আলতাদিঘি বাস্তবিকই আলতারঙা, তবে সেটা কেবল শরতে, যখন ঘোর লাল পদ্মে মেতে উঠে পুরো দিঘির আনাচ-কানাচ। বিপরীতে আমরা দেখেছি স্বচ্ছতোয়া, টলমল, দীঘল দিঘি। এই রূপ মেলে শীতকালে। সাথে উপরি পাওনা হিসেবে থাকে অতিথি পাখির কলতান, ওড়াওড়ি।
নওগাঁর ধামুইরহাটে ভারতের সীমানা ঘেঁষে থাকা এই জনবিরল আর শ্যামলকোমল দিঘির নামটা অনেকেরই অজানা। আমরা সেই নামের আকর্ষণেই ছুটে যাই সেখানে। যদিও এর নামকরণের পেছনে আলতা নামের কোন মেয়ে দায়ী নয়। অনেককাল আগে, পালযুগে, এখানকার রাজা তার রানীর আবদার পূরণ করতে এই দিঘি খোঁড়েন। রাজা তাকে শর্ত দেন যে, তিনি যতদূর হাঁটবেন, লম্বায় ততটাই হবে সেই দিঘি। দেখা গেল, রানি হাঁটতেই থাকেন, থামার জো নেই। তা দেখে চিন্তিত হন রাজা, কারণ শেষে না জানি তাকে কয়েক মাইল লম্বা দিঘি খুঁড়তে হয়! তাই তখন রানির পায়ের কাছে কৌশলে আলতা ছড়িয়ে দিল রাজার পাইকপেয়াদারা। আর সাধারণ মানুষ রক্ত ভেবে হা-হা করে উঠল, এত কষ্ট করে হাঁটছেন রানি! সুতরাং রানিকে অবশেষে থামতে হল। আর রাজারও খননজনিত দুশ্চিন্তা দূর হল। অবয়ব পেল দিঘি, নাম হল আলতা।
কয়েকশ বছর আগের এই দিঘির আশেপাশেও যেন সেই সময়কার চিহ্ন রয়ে গেছে। দোচালা মাটির ঘর, জগদল নামক বৌদ্ধ বিহার। আছে বাংলার প্রাচীন বৃত্তিজীবী সম্প্রদায় কৃষক আর তাদের চিরায়ত ধানক্ষেত। বিশাল সংরক্ষিত শালবনের মধ্যে একচিলতে লম্বা জায়গাজুড়ে এই দিঘি। আমরা বন পেরিয়ে দিঘির পাশে এসে দাঁড়াই। দিঘির চারদিক ঘিরে সংকীর্ণ একটি পায়ে সিমেন্টে ঢালাই হাঁটার পথ, তার দু'পাশে সারি সারি ইউক্যালিপটাস ছায়া দিচ্ছে।
একজোড়া রাজহাঁস দিঘির পাড়ে কাদাজলে পা ডুবিয়ে আছে। তারা ঘনবনের ছায়া ছাড়িয়ে এই শীতবিকেলের শেষ রোদ্দুরে রোদ পোহায়। আরো কিছুদূর এগিয়ে দেখা যায় একদল হাঁসছানা, তারা ব্যস্ত জলসেচনে। পুষ্পবিহীন পদ্মের সবুজপাতা দিঘির আঁচলের পাড়জুড়ে ঠাঁই নিয়েছে। তবে দিঘির স্বচ্ছ জমিনে আসল নকশা তৈরি করেছে কয়েকশ ভেসে বেড়ানো অতিথি পাখি। চুপচাপ থাকলে মনে হয়, দূর থেকে ভেসে আসছে অতিপ্রাকৃত কোন সুর। প্রায়ই তারা ঝাঁক বেঁধে দিঘীর এপার-ওপার যাতায়াত করে। এসব দেখে ভাবি, জনবিরল এই দিঘির এরাই বুঝি প্রধান অধিবাসী।
দিঘির শেষ মাথার দিকে এগোই। কয়েকটা জমি পার হয়ে ওপারেই ভারত। এখানে এক বিচিত্র ব্যাপার দেখি। একজন শতচ্ছিন্ন সকরুণ চেহারার এক বুড়ি চিৎকার করতে করতে সীমান্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তার সাথে তিনচারটা ছাগল। তার চেহারায় বাঙালিত্বের ছাপ নেই, ভাষাও আঞ্চলিক নয়, দুর্বোধ্য। ভাবি, ছাগলকে ঘাস চরাতে নিয়ে যাচ্ছে সামনেই, যেখানে কাঁটাতারের পাশে পড়ে আছে একখন্ড অনাবাদি সবুজ জমি।
ভারত সীমান্তে এসে আলতাদিঘির সীমানা শেষ। দিঘীর পাড়ে বাঁশনির্মিত আসনে একজন মাঝবয়েসী লোককে বসে থাকতে দেখি। তার চোখে কালো চশমা, পরনে শীতপোশাক, চুল কাঁচাপাকা। বাদাম, বুট, চানাচুর ইত্যাদি সামগ্রী নিয়ে তিনি বসে আছেন আমাদের মত পর্যটকদের জন্য, সামান্য কিছু বিক্রির আশায়।
খানিক পরিচিত হবার পর তার কাছেই শুনি সেই বুড়ির কাহিনি। এখানকার আলতাদিঘি গ্রামেই নবতিপর মানুষটির নিবাস। তারা উপজাতি এবং এরকম বেশ কয়েক ঘর উপজাতি আছে এখানে। তাদের অনেক আত্মীয়স্বজন কাঁটাতারের ওপারে। এজন্য নিয়মিত ওদিকেও যাতায়াত করে তারা। আমরা বলি,
বিএসএফ আটকায় না?
