আমারাই এই পৃথিবীর একমাত্র জাতি যারা মাতৃভাষার জন্য নিজের শরীরের তাজা রক্ত ঢেলে দিতে কুণ্ঠা বোধ করেনি। মাতৃভাষায় কথা বলতে পারার যে আনন্দ সেটা তারাই বুঝতে পারে যারা মাতৃভাষায় কথা না বলতে পারার কষ্ট সম্পর্কে অবগত। আমারা সবাই আমাদের ভাষাকে ভালবাসি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমারা অনেকেই আমাদের ভাষা সম্পর্কিত অনেক তথ্য জানি না। আমি নিজেও জানি না। তবে, আজকে একটা নতুন তথ্য জানতে পারলাম যেটা আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।
আমাদের বাংলা ভাষার বর্ণমালা বাংলা ছাড়াও আরেকটি ভাষায় ব্যবহৃত হয়। আমি জানি, আমার মত অনেকেই এই ব্যপারে ওয়াকিবহাল নন। তাদের জানাই, সত্যি! "বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী" নামক ভাষাটি বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করে।

আসুন, এই ভাষা সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জানার চেষ্টা করি।
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সম্প্রদায়ের ভাষার নাম বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা নিজেদের ভাষাকে ইমার ঠার (অর্থাৎ "আমাদের ভাষা") বলে থাকে। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা প্রধানত বাংলা লিপি এবং অসমীয়া লিপি থেকে ২টি লিপি (ৰ, ৱ) লেখার কাজে ব্যবহার করে থাকে। তাছাড়াও অনেকে দেবনাগরী লিপি ব্যবহার করে থাকে।
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় অন্যান্য ভাষার প্রভাবঃ
তৎসম শব্দ প্রায় ১০,০০০
অর্ধ-তৎসম প্রায় ১,৫০০
হিন্দী, বাংলা ও অসমীয়া শব্দ প্রায় ৮,০০০
তৎভব শব্দ প্রায় ২,০০০
মৈতৈ শব্দ প্রায় ৩,৫০০
আরবী-পার্শি শব্দ প্রায় ২,০০০
ইংরেজি শব্দ প্রায় ২,০০০
দেশী শব্দ প্রায় ২,০০০
ইতিহাসঃ
ভারতের মণিপুর রাজ্য থেকে এই সম্প্রদায়ের উৎপত্তি। ১৭শ খ্রীষ্টাব্দের মাঝামাঝি মণিপুর রাজ্যে বার্মিজদের সঙ্গে ৭ বৎসর স্থায়ী যুদ্ধে মণিপুরের অন্যান্য আরও জাতি ও উপজাতির ন্যায় বর্তমান বাংলাদেশ সহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা ছড়িয়ে পড়ে।
ভারতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনঃ
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের উত্তরপুর্বাঞ্চলের অসম, ত্রিপুরা ও মণিপুরে এবং বার্মায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জাতির লোক বাস করে। অসমের বরাক উপত্যকার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের রয়েছে সুদীর্ঘ ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস। মাতৃভাষায় শিক্ষার দাবীতে আন্দোলনের ফলে ১৯৮৩ সনে অসম সরকার মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু পরে সরকার এই সিদ্ধান্ত স্থগিত করলে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা ফুসে ওঠে। ১৯৯৬ সনে মাতৃভাষায় শিক্ষার দাবীতে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়াদের ৫০১ ঘণ্টার রাজপথ-রেলপথ অবরোধ আন্দোলনে অসমের করিমগঞ্জে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সুদেষ্ণা সিংহ নামের এক বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী তরুণী। ৯ এপ্রিল ১৯৯৯ তারিখে প্রদত্ত একটি রায়ের মাধ্যমে ভারতের গৌহাটি হাইকোর্ট জনগোষ্ঠীর নাম ‘মণিপুরী’ হিসাবে চিহ্নিত করে ভারতের অসম ও ত্রিপুরা সরকারের ‘ওবিসি’ তালিকার মধ্যে (ক)মণিপুরী মৈতৈ, (খ)মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া, (গ)মণিপুরী ব্রাহ্মন ও (ঘ)মণিপুরী মুসলিমদের অন্তর্ভুক্তিকে আইনগতভাবে অনুমোদন করে। এরপর ভারত সরকার অসম ও ত্রিপুরা রাজ্যের স্কুলগুলোতে মণিপুরী মৈতৈ ও মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া উভয় ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দেয়। পরবর্তীকালে ২০০৬ সনে ভারতের সুপ্রীম কোর্ট এক যুগান্তকারী রায়ের মাধ্যমে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী’ ভাষাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়।
