ে তৎকালীন বিশ্ববিখ্যাত ও সমাদৃত বাগদাদের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ পদ অলংকৃত করেছিলেন, তাঁর পূর্বে ও পরে কেউ এত অল্প বয়সে উক্ত পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেননি এবং এক কথায় এতসব গুণের অধিকারী হওয়ার উছিলায় যাঁর দ্বারা তৎকালে ইসলাম ছেড়ে প্রায় সর্বোতভাবে গ্রীক দর্শণের দিকে ঝুঁকে পড়া মুসলমানদেরকে যিনি সারগর্ভ হিদায়েতের বাণী শুনিয়ে ইসলামের দিকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়ে “হুজ্জাতুল ইসলাম” (অর্থাৎ ইসলামকে পূনজ্জীবিতকারী) লক্বব বা উপাধী দ্বারা অদ্যাবধি সমগ্র বিশ্বে বিশেষভাবে সম্মানিত। সে মহান পুরুষের ইল্মে তাছাউফের তাৎপর্য উপলব্ধি ও তার গুরুত্ব অনুধাবনের ঘটনাটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য, যা তিনি নিজেই যথার্থভাবে প্রকাশ করেছেন তাঁর প্রখ্যাত “আল মুনকেযু মিনাদ্দালাল” (বাংলায় “ভ্রান্তির অপনোদন”) কিতাবে।
উল্লেখ রয়েছে, তিনি প্রথমে ইল্মে কালাম বা মুতাকাল্লিমদের বিষয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। সে বিষয়ে ব্যাপক পর্যালোচনার দ্বারা তার গুঢ়মর্ম উপলব্ধিতে সক্ষম হন এবং তাকে তিনি অপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেন। অতঃপর তিনি দর্শণের মনযোগী হন এবং অল্প সময়েই (দু’বছরেই) পরিপূর্ণভাবে দর্শণশাস্ত্র আয়ত্ত করেন। আর এরপরেও এক বছর ধরে তিনি অর্জিত জ্ঞানের বিশেষ উপলব্ধি দ্বারা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখতে পান যে, দর্শণের অনেকটাই প্রবঞ্চনাপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর। তাই দর্শণও তাঁকে আশ্বস্ত করলোনা। আর এরপরে তিনি তা’লিমী শিয়া সম্প্রদায়ের বাতেনী মতবাদ নিয়ে গবেষণা করেন। কিন্তু এ সম্প্রদায়ের স্থানে অস্থানে বাতেনী ইমামের বরাত তাঁকে এ সম্প্রদায়ের প্রতি বিতঃশ্রুদ্ধ করে তোলে। এমনিতর অবস্থায় তিনি এক সময় হাজির হন তাঁর ভাই হযরত আহ্মদ গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর এক মাহফিলে এবং সেখানে হযরত আহ্মদ গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি পরিবেশিত একটি কাছীদা শুনে তাঁর ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়। কাছীদাটির ভাবার্থ ছিল এরূপ-
“আর কতকাল জাহিরী ইল্মের বড়াই ধরে রাখবে? অন্তরের কলুষতা হিংসা, রিয়া, ফখর থেকে কবে আর মুক্ত হবে?”
