ককেশাসের অবস্থান ইউরোপ এবং এশিয়ার সংযোগকেন্দ্রে, পূর্বে ও পশ্চিমে এ অঞ্চল যথাক্রমে কাস্পিয়ান ও কৃষ্ণসাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত, উত্তরে আছে রাশিয়া, এবং দক্ষিণে ইরান এবং তুরস্ক।
রুশ, পারসিক এবং তুর্ক জাতির মিলনস্থল এই অঞ্চলকে উত্তর এবং দক্ষিণ এ দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়।
দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে তিনটি স্বাধীন দেশ রয়েছে। আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, আজেরবাইজান।
উত্তর ককেশাসে কোন স্বাধীন দেশ নেই, তবে স্বাধীনতাকামী চেচনিয়া, দাগেস্তান, আবখাজিয়া, ওশেটিয়াসহ কিছু অঞ্চল রয়েছে যা রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত।
পার্বত্যঘেরা দক্ষিণ ককেশাসে প্রায় তিন দশক ধরে বিরোধ চলছে নব্বই দশকে স্বাধীন হওয়া দুই দেশ আর্মেনিয়া এবং আজেরবাইজানের মধ্যে, নাগর্নো কারাবাখ এর দখল নিয়ে।
একটু ইতিহাস
১৯২০ এর দশকে জোসেফ স্তালিন তিনটি সোসালিস্ট রিপাবলিক অঞ্চলে বিভক্ত করেন দক্ষিণ ককেশাসকে, যদিও নাগর্নো কারাবাখের মানুষের ৯০% আর্মেনীয় জনগোষ্ঠীর, তা সত্ত্বেও একে আজেরবাইজানের সাথে যুক্ত করা হয়, এবং পরাক্রমশালী স্তালিনের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ তখন সঙ্গত কারণেই আসে নি আর্মেনিয়া বা নাগর্নো কারাবাখ থেকে।
কিন্তু ১৯৮৭ সালে সোভিয়েত ঐক্য ভেঙে যেতে শুরু করে এবং এর ফলেই প্রথমবারের মত নাগর্নো অঞ্চলের আর্মেনীয় জনগোষ্ঠীর মানুষ কথা বলবার সাহস পায়। তারা নিজ দেশে একটি গণভোটের আয়োজন করে, যার উদ্দেশ্য মুখ্য উদ্দেশ্য আজেরবাইজান থেকে বের হয়ে হয় আর্মেনিয়ার সাথে সংযুক্ত হওয়া নতুবা, নিজেরাই স্বাধীনতা ঘোষণা করা।
এবং এর ফলেই নাগর্নোর দখল নিয়ে স্তালিন কর্তৃক বিভক্ত হবার প্রায় ৬০বছর পর দুটি দেশের মধ্যে বিরোধ শুরু হয় ছয় বছরব্যাপী একটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে (১৯৮৭-১৯৯৪), যার রেশ এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে দুটো দেশ।
এই যুদ্ধে নাগর্নোর সমর্থন নিয়েই এই অঞ্চল দখল করে নেয় আর্মেনিয়া, শুধু তাই নয়, যেহেতু এই অঞ্চলটি দখল করতে গিয়ে বেশ কিছু আজেরবাইজানি ভূমিও দখল করতে হয় আর্মেনিয়াকে, কারণ নাগর্নো অঞ্চল প্রকৃতপক্ষে আজেরবাইজান দিয়ে বেষ্টিত।
ফলে, এখন পর্যন্ত, বৈশ্বিক মানচিত্রে নাগর্নো আনুষ্ঠানিকভাবে আজেরবাইজানের অংশ কিন্তু, বৈশ্বিক স্বীকৃতি না পেয়েও এটি কার্যকরভাবে আজ আর্মেনিয়ার অংশ।
আর্তসাখ রিপাবলিক হল নাগর্নো কারাবাখের আর্মেনীয় নামকরণ।
কেন শান্তি আসছে না?
