-ভাইয়া,আমাকে একটা এন্ড্রয়েড মোবাইল কিনে দিবি?
-কি করবি?তোর তো একটা মোবাইল আছে।
-আরে ওইটা তো পুরানো।বান্ধবীদের সবার এন্ড্রয়েড আর স্মার্ট ফোন।সবার ফেসবুকে একাউন্ট আছে।আমার নেই।আব্বাকে বলতেই চেতে গেলো।তুই কিনি দিবি।
-আগে পরীক্ষা শেষ কর তারপর কিনে দেবো।
মোর্শেদের কথা শুনে শীলা চোখ-মুখ অন্ধকার করে বসে থাকে।বোনের চেহারা দেখে ওর খুব মায়া হয়।
-ঠিক আছে,আগামীকাল কিনে দেবো।
খুশিতে লাফিয়ে উঠে শীলা।
-ও!আমার সুইট ভাইয়া।
মা ওদের কথা শুনে ঘরে আসে।
-মোর্শেদ,আদর দিয়ে দিয়ে বোনটারে মাথায় তুলছিস।যা আবদার করে তাই কিনে দিস।অতি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।কোন ঘরে গিয়ে পড়বে তার ঠিক আছে।
-মা,ভাই-বোনের মাঝে তুমি এসোনাতো।
একথা বলেই থপথপ করে পা ফেলে বেরিয়ে যায় শীলা।মা ও ছেলে মুখ তাকাতাকি করে হেসে ওঠে।মা বেরিয়ে যায়। মোর্শেদ তার লেখায় মন দেয়।
শাহবাগে একত্রিত হয়েছে পিয়ালরা।মোর্শেদও আছে।পিয়াল তার ওই পত্রিকা ছেড়ে শীর্ষ স্থানীয় এক অনলাইন পত্রিকায় সিনিয়র এডিটর হিসাবে যোগ দিয়েছে।আজ যারা এখানে একত্রিত হয়েছে তারা অনেকেই চাকুরীজীবী।কেউ কেউ ছাত্র এবং সচ্ছল পরিবারের ছাত্র।ওরা দেশ নিয়ে ভাবে,সবাই সংস্কৃতমনা আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে স্পষ্ট ধারণা আছে সবার।কেউ সরাসরি রাজনীতি করেনা।ওরা সবাই ব্লগে লেখে।লেখে বাঙালীত্ব নিয়ে,মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে,মিথ নিয়ে,কুসংস্কার ও ধর্ম নিয়ে।ওদের একত্রিত হবার মূল লক্ষ্য ওরা একটি নতুন ব্লগ খুলতে চায়।এর ডিজাইন এবং নীতিমালা ঠিক করতে চায়।অনেক আলোচনা হয়।কিন্তু কেউ একটি নির্দিস্ট সিদ্ধান্তে আসতে পারেনা।মুন্সি খুব রেগে যায়।
-এই হলাম আমরা।একটি কনক্রিট সিদ্ধান্তে আসতে পারিনা।
মুন্সির কথা শুনে মাহাফুজ হাসে। বলে-ঠিক আছে আমরা না হয় যে ব্লগগুলিতে লিখছি ওটাতেই লিখা চালিয়ে যাই।
সেলিম বলে উঠে-আমার আইডি এ পর্যন্ত দুইবার স্থগিত করেছে।এভাবে লেখা চালানো কঠিন।আমরা যারা সমমানসিকতার তারা এক প্ল্যাটফরমে থাকলে ভাল হতো।
আজ ঢাকা শহরে প্রচন্ড ভীর।আগামীকাল জামাত হরতাল ডেকেছে –কাদের মোল্লার রায় দেবে তাই।নাজমুল সাহেব মীরপুর যাবেন।উনার বড় ভাই আফজাল সাহেব মিরপুর একের পানির ট্যাঙ্কির ওখানে থাকেন।তিনতলা বাড়ি বানিয়েছেন।নাজমুল সাহেবের ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় পড়ছে। এনা বাসে উনি মহাখালিতে এসেছেন।এখন না পাচ্ছেন সি এন জি,না উঠতে পারছেন লেগুনায়।শেষ পর্যন্ত ভাতিজা মোর্শেদকে ফোন করেন।
-হ্যালো মোর্শেদ,তুমি কোথায় আছো বাবা?
