১. ডিসেন্টারিং
একটা বস্তু বা ঘটনার বিভিন্ন দিক ও দৃষ্টিকোণ অনুধাবন করা, সেসব হবার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে পারা এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারা।
ইংরেজিতে সেন্টার বলতে বোঝায়, যেকোন নির্দিষ্ট বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত থাকা। অন্যদিকে, ডিসেন্টারিং বোঝায়, একটি বস্তু বা ঘটনা মানেই একটা নির্দিষ্ট ফলাফলে কেন্দ্রীভূত থাকা নয়। অতিসরলীকরণ এর বিপরীতই হল ডিসেন্টারিং।
একটি ঘটনা কিংবা বস্তু বহুবিষয় ও ফলাফলকে নির্দেশ করতে পারে। তাতে কতদিক থেকেই না আলো ফেলা যায়, কত সিদ্ধান্তে আসা যায়। সেই অন্ধ লোকদের হাতি দেখার মত, একেকজন একেক জায়গা থেকে দেখে একেক রূপে কল্পনা করেছিল হাতিকে।
তবে ডিসেন্টারিং মানে কিন্তু খণ্ডিত ধারণা নয়, বরং এসকম খণ্ডিত ধারণার সমণ্বয়। আপনি যদি দোকানে টিশার্ট কিনতে যান, তাহলে কেবল রঙ নয়, কাপড়ের গুণাগুণ, নকশা ও আকারও বিবেচনা করেন- তবেই সবচেয়ে ভাল শার্টটি কিনতে পারবেন। বা ধরেন, আপনি একটা পরীক্ষার ফলাফলে খারাপ করলেন। তাহলে আপনি তখন পড়াশোনার ঘণ্টা বাড়াতে পারেন, জটিল বিষয়গুলো গুছিয়ে আনতে পারেন কিংবা আরো ভাল বই কিনতে পারেন, অর্থাৎ ভাল করবার জন্য কেবল এক জায়গায় আটকে না থেকে ডিসেন্টারিং করতে পারেন।
যার ডিসেন্টারিং করার ক্ষমতা যত ভাল, তার ফলাফল পাবার সম্ভাবনাও তত ভাল হবে। আর তাদেরই ডিসেন্টারিং করার ক্ষমতা ভাল, যাদের কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট ভাল, মানে বুদ্ধি, যুক্তিবোধ ও বাস্তবজ্ঞান বেশি।
২. কগনিটিভ ডিজোনেন্স
এর মানে হল কথা ও কাজে বিপরীত মনোভাব। নিজ মূল্যবোধ ও আদর্শের সাথে দ্বন্দ্বাত্মক কোন কার্যকলাপ। বিশ্বাস ও আচরণের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতা।
যেমনঃ আপনি নিজেকে দেশপ্রেমিক দাবি করেন অথচ দেশের পণ্য ওয়ালটন না কিনে আপনি কিনলেন কোরিয়ায় বানানো স্যামসাং। এই ধরণের ব্যাপারই হল কগনিটিভ ডিজোনেন্স।
হিপোক্রেসিও এক ধরনের কগনিটিভ ডিজোনেন্স। তবে পার্থক্য হল, হিপোক্রিট লোকজন নিজে যা করে না, অন্যকে সেটা করতে উৎসাহিত করে, বা কাজটা প্রমোট করে, বা কাজ করার জন্য কাউকে প্রভাবিত করে।
কগনিটিভ ডিজোনেন্স কে জাস্টিফাই করতে অর্থাৎ কথা ও কাজের মধ্যে সমণ্বয় আনতে মানুষ অনেক কিছু করে থাকে। এই ঘটনর ধরণ বিশ্লেষণে এই অংশটাই সবচেয়ে চমকপ্রদ।
খুব কম ক্ষেত্রেই, কথা ও কাজে অসামঞ্জস্য থাকলে মানুষটি লজ্জা পায়, নিজেকে অপরাধী মনে করে অথবা তর্ক এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই সে নিজের মত করে যুক্তি রচনা করে বা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। যেমন, ঐ দেশপ্রেমিককে বলা হল, আপনি কেন ওয়ালটনের বদলে স্যামসাং কিনলেন? তখন সে হয়তো যুক্তি দেবে, গ্যাজেট যেটা ভাল, আমি সেটাই ব্যবহার করি; অথবা নিজের পূর্ববিশ্বাসকে পালটে বলবে, আমি তো দেশপ্রেমিক নই। এভাবে তারা নিজের বিশ্বাসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ কাজকারবারকে জায়েজ করে।
