ক’দিন থেকে খুব ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে, আর সিলেটের বৃষ্টি একবার শুরু হলে আর থামার নাম নেই। টানা সাত/আট দিন থাকত। এখন অবশ্য ওরকম নেই। উঠোন পেরিয়ে রান্না ঘরে যেতে হত। রাতে এখন আম্মা যাননা। ঘরেই ষ্টোভে খাবার গরম করে নেন। ২৬শে মার্চের পর পরই সবার বাড়িতে মাটি খুড়ে ট্রেঞ্চ বানানো হয়েছিলো। ট্রেঞ্চের উপর টিন দিয়ে ঢেকে উপরে গাছের ডালপালা দিয়ে ঢেকে রাখা। যখন তখন সাইরেন বেজে উঠতো, আর আমরা হুড়মুড় করে ট্রেঞ্চে গিয়ে ঢুকতাম। অল ক্লিয়ার সাইরেন না বাজা পর্যন্ত সেখানেই থাকতে হতো। আম্মা অবশ্য সবসময় যেতেন না। আমাদের তিন ভাই-বোনকে ঢুকিয়ে দিয়ে উনি রান্না ঘরের কাজ সারতেন। সেই ট্রেঞ্চের ভিতর পানি খলবল করতে লাগলো। অফিসের পিয়ন হারুন ভাই রাতে আমাদের বাসাতেই থাকতেন। উনি কয়েকটা সুপারী গাছ ফেড়ে ট্রেঞ্চের ভিতর দিয়ে দিলেন। তখন ট্রেঞ্চে ঢুকলে নৌকার মত ওগুলো টলমল করতো। পুরোপুরি না ডুবলেও পায়ের পাতা ভিজে যেতো। এটা যেন এক মজার খেলা হয়ে গেলো। যখন তখন সেখানে ঢুকে পানি নিয়ে খেলতাম।
শহরে এখন বেশ মানুষ-জন দেখা যায়। যারা ভয়ে গ্রামে চলে গিয়েছিলো, তাদের অনেকেই ফিরে এসেছেন। আমাদের মুড়ি দিতো একজন বুড়ো লোক। হঠাত একদিন সে একঝুড়ি পেঁপে নিয়ে আমাদের বাসায় হাজির। আম্মাতো তাঁকে দেখে খুশীতে চিতকার করে উঠলেন। চা, রুটি খেতে দিয়ে পাশে মোড়ায় বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাঁর কথা শুনলেন। তাঁর মুখে এ ক’মাসের কষ্ট, বিভৎসতার কথা শুনে আম্মার চোখ দিয়ে পানি গড়াতে লাগল। হারানের গ্রামে ৮/১০ ঘর গরিব হিন্দু পরিবার। ওরা সবাই ধান, চাল কিনে মুড়ি, খই ভেজে বিক্রি করত। তখন পর্যন্ত তাঁদের গ্রামে মিলিটারি না গেলেও শহর থেকে আগত মানুষের মুখে পাকসেনাদের নির্মমতার কথা শুনে গ্রাম ছেড়ে প্রায় সবাই ভারতে চলে গিয়েছে। হারানের ১৬ বছরের ছেলে, আর বিবাহিতা মেয়েও তার পরিবার নিয়ে চলে গেছে। হারান যায়নি। তাঁর বউ পঙ্গু, হাটতে পারেনা। ধান চাল কিনতে পারছেনা, তাই খই, মুড়িও ভাজা হচ্ছেনা। আর ভেজেই বা করবেটা কি? শহরে না এলে বিক্রি করবে কোথায়? খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। গাছের ক’টা পেঁপে ছিলো, তাই নিয়ে শহরে এসেছে বিক্রি করতে, আর মা কে দেখে যেতে।
রাতে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র শুনতে শুনতে হাসির দমকে আমাদের গলায় খাবার আটকে যেতো। বিচ্ছু বাহিনি, গজারিয়া মাইর, ছেড়াবেড়া, গেঞ্জাম, এসব নতুন নতুন শব্দ শুনে আমরা খুবই আমোদ পেতাম। কথিকাটির নাম ছিলো চরমপত্র। পরে জেনেছি, ওটা পাঠ করতেন এম, আর, আকতার মুকুল। আব্বা কে দেখতাম বেশ কিছু ঔষধ-পত্র এনে আম্মাকে দিতেন, আম্মা ওগুলো ভাগ ভাগ করে উনার পুরোন শাড়ির টুকরা দিয়ে মুড়ে সেলাই করতেন। নোভালজিন, ডেটোল, ফ্লাজিল চোখের মলম, আরও থাকত হোমিয়প্যাথ ওষুধের শিশি। সকালে অফিসে যাওয়ার সময় বাজারের ব্যাগে করে পুরানো কাপড়ে মুড়িয়ে আব্বা ওগুলো নিয়ে যেতেন। পরে শুনেছি, আব্বার কাছে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা আসত, তাদের জন্যই এগুলো নিয়ে যেতেন।