-আমি কাওরান বাজারে।কেমন আছেন?
-বাবা,আমি তো ময়মনসিংহ হতে এইমাত্র মহাখালিতে আসলাম।কোন যানবাহন পাচ্ছিনা তোমাদের ওখানে যাবার।
-ঠিক আছে চাচা,আপনি ওখানেই থাকুন।আমি এখনই অফিস হতে বেরুবো।
নাজমুল সাহেব মহাখালি কাঁচা বাজারের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন।
মোর্শেদ দীপাকে ফোন করে জানিয়ে দেয় আজ আর আসা হবেনা।
রাতে খাবার টেবিলে সবাই একত্রিত হয়।খেতে খেতে আফজাল সাহেব দেশের বাড়ি নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করেন ছোট ভাইকে।নাজমুল সাহেব উত্তর করেন।মোর্শেদের বড়বোন মিথিলা সেতু সম্পর্কে জানতে চায়।
-চাচা,সেতুর বরের পোস্টিং কোথায় হলো শেষ পর্যন্ত।
-নেত্রকোনায়।
-বাবা,মোর্শেদ আগামীকাল কি রায় আসতে পারে?তোমরা সাংবাদিক তোমরা এগুলি ভাল জানবে।
-কি রায় হবে তা জানা যাবে কিভাবে ? তবে কসাই কাদেরের ফাঁসি হওয়া উচিত।
গত দুই তিনদিন যাবৎ রাজু খুব ব্যস্ত।একটার পর একটা সীম চেঞ্জ করে করে কথা বলতে হচ্ছে সংগঠনের নির্দেশে।ওকে যা করতে বলা হয়েছে হরতাল চলাকালিন শাহানগাছা ব্লক করে দিতে হবে।আর রৌফের দায়িত্ব পড়েছে নলকা কে বিচ্ছন্ন করতে হবে সিরাজগঞ্জ হতে।কড্ডায় রাখতে হবে ঝটিকা আক্রমণ ফযরের আগে।আর এভাবে সিরাজগঞ্জের সাথে যোগাযোগের সব পথ বন্ধ করে দিতে হবে।যদি লোকবলের আরও প্রয়োজন হয় তবে ভাড়া করতে হবে তাদের যাদের খুন করাই পেশা।অর্থের কোন সমস্যা হবেনা।বেলকুচি,সলঙ্গা হতে বাছাই করা সংগঠনের চৌকস ছেলেরা চলে এসেছে আগেই। আগামীকাল হরতাল।
লতা স্বামীর অবস্থা দেখে ভয় পায়।বলে-এই সবের মধ্যে যাচ্ছো যদি কিছু হয়ে যায়?আমার কথা নাই বা ভাবলে,রাফির কথাতো ভাববে।রাজু বিরক্ত হয়।
-দেখো,সংগঠনের টাকায় আমাদের পেট চলে।রিজিক দাতা।সংগঠনের বিপদে আমাদের সামনে থাকতে হবে।আমাদের সব নেতাদের এই জালিম সরকার জেলে পুড়ছে ।অপরাধ কি, উনারা নাকি যুদ্ধাপরাধী।আল্লাহর গজব পড়বো এই সরকারের উপর।নির্বংশ হবে ওরা।আর চিন্তা করোনা,মাত্র তো কয়েকটা দিন বি এন পি ক্ষমতায় এলে রফিক ভাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন।আমাকে পি এ বানাবেন কথা দিয়েছেন।
রশিদ ছনগাছা যাবে বলে বাড়ি হতে বেরিয়ে পড়ে।আগামীকাল ওর অর্ডার সেনডিং।আজকেই যদি ওদিকে না যায় তবে হরতালের মধ্যে যাওয়া সম্ভব হবেনা।শাহানগাছার কাছাকাছি যেতেই একজন হাত তুলে ওকে থামতে বলে।
-ওদিকে আর যাবেন না মোটর সাইকেল নিয়ে।পুড়িয়ে দিতে পারে।
-কেন?
