১৯৬৯ এর গন অভ্যুথানের সময় আমরা ময়মনসিং ছিলাম। তারপর সে বছর না তার পরের বছর আব্বা বদলি হয়ে এলেন মৌ্লভীবাজারে তা মনে নেই। তখন মৌ্লভীবাজার বৃহত্তর সিলেট জেলায় ছিলো। মনু নদীর তীরে ছোট্ট ছিমছাম শহর। আব্বা তদানিন্তন হাবিব ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ছিলেন। এখানে আসার কিছু দিন পরই ব্যাঙ্কের একটি কোর্স করার জন্য আব্বাকে ৬ মাসের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে হয়। এখানে আম্মা আমাদের তিন ভাই বোনকে নিয়ে থেকে যান।
আমাদের পাড়ার নামটি ছিলো শান্তি পাড়া। আমাদের বাসার সামনেই ছিলো বড় একটি পুকুর। বাসার পিছনে ছিলো দুটো বাসা। একটি আমাদের বাড়িওয়ালা মিছিরউল্লাহ মোক্তারের, অপরটি বিক্ষ্যাত সাহিত্যিক সৈ্যদ মুজতবা আলীর। কয়েক বাসা পরেই ছিলো এক উকিলের বাসা। আমরা উনাকে দাদু ডাকতাম। উনার মেয়েরা আমার পিসিমনি, আর ছেলেরা কাকু। ওদের একটি ময়না পাখি ছিলো। খাঁচায় বসে সুন্দর শীষ দিতো, কেউ সামনে গেলেই বলত,"ভাস্কর, অথিত আইছে,বইতে দাও"। খুব মজা লাগত আমার। উকিল বাবু আব্বাকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। আব্বার অনুপস্থিতিতে দাদু, কাকারা, পিসিরা আমাদের খোঁজখবর করতেন। ব্যাঙ্ক থেকে আব্বার খবরাখবর পেতাম, হয়ত চিঠি পত্রও আসত। দেশের পরিস্থিতি কেমন হচ্ছে, বা কেমন চলছে তা সঠিকভাবে না বুঝলেও, এটূকু বুঝতে পারছিলাম চারিদিকে অশান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। মাঝে মাঝে স্কুল বন্ধ হচ্ছে, মিছিল মিটিং, টগবগ করে ফুটছে শহর। এর মাঝেই হঠাৎ করে আব্বা চলে এলেন। উনার মুখেই শুনলাম, ওখানে গুজব শোনা যাচ্ছিলো ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাবে। আর ওখানকার সহকর্মিদের কথা বার্তা, ব্যবহার অনেক বদলে যাচ্ছিলো। আব্বা দেশে ফেরার জন্য ব্যাস্ত হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু ওখানে নানা টালবাহানা করা হচ্ছিলো। শেষ পর্যন্ত আব্বা চাকুরি ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেয়ায় কাজ হয়েছে। যে ফ্লাইটে আব্বা এলেন, সেটাই ছিলো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত শেষ ফ্লাইট।
আব্বা, আম্মার কথায় বুঝতে পারছিলাম, দেশে, আমাদের জীবনে কিছু একটা ঘটতে চলছে। কিন্তু সেই কিছুটা যে কি তাই বুঝতে পারছিলাম না। এর মধ্যে ৭ই মার্চ এলো, চারিদিকে খুব উত্তেজনা, পাড়ায় পাড়ায় জটলা, সবার মুখেই একই প্রশ্ন, কি হবে?
২৬ মার্চের সকালে শুনতে পেলাম কত রকম কথা, শেখ মুজিবকে মেরে ফেলেছে, আর নানা রকম কথা, এর মধ্যে কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে, রাতের বেলা ব্ল্যাক আউট। হেরিক্যানের চিমনিতেও লাগানো হলো চারকোনা করে কাটা কাগজ। আব্বা অফিস থেকে এসে নানা খবর জানাতেন, আর ছিলো ছোট্ট রেডিওতে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, আকাশবানীর খবর শোনা। আমাদের বাড়িওয়ালা মিছিলউল্লাহ মোক্তার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হলেন। তার বাড়িতে পাকসেনাদের আনাগোনা শুরু হল। শহরের মানুষগুলো রাতারাতি কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। এক সকালে দাদুর বাড়ির দরজাতেও দেখলাম তালা ঝুলছে। আব্বা আমাদের সদর দরজায় তালা লাগালেন, বাসার পিছন দিক দিয়ে আমাদের চলাচল শুরু হোল।
আব্বার কঠোর নির্দেশ, বাসার বাইরে পা দিবে না। ভাইয়া শান্তশিষ্ঠ লক্ষ্মী ছেলে, আব্বার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেও আমার পক্ষে এই নির্দেশ মানা সম্ভব ছিলো না। অব্যাবহারে পুকুরটা যতই পানার জঙ্গল হোক, তাতে ডুব না দিলে কি আমার চলবে? আর এই নিঃঝুম পাড়াতে একটু ঘুরাঘুরি তো করতেই হবে। একদিন গিয়ে দাদুদের বাসায় ঢূকলাম। যদিও গা ছমছম করছিলো, তারপর ও আমার কৌতুহলি মন থামছিলো না। দরজা হাট করে খোলা। ঘরে কোন আসবাব পত্র নেই, সারা বাড়ি লণ্ডভণ্ড,কাগজের ছড়াছড়ি। ঠাকুর ঘরে উঁকি দিলাম, শুন্য ঘর। ছোট্ট পিতলের দোলনায় দুলত ছোট্ট পিতলের রাধা কৃষ্ণের মুর্তি, ঘুমানোর জন্য ছোট্ট পিতলের খাট, ছোট ছোট থালা বাটি, যেগুলো আমার মনে লোভ জাগাত, কিছুই নেই। ফিরে আসার সময় কাগজের স্তুপের নিচে শক্ত কিসে যেন পা পড়ল, হাতে নিয়ে দেখি শঙ্খ। এই দুধসাদা শঙ্খটি কত সন্ধ্যায় শুক্লা পিসিকে গাল ফুলিয়ে বাজাতে দেখেছি। বাসায় ফিরে আম্মাকে দেখালাম, আম্মা বললেন, তুলে রেখে দাও, ওরা এলে ফিরিয়ে দেবে। আম্মার মুখ থেকে আব্বা শুনেই ধা করে আমার গালে এক থাপ্পর বসালেন। আব্বা ধমকে বললেন,"কেন তুমি বাইরে গেলে, কেন অন্যের জিনিস হাতে নিলে?" কি করে বুঝাই, পিসিমনিদের শঙ্খ পড়ে ছিলো অনাদরে, কেউ যদি নিয়ে যেত?
ঃ এই সিরিজটি গত বছর মার্চেও পোস্ট করেছিলাম। এ বছরে অনেক নতুন পাঠক, ব্লগার এসেছেন, তাদের জন্য লেখাটি কিছু পরিমার্জিত করে দিলাম।