রাত বারটা থেকে সকাল পাঁচটা পর্যন্ত এখন কারফিউ থাকে। শহরে মানুষজন বেড়ে গেছে। আব্বা বললেন, শান্তি-কমিটী তো আগেই হয়েছিলো, এখন আবার আল-বদর, আল-সামশ এগুলোর জন্ম হয়েছে। আম্মাতো হামেসাই বদদোয়া দিয়ে চলেছেন, “ আল্লাহ’র গজব পড়বে এদের উপর, বিনা মেঘে বজ্রপাত হবে এদের মাথায়, নির্বংশ হবে এরা”। আমাদের বাসার আশে-পাশে অনেক আম গাছ। আম কুড়িয়ে কেঁটে রোদে শুখিয়ে আমসি দিতাম। আঁচার তো বানানো যাবেনা, আম্মা বলেন অনেক খরচ পড়বে তাতে। অলস দুপুরে আম গাছের নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছি, হঠাত নজর গেলো মিছিরউল্লাহ’র রান্নাঘরের জানালা দিয়ে, একি!! দাদুর রান্নাঘরের কলস রাখার তাকটা এখানে কেনো? কলসের মুখে ঢাকা দেয়া যে পেতলের ছোট ছোট রেকাবি গুলো, ওগুলো তে তো ঠাকুর ঘরে দুধ-সাদা সন্দেস দিতে দেখেছি। এ গুলো এখানে এলো কি করে? মিলিটারি যদি দাদুর বাসা তছনছ করে তবে জিনিস গুলো এ বাসায় এলো কি করে, এ রহস্য আমার ছোট মাথায় ঢুকেনা। আব্বা শুনে বললেন, চৌমোহনীর বই’এর দোকানের সব বই গুলোও ঐ বাড়ীতে এসেছে। ঐ বাড়িতে একটা ডোবা ছিলো, যেটার পানি ওরা গরুকে খাওয়াতো, গোসল করাতো, ঐ ডোবার পানি শুখিয়ে গেলে দেখা গেছে কয়েকটা বস্তা পাঁকে পড়ে আছে, তাতে বই ছিলো।
চারিদিকে কলেরা ছড়িয়ে পড়ছিলো, আমরা পানি ফুটিয়েই খেতাম, তারপরেও ফিটকিরি দেয়া পানি দিয়ে ধোয়া-পাকলা করা হচ্ছিলো। সামনের পুকুরের কচুরিপানা পরিস্কার করা হলো। সবাই বলাবলি করছিলো মাছ খাওয়া বন্ধ করতে হবে, মাছ তো প্রায় খেতামই না মাঝে মধ্যে যাও পেতাম, সেটাও বন্ধ হলো। একদিন কিছু লোক এলো টিকা ইনজেক্সন দেবার জন্য। ওদের দেখেই আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া। লুকিয়ে ছিলাম রান্না ঘরের পিছনে। চার/পাঁচ বছর বয়সে কুকুরে আচঁড়ে দিয়েছিলো। তখন নাভির চারপাশে চৌদ্দটা ইনজেক্সনের বিভিষিকা আমায় এই এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়। লুকিয়ে থেকে বাঁচতে পারলাম না। চেংদোলা করে আমায় ধরে নিয়ে টিকা, ইনজেক্সন দেয়া হলো। ইস! মানুষ এতো নিষ্ঠুর!

মিলিটারির আনাগোনা, গোলাগুলির শব্দ ঠিকই ছিলো। ওসব শব্দ তখন আমাদের কানে যেনো ঘুমপাড়ানির গান। আব্বা বলেন, বর্ডার এলাকা গুলোতে রোজই যুদ্ধ হচ্ছে, তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে নাকি অনেক বাংগালি মিলিটারি জড়ো হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের ওখানে প্রশিক্ষন দেয়া হচ্ছে। গেরিলা যুদ্ধও হচ্ছে অনেক জায়গায়। গেরিলা শব্দটা শুনলেই চোখের সামনে গরিলার ছবি ভেসে উঠে, গেরিলা আবার কি? কিন্তু আব্বা কে প্রশ্ন করার সাহস ভাই বা আমার কারোরই নেই। তাই চুপ করে শুনে যাই। সিলেটে এমনিতেই খুব বেশী জোঁকের উপদ্রব, চা-বাগানে এই বৃষ্টিতে জোঁক তো কিলবিল করছে, মনে হতেই গা শিরশির করে উঠল। তবু নাকি বৃষ্টি হওয়াই ভালো। আব্বা বলেন। বৃষ্টিতে ঐ পাকসেনারা নাজেহাল অবস্থায় থাকবে। ওদের দেশে তো এতো খাল, বিল, নদী নেই, এতো বৃষ্টি ওরা জীবনেও দেখেনি।
