চোখ এমন হবার অন্যতম কারণ রাতে ঘুম না হওয়া। একদমি ঘুম আসছিলো না। এমনি সারারাত জাগলেও আমার চোখেমুখে কখনও সেটা ধরা পরেনা। কিন্তু মানসিক চাপে থাকায় তার সবটাই নির্ঘুম রাতের চোখে ফুটে উঠেছে।
রাতে অনেকক্ষণ ঘুমাতে চেষ্টা করেছিলাম,গান শুনেছি। তারপরও ঘুম আসছিলো না। ঘুম আর আসবেনা ভেবে মোবাইল থেকে অনলাইনে আসলাম। এসে দেখি আমার আপু! যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। আমার বেলায় কথাটা খাটলোনা। আমি ওর সাথে রাত-বিরেতেই গল্প শুরু করলাম। কি রেধেছো, কি খেয়েছো, কি করছো...ও প্রথমে খেয়াল না করলেও একটু পর ধরা পড়লাম রাত জাগা আমি।
-এখনও ঘুমাওনি? এভাবে প্রতিদিন রাত জাগলে তো মাথা ব্যাথা করবেই।
--ঘুম আসলে তো ঘুমাবো!
-কিছু একটা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যা...
--এখন আলো জ্বালাতে পারবো না।
-তাহলে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ট্রাই কর। আমি যাই আমার একটু কাজ আছে।
--অনেক করেছি। আসেনা। ঠিক আছে তুমি কাজ করো আমি জাচ্ছি।
শুয়ে শুয়ে আগের কথা ভাবলাম আমরা কত্ত একসাথে ঘুমিয়েছি। এখন আপুটা থাকলে হয়ত এ্যালিসের বড় বোনের মতো আধশোয়া হয়ে আমাকে গল্প পড়ে শুনাতে শুনাত ঘুম পাড়িয়ে দিতো। গল্প শুনাতে না পারলেও আদর করে ঘুমাতে যেতে বললো কিন্তু কে শোনে কার কথা! আমি আমার অন্য একটা আপুকে ডাকাডাকি শুরু করলাম।
-আপু আছেন? একদমি ঘুম আসছেনা...
আমার ভাগ্যটাই খারাপ র'আপুটাও নাই। র'আপুটাও থাকলে ভালো হত। অনেকক্ষণ কথা বলা যেত। কি আর করা! শুয়ে শুয়ে কেন এত ভুগছি, কেন এত খারাপ সময় যাচ্ছে আমার, কেনো এই কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে...এমন নানান কথা ভেবে মন খারাপ করছিলাম।হঠাৎ মনে হলো এই বছরটা যে এত খারাপ যাবে সেটা আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিলো। কারণ, প্রত্যেকটা জিনিশেরই একটা pattern থাকে, একটা period থাকে। সময়ের ও আছে। যেটায় বছর ঘুরতে ঘুরতে Amplitude এর maximum value peak এ পৌঁছে যাই আবার বছর ঘুরতে ঘুরতে Amplitude এর minimum value peak এ পৌঁছাই। একটা সময় positive value curve টায় ছিলাম বর্তমান সময়টা negative value curve টায় আছি। সহজ হিসাব! তবে এ পথটা পাড়ি দেয়া খুবই কঠিন, খুবই যন্ত্রণাদায়ক। এ বছরটায় এতটা এতটা কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে যেটা কখনোই স্মৃতিহীন হবার নয়... তবে এই সময়গুলায় আমার সবচেয়ে কাছে থেকে আমাকে সাপর্ট করে গেছে আমার আপুরা। [আরও অনেকে নানান সময় নানানভাবে সাপর্ট করেছে। তবে তাদের কথা এখন থাক]
আমার আপুটা সারাজীবন আমাকে আগলে রেখেছে। অথচ আমি তোমাকে কত কষ্টই না দিয়েছি। তুমি আমাকে কত বুঝিয়েছ শুনিয়েছ অথচ আমি কখনও বুঝতে চাইনি। তোমার সাথে কথাকাটাকাটি আর ঝগড়া করে গিয়েছি। ছোটবেলা থেকে তুমি চাইতে আমি ডক্টর হই অথচ আমি এখনও লেখাপড়া ঠিকভাবে করিনা। তুমি যদি শুনো আমি ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি খুব রাগ করবে তাইনা? দেখলে কত স্বার্থপর তোমার বোনটা! নিজের কষ্টকেই সে বড় করে দেখে...তোমাদের স্বপ্ন আশা শুধু গুড়িয়ে দেয়...তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি তুমি আমাকে আরও আগলে রেখ...দেখলে তো আবারও স্বার্থপরের মত নিজের জন্য চাইছি! তোমার কাছে আ-জীবন হয়ত স্বার্থপরের মতো চেয়েই যাব। আমি জানি তুমি দিবে কারণ আমাদের আত্মা এক সুত্রে গাঁথা। তুমি যে আমাকে কত কত ভালবাসো সেটা আমি আমার এই বছরের কঠিন সময়গুলায় নতুন করে বুঝেছি।