অভ্যন্তরীণ রাজনীতি
আজেরবাইজানে স্বধীনতার পর থেকেই ইলহাম পরিবার ক্ষমতায়, যদিও সাংবিধানিকভাবে গণতন্ত্র উল্লিখিত, তবে প্রকৃত অর্থে তা বলতে সে দেশে কিছু নেই। বরং কমিউনিস্ট ধাঁচের একদলীয় শাসনব্যবস্থাই সে দেশে পোক্ত। এই শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে এবং নিজেকে একচ্ছত্র শাসক হিসেবে বজায় রাখতে ইলহামের রাজনৈতিক দল নিউ আজেরবাইজান পার্টি সবসময়ই নাগর্নো কারাবাখ অঞ্চলকে তাদের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে তুলে ধরে।
অন্যদিকে, আর্মেনিয়ায় বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। ২০১৮ সালে বিরোধী দলীয় নেতা নিকোল পাশিয়ান প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তবে, টি আই বি এর মতে, গণতন্ত্র থাকলেও দুর্নীতি সে দেশের একটি বড় সমস্যা। আবার, সে দেশের রাজনীতিতে আর্তসাখ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বাদে এ পর্যন্ত নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর সবাই-ই মূল ভূখণ্ড আর্মেনিয়া নয়, আর্তসাখ হতে এসেছেন। এ কারণে, নাগর্নো কারাবাখ অঞ্চলে প্রাধান্য বজায় রাখা সে দেশের রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ভূ রাজনীতি
দেশগুলোর সম্পর্কের সমীকরণে ভিন্নতা এনে দেয় ভূরাজনীতির সমীকরণ। নাগর্নো কারাবাখ নিয়ে কিছু ভূরাজনৈতিক জাদুর উত্তর খোঁজা যাক, যে কারণে স্থায়ী কোন শান্তি এ অঞ্চলে আসছে না!
১.
ধর্মের সাদৃশ্য সত্ত্বেও কেন ইরান এবং আজেরবাইজান মুখোমুখি অবস্থানে?
ইরান এবং আজেরবাইজানের জনগণ জাতিগতভাবে ভিন্ন কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসে এক। দুদেশেরই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলামের শাখা শিয়া মতাবলম্বী। মজার ব্যাপার, পৃথিবীর সর্বত্র ইরান শিয়াদের পাশে উচ্চকণ্ঠ হলেও ঘরের পাশের এই প্রতিবেশীর নাগর্নো অধিকার নিয়ে তারা নীরব। এর কারণ কয়েকটি-
*তেল ও গ্যাসে কাস্পিয়ান সাগরে সমৃদ্ধ সমুদ্র মালিকানা নিয়ে দুদেশের বিরোধ।
* ইরানের উত্তরাঞ্চলে আজেরবাইজান সীমানা ঘেঁষে ইরানের অঞ্চল ইরানি আজেরবাইজান, যা জাতিগতভাবে আজেরবাইনি অধ্যুষিত, এই অঞ্চল কোন এক সময় আজেরবাইজান তার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, শক্তিমত্তা ও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জেরে দাবি করতে পারে, এই ভয় তেহরানের।
*আজেরবাইজানের ৬০% অস্ত্র সরবরাহকারী ইজরায়েল, বিনিময়ে আজেরবাইজানের তেল নেয় তেল আবিব। আবার, দু দেশই একে অপরকে স্বীকৃতি দিয়েছে, আজেরবাইজানকে স্বীকৃতিদানকারী দ্বিতীয় দেশ ইজরায়েল। দুদেশের এই সুসম্পর্ক তেহরান ভাল চোখে দেখছে না।
*তেহরানের ইচ্ছে, বাকুতে ইরানের মতই ইসলামিক সরকার প্রতিষ্ঠা, কিন্তু এ নিয়ে আপাতত আজেরবাইজানের জনগণ বা সরকার, কারোরই মাথাব্যথা নেই।
২. ধর্মের বৈসাদৃশ্য সত্ত্বেও সুন্নি তুরস্ক ও শিয়া আজেরবাইজান কেন পরস্পরের মিত্র?
তুরস্ক সুন্নি এবং আজেরবাইজান শিয়া হলেও কিছু কারণে এই দুইটি দেশ মিত্র, কারণ
*জাতিগতভাবে তারা তুর্ক জনগোষ্ঠীর, যা দুদেশের মধ্যে এনে দিয়েছে ঐক্য।
*উসমানীয় শাসনামলে তুরস্কের অধীন ছিল আর্মেনিয়া। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৫সালে প্রায় ২০লক্ষ আর্মেনীয়র ৫লাখকে তুর্কিরা নিশ্চিহ্ন করে দেয়, যার কারণ হিসেবে তুর্কিরা বলে, খ্রিস্টধর্মী আর্মেনীয়দের আনুগত্যের অভাব এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে। আজও আর্মেনিয়ার গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেয় নি তুরস্ক। শত্রুর শত্রু মিত্র, এই হিসেবে আংকারা শুরু থেকেই সমর্থন দিয়ে আসছে বাকুকে।
৩. জাতিগত (তুর্কি) ও ধর্মীয়ভাবে (ইসলাম)মিল থাকা ৩০০ কিমি দূরত্বের দুইটি দেশ তুরস্ক এবং আজেরবাইজানের মাঝে কেন স্যান্ডউইচের মত আটকে গেল ভিন্নধর্মী (আর্মেনীয় খ্রিস্টান) আর্মেনিয়া?
মানচিত্র লক্ষ্য করলেই এটা দেখা যাবে। এর কারণ-
*পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন খ্রিস্ট রাষ্ট্র আর্মেনিয়া, তৃতীয় শতকেই এ দেশ খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে। অথচ, পরবর্তীতে, এই অঞ্চলের পুবে ও পশ্চিমে ইসলামে দীক্ষা এলেও আর্মেনীয়রা তাদের ধর্মে থেকে যায় অটল। ষোল শতকে সুদূর বাংলার ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত আরমানিটোলা গির্জাও আর্মেনীয়দের ধর্মনিষ্ঠতার প্রমাণ।
*একাদশ শতকে তুরস্কের সেলজুক আমলে ৪০,০০০ তুর্ক পরিবার আজেরবাইজান অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়, পরবর্তীতে এরাই আজেরবাইজানের শাসনে অধিষ্ঠিত হয়, ফলে তুর্কি ভাষা আজেরবাইজানে গৃহীত হয় এবং বর্তমানে দুদেশেই জাতিগত তুর্কিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তবে পারস্য এবং ককেশীয়- দুই জনগোষ্ঠীর রক্তেরই সংমিশ্রণ রয়েছে আজেরবাইজানিদের রক্তে।
*অন্যদিকে, ধর্মের ক্ষেত্রে আজেরবাইজানের তুর্কি জনগোষ্ঠী সুন্নি নয়, শিয়া মতবাদ গ্রহণ করেছে, যা দক্ষিণে ইরানের মাধ্যমে ১৬ শতকে এ অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। কারণ, সে সময়ে পারস্যের সাফাভিদ সাম্রাজ্য আজেরবাইজান দখল করে এবং শিয়া ইসলামের বিস্তার ঘটায়।
৪. ধর্মীয় বিরোধের চেয়ে কেন আঞ্চলিক বিরোধ গুরুত্ব পেল?
খ্রিস্ট বনাম শিয়া ধর্ম বিরোধকে এই দেশের বিরোধের মূল কারণ বলে শোনা যায় না। এর কারণ,
*সাবেক সোভিয়েত হতে সৃষ্ট বলে, আজেরবাইজান সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। শুধু তাই নয়, আজেরবাইজানি লোকেরাও ইসলাম সম্পর্কে খুব বেশি সচেতন নয়। পিউ রিসার্চের জরিপ বলছে, মাত্র ২২% আজেরবাইজানি মানুষের ইসলাম সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান আছে আর মাত্র ১৮% আজেরবাইজানি নিয়মিত নামাজ আদায় করে!
*শিয়া সুন্নি বিরোধও এ দেশে নেই বললেই চলে, কারণ আজেরবাইজানিরা সুন্নি তুর্কি ও শিয়া ইরানিদের মাধ্যমে ইসলামের এই দুই শাখারই উত্তরাধিকার বহন করছে।
এ কারণে, আজেরবাইজানিরা ধর্ম নিয়ে উৎকণ্ঠিত নয়। তাদের মূল চিন্তা নাগর্নো ভূখন্ড এর অধিকার আদায় এবং এ কারণের দুদেশের বিরোধ ধর্মের বদলে আঞ্চলিক রূপ নিয়েছে।
৫. একই ধর্মের হলেও আর্মেনিয়াকে কেন প্রতিবেশী জর্জিয়া সমর্থন দিচ্ছে না?