অন্তরের অস্থিরতার এ সময়ে তাঁর মানসপটে ভেসে উঠে দু’টি স্মৃতি, যা সংঘটিত হতো বাদশাহর দরবারে। একটি হলো- যখন ইমামুল হারামাইন রহমতুল্লাহি আলাইহি (যিনি বিশ্ববিখ্যাত আলিম এবং তৎকালীন সকল উলামাদের শ্রদ্ধেয় ইমাম ও হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ওস্তাদ) বাদশাহর দরবারে যেতেন তখনকার স্মৃতি। অপরটি হলো- বাদশাহর দরবারে অপর একজন সূফী ও শায়খ, আবূ আলী ফারমুদী রহমতুল্লাহি আলাইহি (যিনি ছিলেন তৎকালে আল্লাহ পাক-এর লক্ষ্যস্থল) যখন হাজির হতেন তখনকার স্মৃতি। প্রথম ক্ষেত্রে হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি যখন তাঁর ওস্তাদের সাথে বাদশাহর দরবারে তাশ্রীফ রাখতেন, তখন বাহশাহ্ ইমামুল হারামাইন রহমতুল্লাহি আলাইহিকে তা’যীম করে স্বীয় সিংহাসনের পাশে অন্য আসনে বসাতেন। অন্যদিকে যখন শায়খ আবূ আলী ফারমুদী রহমতুল্লাহি আলাইহি বাদশাহর দরবারে তাশ্রীফ রাখতেন, তখন বাহশাহ্ তাঁকে অধিকতর তা’যীম-তাক্রীম করে নিজ সিংহাসনে বসাতেন এবং বাহশাহ্ স্বয়ং নীচে বসতেন।
এ ঘটনার স্মৃতি হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে এবং তাঁকে সূফী সম্প্রদায়ের প্রতি অনুপ্রণিত করে তোলে। সূফীতত্ত্ব বা ইল্মে তাছাউফ-এর দিকে মনযোগ দিয়েই তিনি বুঝতে পারেন যে, পূর্ণাঙ্গ সূফী তরীক্বার মধ্যেই রয়েছে বুদ্ধিবৃত্তির (ইল্মী আক্বীদা) এবং ব্যবহারিক কার্যক্রম (আমল ও রিয়াযত)-এর সমন্বয়। তিনি বলেন, “আমলের চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তির আক্বীদা ও বিশ্বাস আমার কাছে অনেক সহজ মনে হচ্ছে।” তবে তিনি উল্লেখ করেন, “সূফীবাদের যে দিকটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা কেবল পড়াশুনা বা অন্যকিছু দ্বারা সম্ভব নয় বরং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা (জওক বা স্বাদ) তন্ময় সাধনা এবং নৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই তা অর্জন করা সম্ভব।” তিনি উদাহরণ পেশ করেন, “স্বাস্থ্য ও স্বস্তির সংজ্ঞা জানা এবং এগুলোর কারণ নির্ধারণ করা, আর স্বাস্থ্য ও স্বস্তি লাভের মধ্যে বড় প্রভেদ।”
তিনি উল্লেখ করেন, “আমি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারলাম, সূফীগণ কথায় মানুষ নন, তাঁদের প্রকৃত অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং পড়াশুনার মাধ্যমে যতটা অগ্রসর হওয়া সম্ভব তা আমি করেছি। এখন আমার বাকী রয়েছে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বা আস্বাদন এবং তাছাউফ সাধনের পথ প্রত্যক্ষভাবে অতিক্রমের দ্বারাই তা লাভ করা যেতে পারে।”
উল্লেখ্য, এরপরে তাছাউফ শিক্ষার পিছনে বা সূফী হওয়ার বাসনায় তিনি দীর্ঘ ১০ বছর কাটিয়ে দেন এবং ইল্মে তাছাউফ বা সূফীদের সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেন, সে সম্পর্কে বলেন, “আমি নিশ্চতভাবে বুঝতে পেরেছি যে, কেবল সূফীরাই আল্লাহ পাকের পথের পথিক। তাঁদের জীবনই হলো সর্বোত্তম জীবন, তাঁদের তরীক্বাই নিখুঁত তরীক্বা, তাঁদের চরিত্রই সুন্দরতম চরিত্র। বুদ্ধিজীবিদের সকল বুদ্ধি, জ্ঞানীদের সকল জ্ঞান এবং পন্ডিতদের সকল পান্ডিত্য, যাঁরা খোদায়ী সত্যের প্রগাঢ়তা সম্পর্কে দক্ষ, তাদের সকলের জ্ঞান-বুদ্ধি একত্র করলেও তা দিয়ে সূফীদের জীবন এবং চরিত্র উন্নততর করা যাবেনা বা সম্ভব নয়। সূফীদের অন্তরের বা বাইরের সকল গতি এবং স্থৈর্য নুবুওওয়াতের নূরের জ্যোতি দ্বারা উদ্ভাসিত, নুবুওওয়াতের জ্যোতি ছাড়া ধরার বুকে অন্য কোন আলো নেই, যা থেকে জ্যোতির ধারা পাওয়া যেতে পারে।”