র'আপুটার এখনও খোঁজ নেই। আবার তাকে ডাকলাম। র'আপুর সাথে আমার পরিচয় ওর মাধ্যমে। র'আপু হলো ওর বোন, কিন্তু এখন সে আমারও বোন হয়ে গিয়েছে। র'আপুর সাথে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিবার সময় আমি অনেক ভয় পেয়েছিলাম। ওর বড় বোন!!! ভীষণ ভয়ে ভয়ে কথা বলেছিলাম। এখন ভাবলেও হাসি পায়। র'আপুটাও সব সময় আমার পাশে থেকেছে, আমাকে বুঝিয়েছে নিজের বোনের মতো করে। আমি নিজের ভিতরের কষ্টটা অন্যদের থেকে আড়াল করে রাখি। কিন্তু র'আপুটা আমার ভিতরের অনেক কষ্ট দেখেছে। তাকে অনেক কিছু বলতে পেরেছিলাম যা অন্যকে বলতে পারবোনা। র'আপুটা কখনও বিরক্ত হয়নি, বরং আমাকে গভীর মমতায় ঘিড়ে রেখেছে। শুধু যে কষ্টের ব্যপাড়েই র'আপু আমার পাশে থাকে তা নয়। র'আপু আর আমি সারাক্ষণ দুষ্টমী করি। একজন আর একজনের কথা শুনে হেসে গড়াগড়ি করি।
এখন প্রত্যেকটা দিন আমি মাথাব্যাথায় কাতরাই তাই, ডক্টর আমাকে ব্লাড টেস্ট দিয়েছে সেগুলা করাইনি তাই র'আপু রাগ করে। রোজ আমাকে প্রথমে আদর করে আদর করে, তারপর রাগ করে, তারপর ঢেলেঠুলে ডক্টরের কাছে পাঠাতে চায় কিন্তু কে শুনে কার কথা! কয়দিন আগে আমাকে ভীতু বলে ক্ষেপিয়েও ডক্টরের কাছে পাঠাতে চাইলো তখন আমি বললাম, আমি ভীতু!? দাড়াঁন আমি ইনজেক্শান নিয়ে আসছি তখন দেখা যাবে কে ভীতু। যেই সেই ইনজেক্শান নয় গরুর ইনজেক্শান...তখন আপুর হাসি দেখে কে! বলে, এমন ডক্টর হলে তো আমাদের খবর হয়ে যাবে। কিছু হলেই গরুর ইনজেক্শান নিয়ে দৌঁড়ানি দিবা! তখন হাসতে হাসতে দু'জনে কুটিকুটি হই।
র'আপুটা আমাকে সবসময় পিচ্চি পিচ্চি বলে ডাকে [যতই বড় হইনা কেনো আপুগুলো কেনো জানি সবসময় পিচ্চি ই ভাবে! ( ]। আমি মাঝে মধ্যে ভাব ধরি। মুখ গম্ভীর করে, রাগ, আহ্লাদী দেখিয়ে র'আপুকে বলি, আমি এখন আর পিচ্চি নই এখন আমি বড় হয়ে গিয়েছি...তখন অনেক মজা হয়। র'আপুটার সাথে সবকিছু নিয়ে কথা হয়। কথা বলতে বলতে মাঝেমধ্যে আমি আর আপু নিজেদের ভিতরে অনেক মিল খুঁজে পাই। তখন আমরা চিমটি কাটি। হিহিহি...হাসতে হাসতে আমার তখন একজনের কথা মনে পড়ে...
...
আপুকে আমি সারাক্ষণ জ্বালিয়ে মারি। কখনও আমার হতাশার কথা শুনিয়ে, কখনও গান শুনিয়ে। হিহিহি...
একদিন আপুটার সামনে এক B!t**'কে একটা গালি দিলাম। র'আপুটা আমার গালি শুনে হেসে গড়াগড়ি খেতে শুরু করলো। বলল, শুনেছি এটা নাকি বাংলা ভাষার সবচাইতে ভদ্র গালি! তোমার মুখে শুনে আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছে, তুমি যত বলছো আমার তত হাসি পাচ্ছে। হিহিহি...ঐ B!t**'এর কথা ভুলে আমিও ততক্ষণে হাসতে শুরু করলাম। পরে র'আপুটাকে সরি বললাম, তখন ওভাবে গালি দেওয়ার জন্য সরি। র'আপুটা বললো, আমি কি পর কেউ যে আমার সামনে গালি দিলে সরি বলতে হবে? তবে এখন থেকে আর গালি দিওনা। গালি দিলে তো ওদের আর কিছু হয়না। বরং তোমারই পরে খারাপ লাগবে। [বোঝাই যাচ্ছে এখনও আপুর কথা রাখতে পারিনি। তবে রাখতে চেষ্টা করছি ] আপুর কথা শুনতে শুনতে তখন আমার পুরোনো একটা ঘটনা মনে পড়ে...