জর্জিয়া এবং রাশিয়ার যথাক্রমে ওশেটিয়া অঞ্চলের দক্ষিণ ও উত্তর অংশ বহন করে, এবং এই অঞ্চল নিয়েই দুদেশের মধ্যে বিরোধ। দক্ষিণ ওশেটিয়া মূলত জর্জিয়ার হলেও কার্যত এর দখল নেবার জন্য রাশিয়ার সাথে কয়েক দফা যুদ্ধ হয়েছে জর্জিয়ার, কারণ রাশিয়া দক্ষিণ ওশেটিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা দিয়ে একে তাদের উত্তর ওশেটিয়ার সাথে যুক্ত করতে চায়।
আবখাজিয়া অঞ্চল নিয়েও এ দুটি দেশের বিরোধ রয়েছে।
এ কারণে জর্জিয়া প্রতিবেশী হয়েও রাশিয়ার ভাল বন্ধু নয়। আবার, প্রতিবেশী না হয়েও এই রাশিয়াই আর্মেনিয়ার ভাল বন্ধু। ২০১৮ সালে রাশিয়া উন্নত সামরিক অস্ত্র সরবরাহ করে আর্মেনিয়াকে, রুশ ঘাঁটিও রয়েছে সে দেশে। আর্মেনিয়ার সাথে রাশিয়ার এ মাখামাখির জন্য, জর্জিয়া তাদের ভূখণ্ড তুরস্কের জন্য উন্মুক্ত করেছে, যার মাধ্যমে কাস্পিয়ান সাগরের তেল গ্যাস আজেরবাইজান হয়ে তুরস্কে পৌঁছাবে।
৬. ইহুদিবাদী ইজরায়েলের সাথে কেন ভাল সম্পর্ক শিয়া আজেরবাইজানের?
মূল কারণ ইরান, যা ইরান অংশে বর্ণিত।
সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইজরায়েলের সাথে আজেরবাইজানের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। মূলত ইরানকে মোকাবেলা করতেই এই দুই দেশ একত্র হয়েছে।
৭. রাশিয়া এবং ইরান কেন সরাসরি কারো পক্ষ না নিয়ে আলোচনার আহবান জানিয়েছে?
রাশিয়ার সাথে আর্মেনিয়ার ভাল সম্পর্ক থাকলেও এখন আজেরবাইজানের সাথেও তারা সুস্পম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। কারণ আজেরবাইজানের সাথে ভাল সম্পর্ক রাখা তুরস্কের সাথে সুসম্পর্ক রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর তুরস্কের মাধ্যমে গ্যাস রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডে সরবরাহের একটি প্রকল্প বর্তমানে চলমান। তাছাড়া, রাশিয়া তুরস্ককে বিভিন্ন সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোবিরোধী অবস্থানের জন্যও তুরস্কের সাথে ভাল সম্পর্ক রাখা রাশিয়ার জন্য দরকার।
মধ্যপ্রাচ্য ও পরমাণু ইস্যুতে কোণঠাসা ইরান এখন সৌদিবিরোধী কাতার এবং ইজরায়েল বিরোধী তুরস্ক এর সাথে এক ধরণের অঘোষিত ঐক্য তৈরি করেছে। এ কারণে নাগর্নো বিরোধে তুরস্ককে চটাতে চায় না তেহরান। তাই ইরান দুইদেশের মধ্যে সংলাপের আহবান জানিয়েছে।
সব মিলিয়ে, ভূরাজনীতির জটিল প্রেক্ষাপটে নাগর্নো কারাবাখ ইস্যু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রত্যেক দেশের নিজ নিজ স্বার্থ বজায় রাখার একটি চমকপ্রদ উদাহরণ!
সহায়কঃ
Visualpolitik
Now This world
Aljazeera
TRT World
Roar Bangla
BBC Bangla
Hareetz
Pars Today
Pathshala Center for Basic Studies