পাকিস্তান জন্মপরবর্তী যুগে আমাদের প্রধান কথাকার জহির রায়হান।
যার লেখায় একই মোহনায় মিলেছে বাঙালি জাতির স্বরূপ অন্বেষা ও আবহমান জীবনধারা, যার লেখায় প্রতিবাদের উৎস হয়েছে দুরাচার ও শোষণ, যার লেখায় ছুঁয়ে গেছে মধ্যবিত্তের প্রণয় ও বিরহ, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অপরাজনীতিকে যিনি দাঁড় করিয়েছেন প্রশ্নের মুখে, সর্বোপরি অতীত চেতনা ও ভবিষ্যৎ স্বপ্ন নির্মাণ যার লেখায় একাকার হয়েছে বর্তমানের আদর্শে, তিনিই জহির রায়হান।
সমধিক পরিচিত তিনি উপন্যাস লিখে, তার পুরস্কারপ্রাপ্তির কারণও কথাসাহিত্যের এই মাধ্যম। তবে দুএকটি গল্প বাদে অনালোচিত থেকে গেছে তার লেখা গল্পগুলো, শিল্পের বিচারে যা কালোত্তীর্ণ!
বহতা নদীর মত প্রবহমান ছন্দ তার লেখায়, তার গল্পে দু-তিন শব্দের একটি ছোট বাক্য যেন একটি সশব্দ প্যারাগ্রাফ! একহারা গল্পগুলো লেখনির সহজতায় পরিপূর্ণ।
তাঁর রচনায় বারবার এসেছে একুশ, নানামাত্রিক আলোয় আমাদের একুশকে তিনি দিয়েছেন বর্ণাঢ্যতা।
আশ্চর্য এই, তার লেখা গল্পের সংখ্যাও একুশ সংখ্যক!
তার সৃজনশীল জীবনের সাথে যেন জড়িয়ে গিয়েছিল এই একুশ। চলচ্চিত্রে, গল্পে, উপন্যাসে। এটা বলার মত ব্যাপার এইজন্য যে, আর কারো লেখায় এত বিপুল রঙ ও ঘ্রাণ নিয়ে একুশ ফুটে ওঠেনি।
মূলত কয়েক গোছের গল্প লিখেছেন তিনি।
১. একুশ। একুশের গল্প, সূর্যগ্রহণ, মহামৃত্যু, কয়েকটি সংলাপ
২. মুক্তিযুদ্ধ। সময়ের প্রয়োজনে, ম্যাসাকার
৩. রাজনীতি। অতিপরিচিত, পোস্টার, ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি
৪. ধর্ম ও সংস্কার। একটি জিজ্ঞাসা, বাঁধ, অপরাধ, ইচ্ছা অনিচ্ছা, স্বীকৃতি
৫. প্রেম। সোনার হরিণ, হারানো বলয়, ভাঙ্গাচোরা
৬. গ্রাম। নয়া পত্তন
৭. শহর। জন্মান্তর, দেমাক
৮. প্রতীকী। কয়েকটি কুকুরের আর্তনাদ
যৌগিক, জটিল ও সরল বাক্যে কয়েকটি গল্পের সারমর্ম বলা যাক।
একুশ
একুশের গল্প-
একুশের মিছিলে নিহত তপু চার বছর পর কঙ্কাল হয়ে ফিরে আসে তারই মিছিলের বন্ধু, যে এখন ডাক্তারি পড়ছে, তার হাতে, মেডিকেল পড়ার অংশ স্কাল হিসেবে।
সূর্যগ্রহণ-
একুশের মিছিলে পোস্টার আঁকিয়ে তসলীম নিহতের খবর জানে না তার স্ত্রী হাসিনা কিন্তু মাস শেষে ঠিকই সংসারের টাকা পায় মেস মেম্বার আনোয়ার সাহেবের করুণায়, ফলে স্বামী বেঁচে আছে ভেবে আজও তসলীমকে সম্বোধন করেই চিঠি লিখে চলেছে হতভাগা বউটি।
মহামৃত্যু-
পাড়ার কেউ যাকে এতদিন চিনতো না, সেই অপরিচিত ছেলেটিই আজ সকলের অতি কাছের হয়ে ওঠে, একুশের মিছিলে মৃত্যুর পর, সারা পাড়া সাক্ষী হয় এক মহামৃত্যুর, যে মৃত্যুর ঈর্ষা করে পাড়ার শমসের আলী বলে ‘বড় হিংসে হচ্ছেরে, আমি কেন ওর মত মরতে পারলাম না!’