-আগামীকাল হরতাল।গণ্ডগোল হবে একটু পরেই।
রশিদ চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি স্ট্যান্ড করে।দোকানি দোকান বন্ধ করতে ব্যাস্ত।রশিদ লক্ষ্য করে জনা দশেক যুবক হাতে লাঠি,রামদা আর মাথায় ক্রিকেট খেলার হ্যালমেট।ওর খুব মজা লাগে ক্রিকেট খেলার হ্যালমেটের এমন আশ্চর্য ব্যবহার দেখে।যুবকদের দেখিয়ে সে দোকানির কাছে জানতে চায়,ওরা কোন দলের।দোকানি গম্ভীরভাবে বলে-জয়বাংলা।মারামারি দেখবে কিনা রশিদ ভাবতে থাকে।এমন সময় এক যুবকের কথা কানে আসে-পুলিশ কখন আসবে।কিছুক্ষণের মধ্যেই নারায়েক তাকবির ধ্বনি রশিদের কানে আসে।আর দেরি করেনা সে,সিরাজগঞ্জের দিকে বাইকের মুখ ঘুড়িয়ে নেয়।
সকালে হাসপাতাল গেটে যায় রশিদ।ফার্মেসীতে মতিন বস আর রফিক ভাই বসে আছে।লোকজনের উপস্থিতি নেই বললেই চলে।
-আজকে মোটর সাইকেল বের করেননি ?মতিন জিজ্ঞাসা করে রশিদকে।
-মোটর সাইকেল পুড়ানোর ধান্ধা নাকি আপনার? রফিক হেসে বলে ।
দোকানে প্রোজ্জল আসে হাঁফাতে হাঁফাতে।ডিটেলিং ব্যাগটা দোকানের এক কোণে রাখে।তাই দেখে রফিক খেঁকিয়ে উঠে।
-আমার দোকান কি কোম্পানীর গোডাউন,আসবেন আর যার যা ইচ্ছা রাখবেন।
-আপনার দোকান ছাড়া আর কোথায় রাখবো বলেন? প্রোজ্জল হেসে উত্তর করে।
মতিন সিগারেট ধরায়।তার প্রতিদিন দু’প্যাকেট সিগারেট লাগে।সে কোন ঔষধ কোম্পানীতে চাকুরী করে না।পট বিক্রয় করে।আর তার লাভেই তার সংসার খুব ভাল ভাবেই চলছে।
-প্রোজ্জল মালু,বলেনতো আজকে কি রায় আসতে পারে?
প্রোজ্জল খুব খেপে যায়।
-আচ্ছা,মতিন ভাই আপনি এতো সিনিয়র তবুও আপনার কথাবার্তার কোন ব্যালেন্স নেই কেন?আপনি যখন তখন মালু বলেন।আর রায় কি দেবে তা আমি কিভাবে বলবো?
-আপনাদের দল ক্ষমতায়। আপনি বলবেন নাতো কে বলবে?