কত অল্প সময়েই কত দূরের একজন মানুষ কত আপন হয়ে যায়! আবার কত অল্প সময়ে কত আপন কত কাছের মানুষ কত পর হয়ে যায়!
মাঝেমধ্য আমি র'আপুটাকে ধাঁধা জিগেস করি আর ভাবি এবার আপু পারবেনা, আপু দেখবে আমার কত্তো বুদ্ধি কিন্তু আপু সবসময় ধাঁধার উত্তর পেরে যায়। তারপর আমকে ঠোঁট ফুলিয়ে বসে থাকতে দেখে স্বান্তনা দিয়ে বলে, তোমার অনেক বুদ্ধি।ধাঁধাটা আমি আগেই জানতাম তো তাই উত্তরটা পেরেছি...হিহিহি...এই ধাঁধা নিয়ে আমার আর আপুটার মধ্যে একটা মজার ব্যাপাড় আছে যেটা শুধু আমরা দু'জন
জানি :!> :#> হিহিহি...
সেদিন র'আপুটার সাথে কথা বলতে বলতে কেন জানি মন খারাপ করে কেঁদে ফেললাম। আমার কাঁন্না দেখে আপুর হার্ট এ্যাটাক হবার দশা। গতকাল আমার জন্য টেনশান করে বোধহয় প্রেশার বেড়ে মাথা ঘুড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস ভাইয়া ছিলো! বাসায় এসে আমাকে বলার পর খুবই মন খারাপ লাগলো। ইচ্ছা করছিলো আপুকে জড়িয়ে ধরে একটু কাঁদি। যদিও সেটা প্রকাশ করলামনা। আবার কাঁদতে দেখলে কি না কি হয়!
আমি সবসময় দেখেছি আমার চাইতে অনেক বড় আপুরা আমার খুব ভালো বন্ধু হয়। আমার সমবয়সীদের সাথে সবসময় ঝগড়া লাগে। সেটা অবশ্য বন্ধুত্বের অন্য একটা পাশ [নাকি আমি ঝগড়াটে বলে... ]। আমার মনে হয় আপুরা এত ভালো বন্ধু হয় কারণ মেয়েদের স্বভাব হলো বন্য বন্য স্বভাবের মানুষদের tame করা। তাই আমার আপুরা সবসময় ওদের সব ভালো, সব মায়া আমার মধ্যে ঢেলে দিয়ে আমাকে tame করতে চায়, খুব সুন্দর করে সাজাতে চায়। ছন্নছাড়া বন্য আমি সবসময় ওদের ব্যার্থ করি। আমি আমি ই রয়ে যাই...আপুরা আবার নতুন উদ্যোমে আমাকে tame করতে শুরু করে!
আজকে আমার সব আপুদের জন্য আমার অনেক অনেক ভালোবাসা আর ধন্যবাদ রইলো। তোমরা আমাকে অনেক ভালোবাসো কিন্তু আমি কখনওই তোমাদের যোগ্য, তোমাদের মতো ভালো হতে পারলাম না। না হতে পারলাম ভালো ছোট বোন, না ভালো সমবয়সী বোন, না ভালো বড় বোন! অথচ আমার বড়, সমান, ছোট বোনেরা আমার জন্য কত্তো করো। তোমরা আমাকে যতই স্রোতের সাথে এগিয়ে যাবার শক্তি দাও আমি ততই স্রোতের বিপরীতে যাই। তবে এতটুকু বলতে পারি তোমাদের সবাইকে অনেক অনেক ভালবাসি...তোমাদের সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাকে এত আগলে রাখার জন্য, আমাকে সবসময় উৎসাহ দেবার জন্য...
****************************************************************************************
র'আপুকে নিয়ে লিখতে গিয়ে অন্য আপুদের কথাও চলে আসলো! তবে এই পোষ্টটা শুধুমাত্র র'আপুটাকে উৎস্বর্গ করে... র'আপুটা আমাকে অনেক উৎসাহ দেয়, হতাশ আমাকে অনেক আশাবাদী কথা শুনায়, অনেক আগলে রাখে। আপনাকে অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ আমার র'আপু হবার জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১১ ভোর ৬:২২