-নাহ, ওরা তো স্থানীয়। এরকম অনেকে দিনে যায়, দিনেই চলে আসে। আর গেলেও সীমানার ধারে জমির কাছে যায়, চাষবাস করে।
যদিও আমরা কোন চাষের ক্ষেত দেখলাম না ওদিকে। বরং আমাদের কাঁটাতারের বেড়া আর একটা ক্যাম্প দেখালেন সেই বিক্রেতা। অনেক বছর ধরে আছে, তাই বুঝি স্থানীয়দের বিএসএফ কিছু বলে না! এজন্যই একেবারে সীমানার কাছাকাছি যেতে সাহস করল সেই বুড়িটা! অথচ আসকের সংবাদ, ভারতীয় সীমান্তে প্রতি বছরই গড়ে নিহত হচ্ছে পঞ্চাশজন বাংলাদেশি, বিবিসি বলছে পঞ্চগড়ের সীমান্তে কৃষিকাজ করতে গেলেই নানা প্রশ্নের জবাব দিতে হয় বাংলাদেশি কৃষকদের। তাই এমন সাহসী দৃশ্য দেখে আমাদের চক্ষুকর্ণের বিবাদ লেগেই থাকল।
বিক্রেতা লোকটার সাথে আরো আলাপ জমে। তিনি চোখে ভাল দেখেন না, তাই এই চশমা। পরিবার নিয়েই তিনি দিঘির পাশে এক ঘরে থাকেন। ঘরটা ঘন গাছের আড়ালে লুকোনো। এক ছেলে, এক মেয়ে, সাথে স্ত্রী। তারা সবাই এই মুহূর্তে দিঘির পাড়েই আছে। যেন এই দিঘিই এখন তার পরিবার। স্ত্রীটি মাঝবয়েসী মহিলা, তিনি ছোট ছোট কিছু মাছ বাছেন। আর ছ-সাত বছর বয়েসী ছেলেটা আমাদের কিছু বাদাম মোড়কবন্দি করে দেয়। আমরা টাকা দেই। মেয়েটা সদ্য স্কুল থেকে ফিরেছে। বাংলার এই প্রান্তীয়, প্রত্যন্ত এলাকা সত্ত্বেও এখন সবাই ছোট পরিবার গড়ে তুলেছে, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবাই স্কুলে যায়। ব্যাপারটা স্বস্তিদায়ক।
আলাপের মাঝে তিনি বলেন,
-জানেন, একবার এক বাঙালি ধরে নিয়ে গেছে বিএসএস। সে আসছিল এখানেই, ঘুরতে। এখানে যারাই আসে, আমরা তাদের ওপর নজর রাখি। কেউ অনৈতিক কাজ করলে পুলিশকে জানাই। কিন্তু সেবার ছেলেটা এমন কিছু করে নাই। খালি বেশ কয়েকজনকে সাথে নিয়ে চিল্লাফাল্লা করতে করতে সীমানার ওদিকে গিয়েছিল। পরে ভুলে জিরো লাইন ক্রস করায় বিএসএফ এসে তাদের ধরে ফেলে। আমরা বিজিবিসহ গিয়ে ঐ ছেলেকে ছাড়িয়ে আনি।
আমরা বলি, আপনারা জীবিকা ছাড়াও এখানকার নিরাপত্তার দিকটাও দেখভাল করছেন।
প্রশংসা শুনে তিনি বলেন,
-হ্যাঁ ভাই, আর আমি চোখে কম দেখলেও এইখানে বসে কিন্তু সবকিছুই বুঝতে পারি।
তার চশমা ভেদ করা চোখের দৃষ্টি তখন সামনের ভারতীয় সীমান্তপারে, পেছনে কেবল বেঁচে আছে আলতা দিঘি। কালো চশমায় প্রতিফলিত হতে থাকা ওপারের ছবি যেন অপার্থিব, অচেনা, অজানা। মৃত।
জাতীয়তাবাদের মত কাল্পনিক কিন্তু শক্তিশালী বোধ মানুষকে একত্র করছে এটা সত্যি। তেমনি তা অযাচিতভাবে মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে বন্ধনহীন দূরত্বে। বহুযুগের পুরনো সেই ক্ষত আজও লালপদ্মের মত ছোপ ছোপ লেগে আছে এই নীরব নিষ্কলুষ আলতাদিঘির সবুজ জলজমিনে।