সকাল বেলা চুলে সর্ষের তেল মেখে ভদ্র সেজে স্কুলে যাওয়া ছাত্র-ছাত্রীর সারী। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম কেন আমি ওদের সাথে স্কুলে যেতে পারিনা, কেন আমি ঐ শহুরে দালানের ভেতর বসে পুতুল পুতুল ছেলেমেয়েদের সাথে পড়তে যাই, পিঠে থাকে বিশাল বইয়ের বোঝা! আম্মু কেন তুমি আমাকে ওদের সাথে পড়তে পাঠাওনা! মনের সেই আক্ষেপ মেটাতে আমায় নিয়ে যেত হত বাজারে, বাতাসা আর গান্ধী ঘোঁষের মিষ্টি খাইয়ে তবেই শান্ত করা হত আমায়। আহ! কিযে স্বাদের ছিলো সেই মিষ্টি! আমার সেই গান্ধী ঘোঁষ আর নেই, নেই তাঁর বিখ্যাত সেই মিষ্টিও। কেবল পড়ে আছে আঠালো রসে মুখ মাখামাখির স্মৃতি। আজ হাজার মিষ্টি খেয়েও পাইনা ঐরকম তৃপ্তি! জানিনা, আমার জিভের পরিবর্তন ঘটেছে নাকি ঘটেছে সময়ের পরাজয়।
হাঁট থেকে ফেরার পথে ছোটমামাকে দেখে বেদেনীদের মুচকি মিষ্টি হাসি- ওটা ছিলো মামার কাছে আরও বেশি মিষ্টি। দল বেঁধে ওরা চলত কোমরে বিছা আর পায়ে নুপুর নিয়ে রিনিঝিনি শব্দে। উঁচু করে বাঁধা খোঁপায় থাকতো বেলী ফুলের মালা। মনে মনে ভেবেছিলাম, বড় হয়ে বেদেনী হব। মামাকে বললাম- মামা , ওরা তোমায় দেখে হাসছে কেন? আমার তরুন মামা লাল হয়ে গিয়ে বলেছিলো,
"আমি কেমনে কমু?মনে হয় ওগো হাসি রোগ হইছে।"
- তাইলে ওরা কালিজীবন ডাক্তারের কাছে যায়না ক্যান? কালিজীবন মামাতো খুব মিষ্টি মিষ্টি গোল গোল ঔষুধ দেয়। ঐ ঔষুধ তো তিতা না, ওরা ঔগুলি খায়না ক্যান?
মামা আমার কট কট থামাতে বলে, "চুপ কর, এত কথা শুনলে ওরা ওগো বাক্সের সাপ ছাইড়া দিবোনে, ওরা কিন্তু অনেক পাঁজী।"
চুপচাপ হেঁটে চলতে চলতে ঘুঘুর ডাক শুনতাম আর মনে হত, আমাদের চিটাগাং এর বাসায় কেনো ঘুঘু ডাকেনা এমন করে , কেন পথের মাঝে এক শালিক দেখা যায়না, তাহলে আমি মামার মত বলতে পারতাম - "এহহেরে এক শালিক দেখলাম , আইজকা দিন খারাপ যাইবো।" কবরস্থানের পাশ দিয়ে যাবার সময় অজানা এক ভয়ে চোখ বন্ধ করে রাখতাম, মামা পড়তেন দোয়া,"আসসালমুআলাইকুম ইয়া আহলাল কবুর"। আমাকেও বলতেন, দোয়া পড় দেখবি ডর করবোনা। আজ আর আমার ডর করেনা, আজ আর মনে হয়না শ্মশান থেকে নীতাই মিষ্ত্রীর ভূতটা বুঝি উঠে এসে বলবে "আম্মা,আপনে দেখতে ঢাকার পাউরুটির মত।" নিতাই মিস্ত্রী মরেছে অচীন রোগে। মৃত্যর আগে তাকে আমার ভয় করত না কিন্তু মরার পরে কেবলি মনে হত সে বুঝি এই আমাকে ধরে কোলো নিয়ে বলবে তার সেই পুরাতন কথা, ভয় করত খুব। আজ আর সেই ভয় নেই, এখন আমি অনেক বড় হয়েছি অনেক বুঝি।
এতকিছু বুঝতে গিয়েই নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকা শিশুটাকে গলাটিপে নিজের হাতেই হত্যা করেছি, সবাই যেমন করে! প্রতিটা মানুষের ভেতরই লুকিয়ে থাকে কোমল একটা শিশু। জীবনের প্রয়োজন সেই শিশুটাকে ধীরে ধীরে হত্যা করতে থাকে আর নিজেকে ভুলতে থাকে। তবুও মাঝে মাঝে সেই শিশুটিই জেগে উঠতে চায় সব কিছু ছিঁড়ে ছুড়ে দিয়ে, ভেসে বেড়াতে চায় তার আপন ভুবনে। কিন্তু হায়রে জীবন! হায়রে জীবনের প্রয়োজন! বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ কতদূর চলে আসে , কত বড় হতে চায়! আর কত বড় হব! আমি যে বেদেনী হতে চেয়েছিলাম। আমি বেদেনীই হতে চাই, সভ্যতা আমি চাইনা।