কয়েকটি সংলাপ-
বায়ান্ন, বর্তমান আর তারপর যথাক্রমে উচ্চারিত, উচ্চারণরত ও উচ্চারিতব্য কিছু শব্দমালা নিয়ে গল্প, অতীতে ভাষা রক্ষায় ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন, বর্তমানে আল্পনায়, রচনায়, এমন কি গাড়ির নাম্বার প্লেটে বাংলা রাখার অঙ্গীকারে শহীদ দিবস উদযাপন, ভবিষ্যতে কেবল একটি নয়- মুক্তির নিমিত্তে কয়েকটি শহীদ দিবস পালনের আত্মপ্রত্যয়।
মুক্তিযুদ্ধ
সময়ের প্রয়োজনে-
মুক্তিযোদ্ধাদের এক ঘাঁটিতে জনৈক সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহের জন্য পৌঁছার পর এক হারানো মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরি আবিষ্কার করে- যাতে বেদনার মত বেজে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের ব্যথা, পরিশেষে নানা গেরিলা যোদ্ধাদের যোগদানের নানা উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়, যার মধ্যে প্রধান কারণ ছিল- সময়ের প্রয়োজন।
প্রেম
সোনার হরিণ-
নববিবাহিত দম্পতি ঘর সাজাবার আকাঙ্ক্ষায় আসে এক ফার্নিচার দোকানে, দশ বছর পর সেই দোকানের একই কর্মচারী একই উদ্দেশ্যে পুনরায় আসতে দেখে, তবে কেবল স্বামীকে, যেন সাংসারিক সুখের ছোট্ট সোনার হরিণের খোঁজ চলছে আজও।
হারানো বলয়-
বলয় এখানে দুটি- প্রেমিকার চুড়ি এবং প্রতিবাদীর হাতকড়া- যার মালিক হল আরজু, আলমের প্রেমিকা, যে প্রেমের স্বপ্নে মগ্ন থেকে কেনে বালা আর পরবর্তীতে একদিন, আপত্তিকর প্রচারপত্র বিলি করতে পরতে বাধ্য হয় হাতকড়া।
ভাঙাচোরা-
টানাটানির সংসারে টুনু স্বামীর থেকে লুকোয়- এক মেসে নিজে রাঁধুনি হিসেবে কাজ করার কথা,
অন্যদিকে টুনুর স্বামী লুকোয় টুনু থেকে- অফিসের কাজ শেষে যে একবেলা রিকশা টানার কথা।
টুনুর ছোটোবেলার বন্ধু যখন সরকারি কাজের ফাঁকে একদিন টুনুর বাড়িতে আসে, তখন আগেরদিন রাতে চড়া রিকশার সেই রিকশাচালক, যে কিনা আসলে টুনুর স্বামী, তাকে সেখানে আবিষ্কার করে চমকে ওঠে।
ধর্ম ও সংস্কার
একটি জিজ্ঞাসা-
অবুঝ বালকের বড় বুঝদার প্রশ্ন তার দরিদ্র পিতার কাছে, যাদের টাকা আছে তারা গুনাহ করলেও বেহেশতে যাবে, কারণ তারা টাকা দিয়ে হজ কিনে নেবে, ফলে সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, অথচ তাদের মত যাদের টাকা নেই, এমন গরিবদের পাপমোচন কিংবা বেহেশত গমনের উপায় কী?
