পাবনা শহর থেকে ঈশ্বরদী নতুন রেল চালু হয়েছে কিছুদিন আগে। অবসরে পাতায় পড়েছিলাম, নতুন স্টেশনটি কেমন এক বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে পাবনাবাসীদের জন্য। তার প্রমাণ সেখানে গিয়েই হাতেনাতে পেয়ে গেলাম, ট্রেনযাত্রায় আমাদের সহযাত্রীদের কথা শুনে।
ফাঁকা বগিতে হঠাৎ ঝনঝন শব্দ।
সন্ধ্যা ৭.৫০ এ পাবনা এক্সপ্রেস ট্রেন ছেড়ে যায় ঈশ্বরদীর দিকে। সেই ট্রেনে চেপে বসি আমরা। ভাড়া মাত্র ৪৫টাকা। কিছুক্ষণ আগে শহরে ঘুরে জানলাম, সিএনজিতে চড়েও ঈশ্বরদীর দিকে যাওয়া যায়, তবে ভাড়া ৫০টাকা। তাছাড়া রাত যত বাড়ে, সিএনজির রেটও প্রতি এক ঘন্টায় পাঁচ টাকা বা দশ টাকা করে বাড়ে। অথচ এই ট্রেন কিনা পুরো ফাঁকা! সুবিধা পেয়েও মানুষ কেন ট্রেনে চড়ে না, ঠিক বোঝা গেল না। একটা কারণ হতে পারে, শহর থেকে বেশ বাইরে ভাঙ্গা রাস্তা পেরিয়ে এই স্টেশন আসা লাগে, রিকশা ভাড়ায় চলে যায় ৩০-৪০টাকা।
দিনের আলোয় পাবনা স্টেশন।
ট্রেনের টিকেট, ভাড়া ৪৫টাকা।
এই ফাঁকা বগিতে আমরা ছাড়া যাত্রী বলতে কেবল দুইজন মহিলা আর দুই পিচ্চি। তাদের সাথে কোন ব্যাগ বা মালপত্র দেখি না। আমাদের ঠিক বিপরীত পাশের দুই সিটই পেয়েছে তারা। ট্রেন চলা শুরু করতেই তারা বাম পাশের ফাঁকা সিটগুলোয় চলে যায়। ছাড়ার দশ মিনিট পরেই তাদের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দেয় ট্রেনে আকস্মিকভাবে ছোঁড়া পাথরে জানালার ভাঙ্গা কাচের ঝনঝন শব্দ।
প্রথমটায় অবশ্য আমি কিছুই বুঝি নি। ভাবি, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট হয়েছে নাকি! উঠে দাঁড়িয়ে দেখি, সামনে থাকা রেলকর্মীরা মাথা নুইয়ে ফেলেছে। দেখে ভাবি, গোলাগুলি শুরু হল নাকি, সিনেমায় যেমন দেখি! তারপর মুহূর্তেই ফাঁকা বগিটিতে রেলপুলিশ ও গার্ডদের চাঞ্চল্য শুরু হয়। তাদের কথা শুনে বুঝি, জানালার গ্লাস ভেঙ্গেছে। ফাঁকা বগির সিটগুলো বেঢপ করে চেয়ে আছে, একটা নীরব আতঙ্ক ছোঁয়াচের মত ছড়িয়ে পড়ে আমাদের মধ্যে ।
আমাদের পাশে সহযাত্রীরা আতঙ্কিত, তাদের কলামেই পেছনের সিটে জানালার গ্লাস ভেঙ্গেছে। বয়স্কজন মহিলাটি আমাদের বললেন, 'আমি দেখিছি, কটা ছাওয়াল...পাথর মাইরল তারা...ভাগ্য ভালু যি আমাদের পেছোনের জানালায় ঢিল পড়িছে। আমরা সপাই কত শখ কইরে আইসছিল্যাম দেখতি, সামনির স্টেশনে নাইমে যাব। নাতিরা চাতিছিল ট্রেনে উঠতি, আর উঠা লাগবিনানে। নতুন ট্রেন, ভাবলেম আসি ট্রেনে চড়তি, অথচ দেইকছ্যান কি কান্ড!'