নিজের পূর্ববিশ্বাসকে অটুট রাখার জন্য নতুন কোন তথ্য বা কাজ সহজে গ্রহণ করতে চায় না। যেমন, একজন আপনাকে বলল, আমি প্রতিদিন অফিস শেষে ক্লান্ত থাকি, তাই তোমার সাথে দেখা করার জন্য আসতে পারি না। কিন্তু আপনার বেলায় যখন আপনার অন্য কাজের দরুণ ক্লান্তি থাকে এবং আপনি আসতে পারেন না, তখন সে আপনার এই তথ্য গ্রহণ করবে না। অথচ, তারই নীতি অনুযায়ী তার উচিত ছিল আপনার আসতে পারার অসামর্থ্যকে মেনে নেয়া।
অনেকে রিকনসাইল করে অর্থাৎ স্বার্থত্যাগের মাধ্যমে আপোস করে বিশ্বাস ও কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে, যেটা করা সবচেয়ে কঠিন কাজ। যেমন, ঐ ব্যক্তি ওয়ালটনের ফোন কিনলো, এতে করে সে স্যামসাং এর তুলনায় স্মার্টোফোনের কিছু লেটেস্ট ফিচারসুবিধা জলাঞ্জলি দিল, কিন্তু বিশ্বাস ও কাজে অনুরূপ থাকলো। এ ধরণের সমরূপ আচরণ সবসময় বজায় থাকলে তাকে বলে, কগনিটিভ কনজোনেন্স।
৩. এন্টিসোস্যাল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার
এন্টিসোস্যাল বলতে আমরা সাধারণ অর্থে সমাজে মিশতে না পারা কিংবা অন্তর্মুখী মানুষদেরই বুঝে থাকি। তবে, মজার ব্যাপার হল, সমাজে মিশতে পারা ও সমাজে চলাফেরা করা মানুষদের মধ্যেই কিন্তু এন্টিসোস্যাল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার দেখা দেয়।
সমাজ মানে মানুষের সুখ ও দুঃখ, প্রয়োজন ও সৌন্দর্য, আনন্দ ও বিষাদ- সবকিছুরই আবাস। সমাজ সেটাই, যেখানে থাকে মানুষে মানুষে থাকে ঐক্য, শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া। এই গুণগুলো থেকেই আসে আচরণগুলো, যেমন- বিপদে পাশে দাঁড়ানোর মনোবৃত্তি, আনন্দ ভাগাভাগি করার মানসিকতা, সবার প্রতি প্রীতিময়তা।
পক্ষান্তরে এর বিপরীতগুলোই কিন্তু সমাজবিরোধী গুণ। যেমন, অন্যের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতা, সংবেদনশীলতা ইত্যাদি না থাকা। শুধু তাই নয়, কারো অন্যের ক্ষতি করবার প্রবৃত্তি যদি থাকে, নিজ স্বার্থ উদ্ধারে যদি নীতিহীন কাজে যুক্ত কিংবা অন্যের খারাপ কিছু করতে অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয়, তাহলে সে এন্টিসোস্যাল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারে ভুগছে।
মানুষের সুবিধা অসুবিধা তখনই একজন এন্টিসোস্যাল পার্সোনালিটির মানুষ বিবেচনা করে না, যখন তার মধ্যে এম্প্যাথির অভাব থাকে। এম্প্যাথি ব্যাপারটা এমন- একজনের জুতা পরতে অসুবিধা হচ্ছে, তখন জুতাগুলো নিজের পায়ে গলিয়ে দেখা যে, পরতে কেমন বোধ হয়, পক্ষান্তরে তার পরতে যে অসুবিধা হচ্ছে, তাতে তাকে কিছু হৃদ্যতাপূর্ণ বাণী শোনানো হল সিম্প্যাথি।
