
টিউবয়েলে পানি উঠছেনা দেখে আম্মা ইয়াসিনকে বললেন সামনের পুকুর থেকে ছোট এক বালতি পানি নিয়ে আসতে। টিউবয়েলে ঢালতে হবে। সে গেছে তো গেছে... এতো দেরী দেখে আম্মা আমায় পাঠালেন ওকে ডেকে নিয়ে আসতে। বাসার পিছন দিক দিয়ে বের হতেই দেখি ওকে আটকিয়ে বাড়িওয়ালার ছেলে লিয়াকত কি যেন কথা বলছে। সে ক্রমাগত মাথা নেড়ে মানা করছে। আমায় দেখেই লিয়াকত সরে গেলো। পানি নিয়ে আসতেই আম্মা ওর উপর ঝাঝিয়ে উঠলেন, “এক বালতি পানি আনতে তোর এতো দেরী? এদিকে কত কাজ পড়ে রয়েছে”। আমি বললাম, “ইয়াসিন তো লিয়াকত ভাইএর সাথে গল্প করছিলো”। ইয়াসিন করুন গলায় বলে উঠলো, “না আম্মা, আমি গল্প করি নাই। ঐ ভাইজান খালি আমারে কি সব জিগায়। আম্মা হাত থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি জিগায়? “কয় কাউলকা যে মিলিটারি আইছিলো হেরা কি করছে? আমি যত কই কি করবো? আম্মায় গরম হইয়া কতা কইছে, হেরা বাত্তি জ্বালাইতে মানা কইরা গেছেগা। বিশ্বাষ করেনা। খালি কয়, হাচা কতা ক, কেউরে কমুনা। তোর আম্মারে ধরে নাই”? আম্মার ফর্সা মুখ রাগে, ক্ষোভে টকটকে লাল হয়ে গেলো। গুম হয়ে গেলেন। রাতে আব্বা সব শুনে বললেন, “ লিয়াকতের মতো ছেলেরা আর কিইবা ভাবতে পারে। ওর বয়সী কোন ছেলেকে ঘরে ধরে বেধে রাখা যাচ্ছেনা, আর সে বাপের ক্ষমতার দাপটে লুটপাট করে বেড়াচ্ছে আর কালি খুজে বেড়াচ্ছে। এসব কথায় কান দেবেনা। আমাদের সবাইকে ডেকে বললেন, “খবরদার ঐ বাসায় যাবেনা। ঐ বাসার কারো সাথে কোনো কথাও বলবেনা।
কদিন থেকে খেতে বসলেই আমাদের নখরামি শুরু হয়ে যেত। আলু, আলু—অসহ্য! শাকসব্জি লাগাতে পছন্দ করি, কিন্তু খেতে নয়। মাছের জন্য প্রতি বেলায় আম্মার সাথে জেদ করি। সেই কবে—আব্বা একহাড়ি মাগুর মাছ এনেছিলেন, ইদানিং তো মাছই আনেন না। আম্মা বলেন, এখন নদীর মাছ খাওয়া যাবেনা। এটা কেমন কথা? নদীর মাছ আবার কি দোষ করলো? ভাইয়া আলু খাওয়ার যম, আলু মাখা ভাত মুখে পুরতে পুরতে বল্লো, “ গাধা! নদীতে ভেসে যাওয়া লাশগুলো মাছেরা খুঁটে খাচ্ছে, ঐ মাছ না খাওয়াই ভালো”। তার চাইতে মুরগি খাওয়া অনেক ভালো। না আম্মা?” আম্মা কেমন যেনো করুন চোখে আমাদের দেখলেন, দুচোখে পানি টলটল করছে। আমরা দুভাইবোন বুঝতেই পারলাম না, আমরা কি এমন কথা আম্মাকে বলেছি। আম্মা যেনো কেমন হয়ে গেছেন, শুধু শুধু চোখের পানি ফেলেন। শেখ মুজিবকে মেরে ফেলেছে শুনে আম্মা সে-কি কান্না! পরে অবশ্য আব্বা খবর পেলেন যে না, শেখ মুজিবকে মারেনি, তবে কোথায় বন্দি করে রেখেছে, কেউ জানে না। আব্বা যেদিন মন খারাপ করে এসে বললেন, “ মধুর কেণ্টিন ওরা পুড়িয়ে দিয়েছে, মধুদাকেও নাকি মেরে ফেলেছে শুনছি”। ঐ দিনও আম্মা অনেক কেঁদেছিলেন। আব্বার কাছে মধুর কেন্টিন, মধুদার অনেক গল্প শুনেছিলাম, তাই আমাদেরও খারাপ লেগেছিলো। এতো ভালো মানুষকে কেনো ওরা মেরে ফেল্লো?