১৪ই আগষ্টে স্কুলে খুব ধুমধাম করে অনুষ্ঠান হবার কথা, আমি তো আবার সব তরকারির মসলা(আম্মার ভাষায়)। কবিতা, গান, নাচ, সবকিছুতেই আছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই করা হলোনা। এর আগেই পা পুড়িয়ে লেংড়া হয়ে ঘরে বসে রইলাম। সকালে তাড়াহুড়ো করে আব্বাকে নাস্তা বানিয়ে আম্মা আমাকে বলেছেন, এসে তোমাকে দিচ্ছি। চুলার উপর গরম তাওয়ায় ডালডা ছিলো, আমি ভাবলাম আম্মার কাজে সাহায্য করে আমি নিজেই তো বানিয়ে নিতে পারি। যেই ভাবা সেই কাজ- গরম ডালডায় রুটিটা যেই ছেড়েছি, ঝপাত করে সব ডালডা আমার পায়ের পাতায়--- তারপর তো যথারিতি বকুনি, জ্বালা যন্ত্রনা। পা নিয়ে ভুগতে ভুগতে ১৪ই আগষ্ট শেষ।
শবেবরাতে আম্মার হাতের অনেক রকম মজাদার হালুয়া, বরফি, রুটি বানিয়ে পাড়া-প্রতিবেশী, ফকির মিসকিনদের বিলানো হতো। পোলাও কোর্মা আরও কত কি রান্না করতেন। এবার সেসব কিছুই হলোনা। শুধু গাছ থেকে পেঁপে পেড়ে তা দিয়ে হালুয়া করলেন, আর রুটি। পোলাও কোর্মা বাদ। আমরা দু ভাই-বোনে চোখে চোখে কথা বিনিময় করি। “এবার কি ঈদের কাপড়ও বাদ”? রোজা এলো। যথারিতি আব্বা আম্মা রোজা। আমি ও ভাইয়াও রাখছি। কিন্তু আম্মা সবগুলো রাখতে দেন না। রোজা রাখতে আমার তো কোনওই অসুবিধা হয়না। বিকেল দুপুরের দিকে মনে হয় তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাবে। তখন পুকুরে ডুব দিয়ে গভীরে গিয়ে টুক করে পানি গিলে নিতাম। কেউ তো দেখতো না। আহা!! তারপর আমি ঝরঝরে!!!
আচ্ছা রোজা রাখি আর নাই রাখি, কিন্তু ঈদের কাপড়-চোপড়ের তো কোনো আলামত দেখছিনা। ঐ তো বছরে ঈদের কাপড় ছাড়া আর কোনও উপলক্ষে কাপড় কেনা হয়না। আত্মিয় স্বজন থেকেও এতো দূরে থাকি যে কারো কাছ থেকেই কাপড় উপহার পাইনা। এক ঈদ এলেই আমরা ভালো কাপড় কিনি। তাও রোজার ঈদে ২টা জামা বানিয়ে দেয়া হয়। একটা সাদা বা হালকা গোলপি সার্টিনের আর একটি সুতির। ব্যাস!! কোরবানী ঈদে তো কাপড় নিতে হয়না। ওটাতে কোরবানী দিতে হয়। এটা আমরা ছোট থেকেই জানি।
তবুও প্রতিদিন আব্বা অফিস থেকে এলেই আমরা উঁকি দিয়ে আব্বার হাতের দিকে তাকাই। কোন প্যাকেটের আলামত না দেখে নিরাশ হয়ে ফিরে যাই। এর মাঝে একদিন ইফতারির সময় আব্বা বললেন, “ শোন, তোমরা এখন বড় হয়েছ। দেখতে পাচ্ছ দেশের অবস্থা। এসময় আমাদের কি করা উচিত”? ঈদ মানে তো আনন্দ। তাইনা? তোমরাই বলো, এখন কি আনন্দ করার সময়”? কিছু না বুঝেই আমরা মাথা নাড়ি। “ এবার ঈদে আমরা কেউ কোন কাপড় নিবোনা। যারা দেশের জন্য যুদ্ধ করছে তারা কতো কষ্টে আছে তা তো তোমরা জাননা। তারা হয়তো দিনে একবেলাও পেট পুরে খেতে পাচ্ছেনা, ঘুমুতে পারছেনা, এতো কষ্ট করছে তারা এই দেশটাকে মুক্ত করার জন্য। তাদের জন্য আমাদেরও কিছু করা উচিত। তাই আমাদের এবারের ঈদের কাপড়ের টাকা তাদের জন্য দিয়ে দিবো। সে টাকায় একজন মুক্তিযোদ্ধাও যদি পেট ভরে একদিন খেতে পায় তবে মনে করবে আমাদের জীবন স্বার্থক”। ততক্ষনে আমার গলায় মুড়ি মাখানো ছোলা আটকে গিয়েছে। অবাধ্য অশ্রু দু’এক ফোটা বোধহয় মুড়ির প্লেটেও পড়েছে। মাঠে নামলেন আম্মা। “ এবার ঈদে কাপড় না নিলে আমাদের কি হবে? আপনি যে করাচি থেকে এতো সুন্দর সেলোয়ার কামিজ, নাগরা এনেছেন ওটাই তো আমার মেয়ে পড়বে। বাপী, ইতুও তাই পড়বে। ওরা যে কত লক্ষী তা তো আপনি জানেন না”! সুতরাং লক্ষী ছেলে-মেয়েদের মন খারাপ করতে নেই এটা ভেবেই হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নিলাম।
স্মৃতি ১৯৭১ (৪)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০১১ দুপুর ১২:১৬