বাঁধ-
বন্যার জলে যাতে গ্রামের ফসল যাতে ভেসে না যায়- সে বিষয়ের উদ্যোগে স্পষ্ট দুভাগ হয়ে যায় গ্রাম-
একপক্ষ মসজিদের ইমামের নেতৃত্বে এক মহান পীরকে ধরে আনে, যার দোয়ায় ও আল্লাহর রহমতে রক্ষা পাবে বাঁধ,
অপরপক্ষ এক শিক্ষকের নেতৃত্বে এসবে গুরুত্ব না দিয়ে বরং বাঁধ রক্ষার কাজে নেমে যায়।
সারা রাত বৃষ্টি সত্ত্বেও তাদের পরিশ্রমের পর যখন বাঁধ শেষমেশ রক্ষা পায়, তখন সারা গ্রাম এর কৃতিত্ব দেয় সেই পীরকেই। তাদের বিশ্বাস এটা পীরের মোজেজা, আল্লাহর কুদরতি।
অপরাধ-
আশি বছরের পীর সাহেবের বৌ হিসেবে কিশোরী সালেহাকে ঠেলে দেয় তার বাবা, পরে বুড়ো স্বামীর অত্যাচারে যখন পালিয়ে আসে সে, উল্টো মার খায় বাপের কাছে।
এদিকে পীর রেগেমেগে বৌ খুঁজতে এসে তার বাপকে ফতোয়া দেয়- পালানোর অপরাধে একশ বেত্রাঘাত করা হবে সালেহাকে। ততক্ষণে খবর আসে বাপের অত্যাচারের শিকার মেয়েটি মারা গেছে। এ শুনে জনতা রায় দেয়- ‘মাগীটা মরবো না? পীর সাহেবের বদদোয়া লেগেছে’
স্বীকৃতি-
মনোয়ারা নিজে কখনো নারীবৃত্তের বাইরে যায়নি, না আন্দোলনে, না ঘরের বাহিরে। কিন্তু একটা প্ররোচনা ছিল তার কাজিন জামান থেকে- যার ফলে একসময় সে আবিষ্কার করে নিজের সাহিত্যিক সত্তাকে।
পরবর্তীতে বিবাহিত জীবনে নিজের কন্যা যখন সরকার বিরোধী প্রতিবাদে সম্পৃক্ত হতে চায়, তখন মনোয়ারা নারীবৃত্তের বাইরে বেরুনোর এই ইচ্ছেকে স্বীকার করে নেয়।
ইচ্ছা অনিচ্ছা-
কালবৈশাখীর ঝড়ে ধসে যাওয়া স্বামীহারা দরিদ্র বিন্তির ঘর পুননির্মাণের ক্ষেত্রে গ্রামবাসী বলে, হাজি বড়মিয়া থেকে টাকা ধার নিয়ে ঘর ঠিক করাতে। টাকা নিয়ে ঘর বাঁধার পর হুজুররা বলে, নতুন বাড়িতে আল্লাহ রাসুলের নামে মিলাদ পড়াতে ও মোল্লাদের খাওয়াতে, যাতে তাদের দোয়ায় ঘর টিকে থাকে। বিন্তি সেটাও করে।
কিন্তু নিশ্চিন্ত বিন্তি কিছুদিন পর আবিষ্কার করে, তার ঘর আবার এক ঝড়ে চালাসমেত ভেঙে পড়েছে। বিপদগ্রস্ত বিন্তি তখন মোল্লাদের থেকে শোনে,
‘খোদা তোরে পরীক্ষা কইরতাছেরে বিন্তি- তার কুদরতের শান কে বইলবার পারে!’
গ্রাম
নয়া পত্তন-
বৃদ্ধ শানু গ্রামের একমাত্র পাঠশালার পণ্ডিত, কিন্তু কয়েক বছর পর এক আকস্মিক ঝড়ে থুবড়ে পড়া জরাজীর্ণ স্কুলটি পুননির্মাণে তিনি সরকার ও জমিদার চৌধুরীর কাছে হাত পেতেও যখন ব্যর্থ হন, তখন গ্রামবাসী নিজ উদ্যোগে ও পরিশ্রমেই তৈরি করে স্কুলটি, আগের চৌধুরী স্কুল নাম পালটে দেয় শনু পণ্ডিতের স্কুল।
রাজনীতি
অতিপরিচিত-
আসলামের বান্ধবী ট্রলির বাবা একজন ব্যবসায়ী, তবে তার খুব দহরম মহরম সরকারের মন্ত্রী মিনিস্টারদের সাথে। আবার তিনি বলেন, তার আসল ঝোঁক নাকি বইপড়ায়, দিনের আটঘন্টাই পড়ে থাকেন লাইব্রেরিতে।
তবু দেখা যায়, তার জ্ঞান পক্ষপাতদুষ্ট, যেমন ভাষা বিষয়ে তিন বলেন বাংলা উর্দুর উৎস তিনি পড়েছেন এবং তদানুসারে তার মতে, বাংলা কুফরি ভাষা ও উর্দু ইসলামি ভাষা।
পরে, এই লোকই সরকারের শিক্ষা কর্মকর্তার উঁচুপদে আসীন হন কিন্তু একদিন আসলাম যখন তার লাইব্রেরিতে গীতাঞ্জলি পড়ছিল, তখন তা দেখে তিনি বলেন, ‘চমৎকার বই, মিল্টনের একখানা শ্রেষ্ঠ উপন্যাস!’