একদিন দুপুরে দরজা বন্ধ করে আম্মা যখন শুয়ে আছেন, আমি পা টিপে টিপে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। বাথরুমের জানালায় কোনো শিক ছিলোনা। জানালা দিয়ে পানিওয়ালা ভারে করে পানি ঢেলে দিতো চৌবাচ্চায়। সেই পানিওয়ালাও এখন আর আসছেনা, মধুদার মত ওকেও মেরে ফেলেছে কিনা কে জানে। চৌবাচ্চার উপর উঠে জানালা গলে আমি বাইরে। আজ আমি মাছ ধরবই। যদিও পুকুরটা কচুরিপানায় সয়লাব হয়ে আছে, কচুরিপানার নিচে কঁইমাছ থাকে, আমি জানি। মাথার উপর দুপুরের তপ্ত আকাশ, ঘাটের শেষ সিড়িতে পা দেয়ার আগে কেন যেন বা দিকে তাকিয়েছি, দেখি, দুইটা সবুজ রঙের হেলমেট দেখা যাচ্ছে, এদিকেই আসছে। সাপের মত পিছলে পানিতে নেমে কচুরিপানার জঙ্গলে ঢুকলাম। পানির উপর নাকটা বের করে তাকিয়ে থাকলাম। মিলিটারি দুইটা কথা বলতে বলতে ঘাটের সামনে এসে ডানে বামে তাকিয়ে বাঁশঝাড়ের আড়ালে চলে গেলো। বুকের ধড়ফড়ানি আমার নিজের কানেই বোমার শব্দের মত মনে হচ্ছিলো। কিছুক্ষন পরে আবার ওদের দেখা গেলো। আমার সাধের হলুদ মুরগিটা বগলদাবা করে ওরা বড় রাস্তার দিকে চলে গেলো। হায়রে আমার মুরগি! সবে মাত্র ডিম দেয়া শেষ করে ঝিমোচ্ছিলো। তাই তো এতো সহজে ধরতে পেরেছে। মুরগির জন্য শোক করার সময় বেশি পেলাম না, আম্মার রক্তচক্ষু মনে হতেই সুড়সুড় করে আবার হাচড়পাচড় করে বাথরুমে ঢুকলাম।
২৫শে মার্চের আগ পর্যন্ত সবার বাসায় দুইটা পতাকা পতপত উড়ত। একটা কালো আর একটা সবুজের মাঝে লাল সূর্য বুকে কমলা মানচিত্র। ২৬শে মার্চ সকালেই আব্বা ও দুটো খুলে আম্মাকে বললেন, “লুকিয়ে রাখো”। আম্মা ও দুটো ভাঁজ করে কোরান শরীফের নিচে রেখে দিয়েছেন। রাতে আব্বা ছোট রেডিওটার নব ঘুরিয়ে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র ধরার চেষ্টা করেন। রাতের আধাঁর ভেদ করে গুলির শব্দ শোনা যায়। আব্বা বলেন, “শেষ ্পর্যন্ত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। ছাত্রসমাজের সাথে কৃষক, শ্রমিক, সাধারন মানুষ সব একসাথে একদাবীতে সোচ্চার”। সমসেরনগর, তেলিয়াপাড়া, রাজনগর এসব জায়গায় যুদ্ধ হচ্ছে। ভারতে যুদ্ধের ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। বর্ডার খুলে দিয়েছে ভারত সরকার। “ দেখি তোমাদের ওদিকে পাঠাতে পারি কিনা”। শুনে তো ভাইবোন আমরা খুশীতে আত্মহারা। ইশ! আমরা দাদাবাড়ি যাবো। দাদাবাড়ি নয়, কদিন পরেই আব্বা আমাদের নিয়ে গেলেন উনার পরিচিত একজনের গ্রামের বাড়িতে। গ্রামের নাম নোয়ারাই। মৌ্লভীবাজার থেকে কত দূরে তা জানিনা। মনু নদীর পার হলাম ছোট্ট নৌকা দিয়ে। নদী পার হয়েই নৌকাটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রাখা হলো।
যাদের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম, তারা এতোটা অথিতিপরায়ন যে আজো তাদের কথা মনের মনিকোঠায় তুলে রেখেছি। শুধু তারাই নয়। যখনই যে গ্রামে গিয়েছি, গ্রামের গরিব দুখি মানুষগুলো এতো আদর যত্ন করেছে, মনেই হয়নি তাদের সাথে ক্ষনিকের পরিচয়। যাই হোক, ঐ বাড়িতে আমাদের বয়সি অনেক ছেলে মেয়ে থাকায় মনে হচ্ছিলো আমরা কোন বিয়ে বাড়িতে এসেছি। সকালে উঠে চলে যেতাম নদীর চরে ক্ষিরা ক্ষেতে। সবুজ পাতার মাঝে হলুদ ফুল কি সুন্দর লাগত! কচি কচি ক্ষিরাগুলো ছিড়েই টপ করে মুখে পুরে দিতাম। এমনি একদিন ক্ষিরা ক্ষেতে থাকতেই মাথার উপর বিকট শব্দে প্লেন উড়ে গেলো। আমরা সবাই ভো—দৌড়- সবাই জড়ো হলো বাঁশঝাড়ের নিচে। দূরে দেখা যাচ্ছিলো দুইটা ফাইটার প্লেন। গোত্তা খেয়ে নিচে নেমে আসছিলো, আবার সো—করে উঠে যাচ্ছিলো। আব্বা বললেন বোমা ফেলেই উঠে যাচ্ছিলো। এ গুলো নাকি রাজনগরে ফেলা হচ্ছিলো। আমরা নিশ্চিন্ত ছিলাম, যে এখানে এখন পর্যন্ত মিলিটারি আসেনি। কে জানত দুদিন পরই আমাদের কপালে কি অপেক্ষা করছে......
স্মৃতি ১৯৭১ (২)
স্মৃতি ১৯৭১ (১)