এ বছরের সাহিত্যের নোবেল একটা কারণেই মনকে টেনেছে, কারণ বিজয়ী একজন কবি, টোমাস ট্রান্সট্রোমারের পর অনেকদিন বাদে একজন কবি পেলেন এই সম্মাননা। তিনি লুইস গ্লাক, আমেরিকান কবি, বয়স আশি ছুঁইছুঁই।
গ্লাকের কবিতায় ব্যক্তিচেতনা সুস্পষ্ট, একেকটা কবিতা এক্সিস্টেনশালিজমের নিখুঁত উদাহরণ, যেন সবকিছু লুটিয়ে যাক বা ধ্বংস হোক, বিনাশ ছাপিয়ে নিজের অবচেতন মন যে সৃষ্টির কথা বলে, কাব্যের ভাষায় আত্মঅস্তিত্বের সবল প্রকাশ দিয়ে সেটাই মুখ্য হয়ে ওঠে।
সহজ ইংরেজিতে লেখা, বিশেষণের বাহুল্য বর্জিত, গ্লাকের কবিতা এমন কিছু, যা একান্ত নিজের কথা, যা আগে কেউ কখনো ভাবে নি, ভাবলেও এভাবে প্রকাশ করে নি অকপটভাবে, সুতরাং এই পুরস্কার পাবার নিঃসন্দেহে সঙ্গত কারণ রয়েছে। নোবেল কমিটির ভাষায়, গ্লাকের কাব্যস্বর অনাড়ম্বর সৌন্দর্য্য দিয়ে ব্যক্তি অস্তিত্বকে করে তুলে সার্বজনীন।
তার দুটো কবিতার অনুবাদ পড়া যাক। এ আমার অতি দুর্বল কিন্তু অত্যুৎসাহী পদক্ষেপ।
ইচ্ছেপ্রকাশ
সেই যে ইচ্ছেটা প্রকাশ করেছিলে তুমি, মনে আছে?
আমিও কিন্তু অনেক কিছু নিয়ে ইচ্ছা প্রকাশ করি।
আমি অবশ্য মিথ্যে বলেছিলাম, প্রজাপতি প্রসঙ্গে আমার ইচ্ছে নিয়ে
যদিও আমি এই ভেবেও কৌতূহলী ছিলাম, কি নিয়ে ছিল তোমার সেদিনের ইচ্ছেপ্রকাশ?
আর তোমারই বা কি মনে হয়,
সেই প্রজাপতিটি দেখে আমার মন কি চেয়েছিল?
আমরা ফিরে আসব আবার
যেভাবেই হোক, আমরা একসাথে থাকব শেষ পর্যন্ত
তুমি হয়তো ভেবেছিলে এমন কিছুই, আমি জানি না।
আমি আসলে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলাম যেটা আমি সবসময় করে থাকি
আমার ইচ্ছেটা ছিল এসবের কিছুই নয়,
কেবল ইচ্ছে ছিল আমি যেন লিখতে পারি
আরেকটি কবিতা।
কল্পিত সাধ
তোমায় কিছু বলার আছে আমার;
প্রতিদিন মানুষ মরছে, কিন্তু না,
মৃত্যু কোন সমাপ্তি নয়- সূচনা
কারণ মৃত্যুই এনে দেয় জন্ম
মৃতবাড়িতে বিধবা আর এতিমের জন্মোৎসব
ব্যথামোচড়ানো হাতে প্রলম্বিত ভাবনার অবকাশ।
মৃত আপনজনের সমাধিতে
স্বজনদের কেউ হয়তো আসে প্রথমবারের মত।
এক অজানা ভয়ে
তাদের কেউ কাঁদে আবার কেউ কাঁদে না,
কেউ হয়তো কবরের দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে কিছু বলে,
এসব দেখে তুমি আর আমি হয়তো ভাববো,
মৃতব্যক্তির সাথে এ কেমন গায়েবি কথোপকথন!
তারপর তাদের কেউ হয়তো ছড়িয়ে দেয় একমুঠো মাটি
উন্মুক্ত সমাধি ছুঁয়ে।
এসব আনুষ্ঠানিকতা শেষে সবার মুখ গৃহ অভিমুখে,
মৃতবাড়িতে বাজে আগত মানুষের কোলাহল
সদ্য কবর হতে ফেরা বিধবা তার আসন পাতে রাজকীয়ভাবে
রাজাকে যেমন দেখতে আসে প্রজারা
তেমনভাবে অভ্যাগতরা সার বেঁধে এগোয়,
কেউ তার হাত ধরে, কেউ বা জড়িয়ে,
সহানুভূতির নিশ্চিন্ত প্রকাশে
বিধবাটি কেবল বাইরে মুখে বলে,
ধন্যবাদ আপনাদের আসার জন্য
কিন্তু ভেতরে তার অন্তর বলে,
তোমরা সবাই চলে যাও, কেন এসেছ?
আসলে বিধবাটি আবার ফিরে যেতে চায়
তার প্রিয়তমের সমাধিটিতে,
অথবা তার স্বামীর শেষমুহূর্তের হাসপাতালস্থ ঘরে,
সম্ভব নয়, সবই কল্পনা
তবু এটিই তার একমাত্র সাধ- ফিরে যাবার সাধ,
তাদের বিবাহলগ্ন যেমন এই তো সেদিনের কথা
তার বড় সাধ হয়
প্রিয়তম এসে তাকে আবার ফিরিয়ে দিক একটুখানি
সেই বিবাহস্মৃতির মতনই সজীব আরেকটি মুহূর্ত-
প্রথম চুমু।