তারা ট্রেনে ঘুরতে এসেছে, অবসরে পড়বার কথাটি বাস্তবে মিলিয়ে নিলাম। আর কম যাত্রীসংখ্যার আরেকটা কারণও যেন পাওয়া গেল, এরকম পাথর ছোঁড়ার কারনেই হয়তো যাত্রী সংখ্যা এরকম কম। আনন্দ করতে এসে উল্টো এরকম তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়েই কিছুক্ষণ পর তারা ঢেবুনিয়া নেমে যায়।
এই সেই পাথর।
আমি সামনের বগিতে যাই। সেখানে একজন রেলকর্মী টয়লেটের পাশে জানালাকে আড়াল রেখে ঘটনার সবকিছু জানিয়ে ফোনে কথা বলছে। হয়তো রেল পুলিশ স্টেশনে সব তথ্য জানিয়ে রাখা হচ্ছে। আবার আমাদের বগিতে ফিরে আসি। সদ্য খানখান হওয়া কাঁচের টুকরা সিটজুড়ে ছড়িয়ে আছে। অন্য একজন কর্মী পাথরের টুকরা খুঁজে বের করলেন, এটা নাকি পুলিশস্টেশনে দেখাতে হবে!
এভাবে মিনিট দশেক যেতেই আবার শুনি ঝনঝন কাচের শব্দ। একজন বলে উঠল ইন্নালিল্লাহ! প্রথমবার কেউ আহত না হলেও এবার দেখি, এক কনস্টেবল আহত হলেন। তার মাথায় চুলের ফাঁকে আঘাতের চিহ্ন, তবে রক্তপাত কম। তা দেখে ট্রেনের সাদা পোশাক পরা কুমিল্লার ভাষায় কথা বলতে থাকা আরেক রেলকর্মী রাগে গজগজ করতে থাকে, 'শালার ঢেবুনিয়া আর দাশুড়িয়ার কোন পোলাপানগোরে আই যদি দেখি স্টেশনে, তাইলে নগদে মারি ফালামু...'
টুকরো টুকরো হওয়া কাচ।
অন্য বগিতে থাকা এক পুলিশ কনস্টেবল, পোশাকে ও ভাবভঙ্গিতে তাকে কিছুটা উর্ধ্বতন মনে হয়, আমাদের বগিতে এসে তিনি দুই কর্মীদের জিগ্যেস করেন, কোথায় ঘটেছে এটা? শুনে দুইজন দুইরকম উত্তর দেয়। তা শুনে মেজাজ চড়ে যায় পুলিশের। এমন ঘটনায় যদিও মাথা ঠাণ্ডা রাখা জরুরি। এরপর তাদের বলতে শুনি, জেলার বাসমালিকরা কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়েছে বস্তির পোলাপানদের হাতে, তাদের মাধ্যমেই এই ন্যক্কারজনক ঘটনা। কিছুক্ষণ পর সকল জানালার গ্লাস নামিয়ে দেয় তারা, যাতে পাথর এসে সরাসরি কার গায়ে না পড়ে!
এরপর কথা বলেন কনস্টেবল নিজে। তিনি বলে যান, রেল কর্তৃপক্ষ থেকে মাঝে মাঝেই অভিযান পরিচালনা করা হয়। কারণ সাম্প্রতিককালে এরকম ঘটনা বহু ঘটেছে। কিন্তু এই রেলস্টেশন নতুন বলে পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োগ দেয়া এখনো সম্পন্ন হয়নি।
এই ডামাডোলের মাঝে আমরা জানালার কাছ থেকে মাথা নামিয়ে আর মাথা হাত দিয়ে ঢেকে ঈশ্বরদীর দিকে যেতে থাকি। বাইরে ফকফকা জোছনা অথচ আছি ট্রেনের বগির গরমের মধ্যে! ভাবি, ব্যবসায়ে নৈতিকতার এক বিদেশি পুরস্কার যে বাংলাদেশি পেয়েছিলেন, তিনি এসব দেখলে আজ লজ্জিত হতেন। কোথায় নৈতিকতা, কোথায় মানুষের বিবেকবোধ! ট্রেনযাত্রার মত চমৎকার এক অভিজ্ঞতাকে বিভীষিকাময় বানিয়ে তুলল এই পাথর নিক্ষেপ।
সদ্য উদ্বোধন হওয়া স্টেশন।
এক ঘন্টা পর ট্রেন থামে ঈশ্বরদী। কিন্তু ট্রেনের পাথর বিভীষিকার অভিজ্ঞতায় মনে হতে থাকে, অনেক যুগ পর পৌছলাম!
