অ আ ক খ- মধুমাখা আমার এইসব বর্ণমালাকে পেয়েছি অনেক প্রানের বিনিময়ে। অ থেকে শুরু করে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত প্রতিটি বর্ণমালা যেন আমাদের প্রতিটি ভালবাসাময় অনুভুতির প্রকাশ যা আমরা কেবল বাংলায়ই প্রকাশ করতে পারি। অন্য কোন ভাষাতেই এতটা আবেগ আর অনুভূতিকে প্রকাশ করতে পারিনা আমরা। কিন্তু কেন? অন্য ভাষা বাংলার তুলনায় দূর্বল তাই? না, কারণ সেটি নয়। কারণ হল, এ ভাষায় জড়িয়ে আছে আমাদের রক্ত, জড়িয়ে আছে অনেক গৌরবের সাতকাহন আর জড়িয়ে আছে প্রগাঢ় মমতা। অনেক প্রানের বিনিময়ে আমরা প্রমান করেছি বাংলার সন্মান আমাদের কাছে পৃথিবীর সবকিছুর চাইতেই মূল্যবান। আমরা তাই ভুলতে পারিনা ২১ শে ফেব্রুয়ারী তথা ৮ই ফাল্গুন, ভুলতে পারিনা ১৯৫২।
আগুন ঝড়া এই ফাগুনে বারবার মনে পড়ে সেইসব দিনের কথা যখন পৃথিবীবাসি অবাক হয়ে দেখেছিল শোষন আর বঞ্চনায় পিষ্ট হয়ে যাওয়া দূর্বল এক জাতি কেবল মাত্র মাতৃভাষা বাংলাকে মর্যাদা দিতে গিয়ে নিজের জীবন কুরবান করতেও দ্বীধা করেনা। তখনই হয়ত এই গ্রহের অধিবাসিরা বুঝে নিয়েছিল, এ জাতিকে দাবিয়ে রাখা যাবেনা কোনদিনও।
ফ্ল্যাশব্যাক : তৎকালীন সময়ে বাংলা ভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালী সমাজে নিজেদের জন্য আত্ম-অন্বেষায় যে ভাষা চেতনার উদ্ভব ঘটে তারই সূত্র ধরে পূর্ব বঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চেও একটা ছোট খাট আন্দোলনের মুখোমুখি হতে হয় পাকিস্তান সরকারকে। ধীরে ধীরে দানা বাধা এই ক্ষোভের চরম প্রকাশ ঘটে ইংরেজী ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী। সকাল বেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে মাতৃভাষা বাংলার দাবীতে রাজপথে নেমে এলে পুলিশ তাদের উপর নির্বিচারে গুলি বর্ষন করে। এতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন অকুতভয় বীর ভাষা সৈনিক আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার ও আব্দুস সালাম সহ আরও কয়েকজন। এ ঘটনার প্রতিবাদ ক্ষুদ্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে সমবেত হন। পরের দিন ২২ শে ফেব্রুয়ারী সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ জানাতে পুনরায় রাজপথে নেমে আসে এবং মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গনে সকল শহীদদের গায়েবি জানাজায় অংশ গ্রহণ করে। ভাষা শহীদদের স্মৃতীকে অমর করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গনে ২৩ শে ফেব্রুয়ারী গড়ে উঠে একটি স্মৃতীস্তম্ভ যা তৎকালীন সরকার ২৬ ফেব্রুয়ারী গুড়িয়ে দেয়। ২১ শে ফেব্রুয়ারীতে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ( আওয়ামিলীহ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামি ইসলাম ও গনতান্ত্রিক দল, পূর্ব বাংলার এই চারটি বিরোধী দলের সম্মিলিত রুপ যুক্তফ্রন্ট হিসেবে পরিচিত।) নিরঙ্কুশ ভাবে জয়লাভ করলে ৯ই মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদ অধিবেশনে আমাদের প্রানপ্রিয় এই বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বিকৃতী দেয়া হয়।
আন্তর্জাতিক স্বিকৃতী : বাংলা ৮ই ফাল্গুন,১৩৫৯ তথা ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী যে চেতনায় উদ্দিপীত হয়ে বাঙালীরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মাতৃভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল ৪৮ বছর পরে আজ তা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বিকৃতী লাভ করেছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যরিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘহোষনার দাবী জানিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ হতে একটি প্রস্তাব পেশ করা হয়। প্রস্তাবে বলা হয়, যেহেতু ইউনেস্কোর উদ্দেশ্য সমূহের মূলে রয়েছে বিশ্বের ভাষাগুলোর অবস্থান যা জাতীয়তার ও জাতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে ঐতিহ্য সংরক্ষন ও উন্নয়নের সর্বাপক্ষা শক্তিশালী মাধ্যম সেহেতু এ দিবসের স্বিকৃতী কেবল ভাষাগত বৈচিত্র ও বহু ভাষিক শিক্ষাকেই উৎসাহিত করবেনা বরং বিশ্বে ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত ঐতিহ্যের পূর্ণ সচেতনতার জাগরণও ঘটাবে এবং সমঝোতা, সহিষ্ণুতা ও মতামতের ভিত্তিতে আন্তার্জাতিক সংহতিকেও উদ্বুদ্ধ করবে। ১৯৫২ সাল থেকে বাংলাদেশের মানুষ এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্মগ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশ কতটা ভাবগম্ভীর পরিবেশে এবং মমতার সাথে অদ্যবধি দিবসটি পালন করছে তাও এ সম্মেলনে যথার্থ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয় এবং পরিশেষে ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে ঘোষনা করা হয় আর তা ২০০০ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী থেকে জাতি সংঘের সদস্য দেশ সমূহের মধ্যে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে।
অহংকার থেকে অঙ্গীকার: মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারার যে আনন্দ তা বোধকরি আমাদের সবার জানা। নিজ নিজ ভাষার প্রতি মমতা মানুষ মাত্রেই রয়েছে কিন্তু ভাষার জন্য জীবন দানের নজির কেবল আমরাই সৃষ্টি করেছি পৃথিবীর বুকে। এ আমাদের গর্ব, আমাদেরই অহংকার। পৃথিবীর দরীদ্রতম দেশের মানুষ হয়েও সর্বোচ্চ অহংকারে ভাসতে ভাসতে আজ অঙ্গিকার করি- পরবর্তি প্রজন্মের কাছে নিজেদের এই সোনালী ইতিহাস তুলে ধরার এবং বাংলাকে চীরকাল মর্যাদার আসনে আসীন রাখার।
“আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার”