শান্তিনিকেতন! আহ! আমার আজন্মের স্বপ্ন ছিলো শান্তিনিকেতন যাবো। যাবার আগে ব্লগ বন্ধু জুন বলেছিলো, " সুরঞ্জনা ওখানে গেলে তোমার স্বপ্ন ভংগ হবে"।
কথাটি যে এমন মর্মান্তিক সত্য হবে তা বুঝিনি। সকাল সাতটায় শিয়ালদা স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে রওনা দিলাম। ট্রেনের ভীড় কহতব্য নয়। বেলা বারোটা নাগাদ বোলপুর স্টেশনে পৌছে গেলাম। মনে মনে উত্তেজনা, আনন্দ নিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে রওনা হলাম শান্তিনেকেতনের পথে।
প্রথমেই এই তোরন নজরে পড়লো। মনে পড়লো কবিগুরু শেষবার যখন আশ্রম ত্যাগ করে যান তখন আশ্রমের ছোট ছোট বালক/বালিকারা এই গানটি গেয়ে কবিগুরুকে বিদায় জানিয়েছিলো।
চারিদিকে সবুজের সমারোহ। শাল, বকুল, কৃষ্ণচুড়া, শিমুল, কুর্চি বিভিন্ন গাছের মেলা। আমাদের রিক্সাওয়ালা যুবক প্রথমেই আমাদের নিয়ে গেলো বিখ্যাত শিল্পী সেলিম মুন্সীর বাড়ী নিহারিকায়। যার উপর তলাতে শিল্পীর নিজের হাতের বেশ কিছু ভাস্কর্য্য ও রবীন্দ্র আমলের শান্তিনিকেতনের চিত্র আছে। ছবি তোলা বারন। সেলিম মুন্সীর আঁকা চিত্রগুলো অসাধারন! অনেক কথা হলো উনার সঙ্গে। উনার বাবা, উনিও এক সময় শান্তিনিকেতনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বর্তমান বিশ্বভারতী নিয়ে উনার মনেও অনেক কষ্ট, ক্ষোভ। বিশেষ করে সব পুরাতন স্মৃতি নষ্ট করে নতুন নতুন ভবন তৈরী ও খোয়াই নদী সংরক্ষন না করা নিয়ে উনি ক্ষুদ্ধ!
নিজ যাদুঘরে নিজের তৈরী রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্য্যের সামনে শিল্পী সেলিম মুন্সী। ( ছবিটি নেট থেকে নেয়া)
ওখান থেকে বের হয়ে রিক্সা থামলো দ্বিজভবনের সামনে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জেষ্ঠ পুত্র, ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জেষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ীর সামনে। যেটাকে সবাই নিচু বাংলো বলে। জায়গাটা একটু ঢালের মত নিচু বলেই এই নামকরন। কিন্তু রিক্সাওয়ালা কাম গাইড আনোয়ার বল্লো, " এখানে অনেক নিচু (লিচু) গাছ আছে তো তাই এটাকে নিচু বাংলো বলে। এ বাংলোটিতে এখনো বিশ্বভারতীর হাত পড়েনি। শ্বেতপাথরে কালো অক্ষরে লেখা আছে দ্বিজভবন।
ছেলে মেয়ে, মহিলা, পুরুষ সবাই বেশীর ভাগ সাইকেল, স্কুটিতেই চলাচল করছে।
প্রাচীন বট বৃক্ষ। না জানি কত ইতিহাসের মৌন সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
নানা রঙের কাচের বর্ণিল ছটায় উৎভাসিত প্রার্থনা গৃহ। প্রতি বুধবার ভোরে এখানে প্রার্থনা করা হয়।
তিন পাথরি বটগাছ। এখানে বসে কবি অনেক কবিতা লিখেছেন। তখন কোপাই অনেক কাছে ছিলো। এখানেই রচিত হয়, " ঐ চলেছে গরুর গাড়ী, বোঝাই করা কলসি হাড়ী"!
তালধ্বজ!
"তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে"!
এই কবিতা এই তালগাছ দেখেই লিখেছিলেন।
রিক্সা যত এগিয়ে যাচ্ছিলো, আমার মেজাজের পারা ততই চড়ছিলো। চারিদিকে ভাংচুর! পুরাতন কে গুড়িয়ে দিয়ে নতুন সৃষ্টি চলছে। যারা রবীন্দ্র-প্রেমি তারা রবীন্দ্র যুগের সেই শান্তিনিকেতনকেই দেখতে চায়। কিন্তু বিশ্বভারতীর নিয়ম নীতির কাছে রবীন্দ্র পুত্রই হার মেনে শান্তিনিকেতন স্বইচ্ছায় ত্যাগ করেছিলেন। আমরা তো কোন ছার!