এসব মন থেকে তাড়িয়ে একটা প্রাচীন ইতিহাসের সামনে এসে দাঁড়াই। কারণ পা পড়তেই বুঝি, ঈশ্বরদী প্লাটফর্মের ইতিহাস শত বছরের। লাল রঙের ব্রিটিশ কাঠামোর দালান এখনো প্রাচীনত্ব নিয়ে দণ্ডায়মান। ভেতরে যারা কাজ করে, তাদের বয়সও অনেক, যেন আমি অনেক আগের যুগে চলে এসেছি। পাশাপাশি উত্তর দক্ষিণে চলে যাওয়া চারটা প্লাটফর্মের ৩-৪ নং জুড়ে এই দালানগুলো। ঘুরে ঘুরে পড়ি এই ইতিহাসগুলো। বিভূতিভূষণের বামুন হাজারী রাঁধুনিকে মনে হয় এই স্টেশনের আশেপাশেই কোথাও পেয়ে যাব, যে পুরো রানাঘাট রেল স্টেশনের ভ্রাম্যমান যাত্রী, কর্মী সবাইকে মাত করে রেখেছিল অসাধারণ রান্নায়।
ট্রেন আসছে, পাবনা থেকে ঈশ্বরদী যাবার পথে।
তবে সেরকম কিছু খুঁজে পেতে ব্যর্থ হই। স্ন্যাক্সবারের দোকান ছাড়া আর কোন দোকানই চোখে পড়ে না। একই নামের এই দোকান ১-২-৩-৪ নং দিয়ে এভাবে কয়েকটা প্লাটফর্মে ছড়ানো, শুধু দোকানদার ভিন্ন। এরপর এগিয়ে যাই ওভারব্রিজের দিকে। ওভারব্রিজে পায়ে চলা পথের দুপাশে বেষ্টনিতে কারুকার্য নজর কাড়ে। সাধারণ একটা ওভারব্রিজে এত সৌন্দর্যের দরকার ছিল না। কিন্তু ব্রিটিশরা বানিয়েছে বলেই হয়তো এমন! টিকেট কাটতে হলে এই ওভারবৃজ দিয়েই কোথায় যেন যেতে হয়, লেখা পড়লাম। আমাদের টিকেট কাটার তাড়া নেই। রাত বারোটায় আসবে ঢাকা যাবার ট্রেন, এখন বাজে রাত নয়টা।
হাঁটতে হাঁটতে পুলিশ স্টেশন চোখে পড়ে। ঈশ্বরদী রেলওয়ে থানার পুলিশ স্টেশন। এর আগে কোন রেল স্টেশনে থানা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। একটা রুমের পাশে খিড়কি দেয়া গেইট, ভেতরে সেন্ট্রি রুম আর কয়েদি রাখার স্থান। গেইটে ঝিমোতে ঝিমোতে পাহারায় আছে এক পুলিশ। রুমটার জানালায় উঁকি মেরে দেখি, টেবিলে বসে থাকা থানার পুলিশের সাথে কথা বলছেন একটু আগেই আমাদের ট্রেনের বগিতে থাকা সেই রাগী উর্ধ্বতন পুলিশটা।
সম্ভবত পাথর নিক্ষেপের ব্যাপারটা বিস্তারিত বলা হচ্ছে, আর চেয়ারে বসে থাকা আরেক পুলিশ, যিনি হয়তো থানার ইন চার্জ, তা লিখে যাচ্ছেন। আমাকে দেখেই জানালায় মুখ গলে রাগী পুলিশটা বলে উঠলেন, আপনি তো ছিলেন ট্রেনে, যেখানে পাথর মারা হয়েছে ঐ জায়গার নাম জানেন, কাউকে কি খেয়াল করেছেন? আমি না বোধক উত্তর দিতেই তিনি বললেন, তাহলে যান!
পাথর নিক্ষেপের ঘটনা আর মনে করতে চাইছি না, তাই ঈশ্বরদী থানা স্টেশন থেকে দূরে সরে আসি।