তিনি লিখেন, “সূফী তরীক্বার প্রথম স্তর থেকেই শুরু হয় ইলহাম ও দীদার (দর্শন)। সূফীগণ এ সময়ে জাগ্রত অবস্থায় ফিরিস্তা এবং আম্বিয়া আলাইহিছ ছলাতু ওয়াস সালামগণের রূহ মুবারকের দর্শন লাভ করেন। শুনতে পান তাঁদের বাণী এবং নির্দেশ। অতঃপর তাঁরা আরো উচ্চস্তরে উপনীত হন। আকার ও প্রতীকের উর্দ্ধে এমন এক পরিমন্ডলে তাঁরা পৌঁছে যান, ভাষায় যার বর্ণনা দান সম্ভব নয়।”
তিনি লিখেন, “যারা সূফীদের মাহ্ফিলে বসে, তারা তাঁদের নিকট থেকে বিশেষ ধরণের রূহানিয়াত হাছিল করে।”
তিনি সূফীদের এই বিশেষ মর্তবা সম্পর্কে কুরআন শরীফের আয়াত শরীফ পেশ করেন,
“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে ইল্ম (ইল্মে তাছাউফ) দেয়া হয়েছে, আল্লাহ পাক তাদের সম্মান ও মর্যাদাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিবেন।” (সূরা মুজাদালাহ ১১)
আর যারা সূফীদের বিরোধিতা করে অথবা তা থেকে গাফিল থাকে, তাদেরকে তিনি নেহায়েত অজ্ঞ বলে মন্তব্য করেন এবং তাদের প্রতি কুরআন শরীফের এই আয়াত শরীফ প্রযোজ্য বলে মন্তব্য করেন,
“তাদের মধ্যে কেউ কেউ আপনার কথা শুনতে আসে, অতঃপর আপনার নিকট থেকে বের হবার পর যারা জ্ঞান লাভে সমর্থ হয়েছে তাদের জিজ্ঞেস করে এই ব্যক্তি এখন কি বললো? ওরা ঐসব লোক, যাদের হৃদয়ে আল্লাহ তায়ালা সীলমোহর মেরে দিয়েছেন। এরা তাদের প্রবৃত্তির দাসত্ব করে যাচ্ছে। অর্থাৎ তারা মুক, বধির এবং অন্ধ হয়ে গেছে।” (সূরা মুহম্মদ ১৬)
হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি এই মন্তব্য করেন যে, “দ্বীনের সকল পথের পথিকদের মধ্যে একমাত্র সূফীরাই পরিপূর্ণ।” তিনি উদাহরণ দেন, “জাহিরী ইল্ম হলো খোসা মাত্র। আর সূফীতত্ত্ব অথবা ইল্মে তাছাউফ হলো তার অভ্যন্তরীস্থিত শাঁস বা মূল বস্তুর ন্যায়।” তাই তিনি আরো মন্তব্য করেন যে, “যদি কিছু থেকে থাকে, তবে সূফীগণের কাছেই তা রয়েছে।”
উল্লেখ্য, তাই তিনি সূফীগণের সোহ্বত ইখতিয়ার করা তাঁদের কাছে বাইয়াত হওয়া ফরজের অন্তর্ভূক্ত বলে তাঁর রচিত ‘কিমিয়ায়ে সায়াদাত’ কিতাবে উল্লেখ করেছেন এবং তিনি নিজেও হযরত আবূ আলী ফারমুদী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট বাইয়াত হয়ে তাক্মীলে (পূর্ণতায়) পৌঁছেন।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, ইল্মে তাছাউফ-এর পথই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত পথ এবং এর মধ্যেই পূর্ণতা রয়েছে। আর প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের মাধ্যমে কস্মিনকালেও ইসলামের পূর্ণ শিক্ষা হাছিল করে তাক্মীলে পৌঁছা সম্ভব নয়। ইসলামে পরিপূর্ণভাবে দাখিল হওয়া প্রসঙ্গে কুরআন শরীফে আল্লাহ পাক বলেন,
“হে ঈমানদাগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে দাখিল হও।” (সূরা বাক্বারা ২০৮)
তাহলে যারা প্রচলিত তাবলীগ করবে, তাদের পক্ষে কি করে সম্ভব পরিপূর্ণভাবে ইসলামে দাখিল হওয়া বা পরিপূর্ণভাবে ইসলামকে অনুসরণ করা? আর এ প্রচলিত তাবলীগই কিভাবে সবচেয়ে উত্তম, শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত আন্দোলন এবং একমাত্র পথ হতে পারে?
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের এই বক্তব্য সম্পূর্ণই মনগড়া, বানোয়াট এবং কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের খিলাফ। আর যেহেতু প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের মাধ্যমে ইসলামের পরিপূর্ণ শিক্ষা অর্জন করা কখনোই সম্ভব নয়। সেহেতু প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত কখনোই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আন্দোলন বা উত্তম ত্বরীকা হতে পারে না।
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের ভ্রান্ত আক্বীদা ও তার খন্ডন (১)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ১০:০৪