মানুষের দুঃখে অভিভূত না হয়ে বরং তাদের হৃদয়ে ব্যথা দেয়াও এন্টিসোস্যাল পার্সোনালিটির উদাহরণ। এই ধরণের আচরণকে বলে স্যাডিস্টিক বিহেভিয়ার।
ধরুন, আপনি দশজন বন্ধু নিয়ে একটা ট্যুরে গেলেন। দশজনের মধ্যে দু’জন একটা ছোটখাটো কিন্তু সর্বজনহিতকর প্রসঙ্গে কিছুতেই স্যাক্রিফাইস করছে না, অথচ বাকি আটজনের দিক চিন্তা করে তারা গোয়ার্তুমি না করলে ব্যাপারটা খুব সুন্দরভাবে হয়ে যায়, ট্যুরে শান্তি বজায় থাকে। তাহলে বুঝতে হবে, ঐ দুজনের মধ্যে সামাজিক গুণাবলির সুষ্ঠু বিকাশ ঘটেনি।
এই আচরণ আসলে মানুষের চরিত্রের ক্লাস্টার বি ডিজঅর্ডার- এই গ্রুপের ১০টি ডিজঅর্ডারের মধ্যে একটি।
৪. ইগোসেন্ট্রিজম
অন্য কারো দৃষ্টিকোণ নয়, বরং কোন ঘটনাকে কেবল নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করাই হল ইগোসেন্ট্রিজম। এটা আসলে, নিজের ও অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আলাদা করতে পারার অক্ষমতা।
Jean Piaget তার থিওরি অফ কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট এ সর্বপ্রথম এই শব্দ ব্যবহার করেন। জন্ম থেকে কৈশোরপরবর্তী পর্যন্ত মানুষের জীবনকে চারপর্বে ভাগ করে তিনি এই থিওরি দেন, যাতে শিশুরা কিভাবে তাদের জ্ঞানকে গড়ে তোলে তার বিবরণ আছে।
০-২ বছর বয়সে একটা শিশুর যে ইগোসেন্ট্রিজম, তা পুরোপুরি তার মোটর স্নায়ু এর ওপর নির্ভরশীল। এটি ব্যবহার করে সে আশেপাশ সম্পর্কে ধারণা পায়। ২-৭ বছর বয়সে অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে তারা অবগত হয় এবং নিজের সাথে অন্যের ধারণার সমন্বয় করতে থাকে। যেমন- এ বয়সী একটা মেয়ে তার মামাকে খুব ভালোবাসে, আবার মামাও ভাগ্নিকে গিফট দেয়, ভাগ্নি মামার গাড়িতে করে শিশুপার্কে যায়, মামার দোকানে সে আইসক্রিম খায়। এসব দেখে ভাগ্নি ভাবে, তার মামার সবকিছুই বুঝি তার, গাড়িটা তার, দোকানটা তার। কিন্তু মামার দৃষ্টিকোণ অর্থাৎ মালিকানা বিবেচনার ক্ষমতা তার থাকে না। এটাই ইগোসেন্ট্রিজম।
পরিণত বয়সেও এই দিকটি দেখা যায়, তবে অন্যভাবে, যার উদাহরণ- ফলস কনসেনসাস এফেক্ট। এই এফেক্ট বোঝায়, একটা গ্রুপ কোন প্রসঙ্গে যা ভাবছে, সেই গ্রুপের মানুষজন ভাববে, অন্য সকল মানুষও বুঝি সেটাই মনেপ্রাণে তা মান্য করে! যেমন- একটা আদর্শবাদী দলের সব নেতারা একত্র হয়ে বলছে, তাদের আদর্শই শ্রেষ্ঠ এবং তা সমাজের সকল মানুষের চিন্তাধারার সাথে মিলে যাবে অথচ সাধারণ মানুষ আসলে সেই দলের মতবাদ বলতে গেলে পছন্দই করছে না। কাজেই সেই দলটি অন্য মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে আমলে নিচ্ছে না, এটাই তাদের ইগোসেন্ট্রিজম। এটা যে ধরণের বায়াস থেকে আসে, তা হল ইগোসেন্ট্রিক বায়াস।
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নিজেদের ধ্যানধারণার ভালো-খারাপ বিবেচনা এবং অন্যদের চিন্তাধারার ভাল দিক গ্রহণ করা- এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় থাকলে ইগোসেন্ট্রিজম কাটানো যায়।