সাহিত্যঃ
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা মণিপুর ছাড়ার পরপরই নিজেদের ভাষা প্রায় ভুলতে শুরু করেছিল। বর্তমানে এই ভাষায় প্রচুর সাহিত্য চর্চা শুরু হয়েছে। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার প্রাচীন আমলের সাহিত্যের মধ্যে লোককথা, লোকগান, লোককবিতা, ছড়া এবং পৌরেই (প্রবচন) উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে বরন ডাহানির এলা বা "বৃষ্টি ডাকার গান" (রচনাকাল, ১৪৫০-১৬০০ খ্রীস্টাব্দ) এবং প্রাচীন জীবনযাত্রা নিয়ে রচিত মাদই সরারেলর এলা-র (রচনাকাল ১৫০০-১৬০০ খ্রীস্টাব্দ) কথা উল্লেখ করা যায়। গানগুলি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীর সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন ধরা হয়।
বিংশ শতকর তৃতীয় দশক থেকে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূচনা ঘটে। ঐ সময়কার প্রধান চারজন লেখক হলেন লেইখমসেনা সিংহ (নাটক: বভ্রুবাহন, মণিপুর বিজয়), মদনমোহন শর্মা (গ্রন্থ: বালিপিন্ড, হরিশ্চন্দ্র, সুবলমিলন, তিলত্তমা, বাসক, সুদমাবিপ্র), আমুসেনা সিংহ (নাটক: অঙ্গদ রায়বার, শক্তিশেল, তরনীসেন বধ, নাগপাশ, মহীরাবণ বধ) এবং গোকুলানন্দ গীতিস্বামী (মাতৃমঙ্গল গীতাভিনয় নাটক, সমাজ জাগরণমূলক নানান পদাবলী, এলা, বারো কবিতা)। এছাড়া রোহিনী রাজকুমার, গোলাপসেনা সিংহ বারো গোষ্ঠবিহারী সিংহের নামও উলেখযোগ্য। বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী ভাষায় প্রথম প্রকাশিত পত্রিকা জাগরন (সম্পাদক শ্রী অর্জ্জুন সিংহ), ১৯২৫ সালে।
বর্তমান যুগের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিকদের তালিকা এরকম:
ভারত
অধ্যাপক ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহ - বাংলা ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী
ডঃ কালি প্রসাদ সিংহ - সংস্কৃত ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী
বরুণ কুমার সিংহ -ইংরেজি ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী
দিল্স লক্ষ্মীন্দ্র কুমার সিংহ - অসমীয়া ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী
দিল্স দেবজ্যোতি সিংহ - ইংরজী, অসমীয়া ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী
বাংলাদেশ
শুভাশীষ সমীর - বাংলা ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী
অধ্যাপক রনজিত সিংহ - বাংলা ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী
অসীম কুমার সিংহ - ইংরেজি, বাংলা ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী
এই ছিল আমার হাতে থাকা কিছু তথ্য। যারা আগে থেকে জানতেন তাদের জন্য নতুন দুয়েকটা তথ্য আর যারা জানতেন না তাদের জন্যতো পুরটাই নতুন। আশা করি কিছুটা হলেও পাঠক আনন্দ পাবেন। ধন্যবাদ।

[বি.দ্র. তথ্যসমূহ উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া। আরও জানতে চাইলে
Click This Link
লিঙ্কে একটা ঢু মেরে আসতে পারেন।]
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১১ দুপুর ১২:০৬