কোথাও প্রবাশাধিকার নেই, ছবি তোলা নিষেধ। মাথা যন্ত্রনা শুরু হয়ে গেলো।
১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের জমিদার ভূবন মোহন সিংহ এর নিমন্ত্রন রক্ষা করতে যাবার পথে এই ভূবন ডাঙ্গার মাঠে জোড়া ছাতিম গাছের নিচে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। এবং এখানে তিনি " প্রানের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি" পেয়েছিলেন। রায়পুরার জমিদারের কাছ থেকে তিনি ১৬ আনার বিনিময়ে ২০ বিঘা জমি পাট্টা নেন। বর্তমানে ৭ই পৌষ সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে উপাসনা হয় সেই ছাতিম গাছদুটো মরে গিয়েছে। সেখানে নতুন দুটি ছাতিম গাছ রোপন করা হয়।
ছাতিমতলা!
যখন মাত্র ৩টি ছাত্র নিয়ে আশ্রম প্রতিষ্ঠা হয়, তখন থেকে এই বাড়ীতে কবি পত্নী মৃনালিনী দেবী কবির সঙ্গে থেকে স্বামীকে আশ্রম তৈরীর কাজে সাহস মনোবল জুগিয়েছিলেন। জোড়াসাকোতে তার মৃত্যুর পর কবি কন্যা মীরা দেবী এ বাড়ীতে বাস করতেন।
শিল্পী নন্দলাল বসুর বাড়ী। এখনও আগের চেহারায় আছে।
বিখ্যাত শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ এর দুটি শিল্প-কর্ম!
উদয়ন ভবন। এখানে কবি, কবি পুত্রবধু বাস করেছেন। বর্তমানে রবীন্দ্র যাদুঘর। টিকিট কেটে, মোবাইল, ক্যামেরা সব কুম্ভকর্ণের জিম্মায় দিয়ে আমি একাই প্রবেশ করলাম। কবির ব্যাবহৃত বিভিন্ন জিনিস-পত্র, বিভিন্ন দেশ থেকে পাওয়া উপহার, চিত্র, নোবেল প্রাইজের রেপ্লিকা এসব দেখতে দেখতে ঠাণ্ডা এসিতেও আমি প্রচন্ড ঘামতে শুরু করলাম, সঙ্গে তীব্র মাথা ব্যাথা। কোনমতে টলতে টলতে বের হয়ে এলাম। গার্ডরা অবাক হয়ে আমায় বের হয়ে যেতে দেখে বল্লো, " ওদিক দেখলেন না? আমার তখন উত্তর দেবার মত অবস্থা ছিলোনা। তাড়াতাড়ি একটি হোটেলের রুম নিয়ে গোসল করে প্রেসারের ওষূধ, ঘুমের ওষূধ খেয়ে ঘুম দিয়ে বিকেল ৫টায় উঠলাম। আমাদের ট্রেন সন্ধ্যা ৬টায়। কিছু নাস্তা করে স্টেশনে চলে গেলাম। গিয়ে শুনি ট্রেন লেট। বসে বসে বেগুনি,পেঁয়াজু, পাকোড়া খেতে থাকলাম।
সহজাত বাউল শিল্পী নিতাই কৈবর্ত। পঙ্গু। একটি পা সস্তা প্লাস্টিকের। অপূর্ব তার কন্ঠ। তার কন্ঠে অনেকগুলো গান শুনলাম। বিশেষ করে " হরি দিন যে গেলো সন্ধ্যা হলো, পার করো আমারে"! অসাধারন! তাকে খাবার ও কিছু টাকা দিলাম। তাঁর গানের মূল্য দেবার সাধ্য কি কারো আছে?
৬টার ট্রেন রাত ৯,৩০ এলো। গনদেবতা। ভীড় তেমন একটা ছিলোনা। রাত সাড়ে ১২টায় হাওড়ায় পৌছে হোটেলে পৌছাতে পৌছাতে রাত ১টা।
আশাভঙ্গের ব্যাথা যে কত মারাত্বক হতে পারে, তা আমি নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছি। তাই এই পোস্টটি বন্ধু জুনকে উৎসর্গ করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৯:৫৫