রফিক ধমকে উঠে।
-মতিন ভাই এগুলি থামানতো।দাদা,হেঁটে এসে এমনিতেই কাহিল।ব্যাচারা মোটর সাইকেল ছাড়া এক ধাপ নড়েনা।আর আজকে তাকে হেঁটে আসতে হচ্ছে।
-ডাক্তার আজকে দেরী করছে কেন? মতিন একা একাই বলে।
প্রোজ্জল চা পানের জন্য চায়ের স্টলে আসে।পিছে পিছে রশিদও বেরিয়ে আসে।দু’জন সিগারেট ধরায়।
-জানিস রশিদ বড়পুল হতে এই হাসপাতাল পর্যন্ত, আমার মনে হয় এই অংশ বাংলাদেশ নয়।মনে হয় পাকিস্থান।এখানকার ছোট বাচ্চারা পর্যন্ত শ্লোগান দেয় পাকিস্থান জিন্দাবাদ।আর দেখ,বড়পুলের ওপারে রিকসা চলছে।এই পারে?একটাও না।
-এইটা এক সময়ের মুসলিমলীগ অধ্যুষিত এলাকা ছিল তো তাই।এখানকার মানুষদের পাকিস্থান প্রীতিটা একটু বেশী।
-একটু না।বেশ বেশী।
চা-সিগারেট শেষ করে ওরা ফার্মেসীতে ফিরে যায়।গিয়ে দেখে ডাক্তার সাহেব এসেছেন।দুজনেই তাকে সালাম দেয়।ডাক্তার সাহেব আজ বড় বেশী গম্ভীর ।উনি এ অঞ্চলের সব চাইতে বিখ্যাত ডাক্তার।মতিন উনার দিকে সিগারেট বাড়িয়ে দেয়।
-রশিদ,চা দিতে বলেনতো। ডাক্তার রশিদকে নির্দেশ দেন।
রশিদ চায়ের কথা বলতে বেরিয়ে যায়।
ডাক্তার সাহেব প্রতিদিনিই রাজনীতির গল্প করেন এখানে,হাসপাতালের রুমে বসার আগে।উনার গল্প মানে-উনি বলে যাবেন আর অন্যেরা উনার সুরে সুর মিলিয়ে যাবে।উনার কথার সাথে কেউ দ্বিমত করার সাহস দেখায় না।উনি বি এন পি করেন।যদিও সবাই জানে উনি আসলে জামাতের লোক।ছাত্র জীবনে শিবির করতেন।উনার পছন্দের ক্রিকেট দল পাকিস্থান ।পাকিস্থানের সব কিছুই উনার খুব প্রিয়।উনি কট্টর ভারত বিদ্বেষী।যদিও উনার উচ্চতর ডিগ্রী ভারত থেকে অর্জিত।গল্পে গল্পে প্রায়ই বলেন একজন বাংলাদেশী মুসলিম হিসাবে উনাকে কেমন অপদস্ত হতে হয়েছে ভারতে।
প্রোজ্জল কিছুক্ষণ ডাক্তারের সাথে সঙ্গ দেয়। তারপর বেরিয়ে পড়ে।বড়পুলের উপরে উঠে ঘড়ি দেখে।তারপর সিদ্ধান্ত বদলায়।বাসায় চন্দ্রিমা একা।ও বাসায় ফিরতে মনস্থির করে।
কলিংবেলের আওয়াজ শুনে চন্দ্রিমা দরজা খুলে দেয়।স্বামীকে দেখে একটু অবাক হয়।
-আজ এতো তাড়াতাড়ি!
-আর বলোনা। হরতালের দিন রুগীপত্র একদম নাই।ডাক্তাররা সব বসে বসে গল্প-গুজবে ব্যাস্ত।আজ কি রান্না করবে?
-এখনও তুলে দেওয়া হয়নি।মাছ বের করেছি।
-মাংস করো তাহলে।
-ফ্রিজ থেকে মাছ বের করে রাখলাম।ঠিক আছে করছি।
চন্দ্রিমা মাংস বের করে ভিজাতে দেয়।সে তরকারি কাটতে বসে। প্রোজ্জল খেয়াল করে চন্দ্রিমার বুকের খাঁজ খুব সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে।তার মধ্যে প্রবল কামভাব জেগে উঠে।সে পিছনে গিয়ে চন্দ্রিমার ঘারে চুমু খায়।
-কি করছো?সুরসুরি লাগেতো।
প্রোজ্জল চুমু খেতেই থাকে।আদুরে কন্ঠে চন্দ্রিমা বলে-আজ কি রান্না ঘরেও হরতাল?
-চল বিছানায় যাই।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৬ রাত ১১:১১