পোস্টার-
আমজাদ সাহেব, অফিস যাবার আগে সকালবেলা নিজের সদ্য রাঙানো দেয়ালে পোস্টার লাগাতে দেখে যিনি তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন, তিনিই সন্ধ্যায় অফিস হতে ফিরে স্তিমিত হন, কারণ সেই একই পোস্টারে লেখা থাকে ‘’ছাঁটাই করা চলবে না’- আর এই দাবি তার স্বার্থের সাথে মিলে যায়, কেননা আজ অফিসে সরকার ছাঁটাই করছে কর্মচারীদের, তাতে আছে তার নামও।
ইচ্ছের আগুনে জ্বলছি-
একজন ছবি পরিচালকের কয়েকটি ইচ্ছের সমষ্টি- কলেজের স্ট্রাইক করায় ভার্সিটিতে ভর্তি হতে না পারা বোনকে নিয়ে, একুশের ভোরে আন্দোলন করা বালক আজ পারমিটের লোভে দালালি করে সরকারের, সেই ছেলেকে নিয়ে, মানুষরূপী কিছু পশুদের নিয়ে, আইন সমাজ ধর্ম রাজনীতি দারিদ্র্যের দেয়ালে অবরুদ্ধ তরুণ নিয়ে।
শহর
জন্মান্তর-
মন্তু, যে তার দরিদ্রদশা কাটাতে বেছে নিয়েছে পকেটমারের জীবন। একদিন সে জনৈক ব্যক্তির পকেট মারতে গিয়ে ফিরে আসে, কেননা ঐ ব্যক্তির ক্ষুধার্ত পরিবার, ক্ষুধার্ত কন্যা ও বাড়ির জীর্ণতা মন্তুকে মনে করিয়ে দেয় তার অতীত দারিদ্র্যের কথা। সে বরং ঐ ব্যক্তির পকেটে গোপনে গছিয়ে দেয় কিছুদিন আগে চুরি করা এক আংটি, যা সে চুরি করেছিল তার প্রেমিকার জন্য।
দেমাক-
রহমত-মেহেরুন এবং রহিম শেখ-আমেনা দুই দম্পতি, প্রতিবেশী। রহমত জ্যোতিষী, রহিম বাসচালক।
রহমত একদমই দেখতে পারে না রহিমকে, কারণ গতর খেটে কাজ করে বলে রহিমের নাকি অনেক দেমাক!
একদিন বাস চালনায় আন্দোলনে বাসজানালার কাচ ভাঙায় চোখ হারায় রহিম, তার পরিবার পথে বসে। তবু হাল ছাড়ে না রহিম, চোখ হারিয়েও ভিক্ষা করে না সে, বরং পত্রিকা বিক্রি করে।
রহিমের এই দেমাক একদিন আবিষ্কার করে রহমত, সে অবাক বনে যায়।
জহির রায়হানের প্রতিটি গল্পই যেন গভীর ইঙ্গিতবাহী, মনে ছাপ রেখে দেবার মত সংবেদনশীল।
তার গল্পের ফ্রেমে বন্দী হয়ে আছে সে সময়ের মুহূর্তগুলো। তা ছাপিয়েও আসলে গল্পগুলো চিরকালীন, দিনশেষে এগুলো এই সমাজের, এই দেশের, এই মানুষেরই গল্প।