খোলামোড়া নামটায় 'ও' এবং 'আ' উচ্চারণের চমৎকার অনুপ্রাস। বুড়িগঙ্গার পাড়ে কেরানিগঞ্জে এই জায়গাটা। গত ইদে একটা নৌভ্রমণ দিয়ে আসি এই খোলামোড়ায়।
ঢাকার আশেপাশে ঘুরাঘুরির জন্য চমৎকার ছয়টা জলরুট আছে।
১. ত্রিমোহনি-কায়েতপাড়া @ বালুনদ
২. সদরঘাট-কেরানিগঞ্জ @বুড়িগঙ্গা নদির ওপার
৩. সোয়ারিঘাট-খোলামোড়া @বুড়িগঙ্গা
৪. সদরঘাট- কামরাঙ্গিচর @বুড়িগঙ্গা নদির এপার
৫. এফডিসি-রামপুরা @হাতিরঝিল
৬. বেরাইদ-ইছাপুরা বাজার @বালুনদ
৭. মিরপুর ১ বেড়িবাধ- সাদুল্যাপুর @ তুরাগনদ
এই সবগুলো জায়গাতেই আমার ঘোরা হয়েছে। আরো হয়তো জায়গা থাকতে পারে। ঢাকার চারদিকেই চারটা বড় বড় নদি। কাজেই আরো অনেক নৌপথ থাকা স্বাভাবিক।
এখন একেবারে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আর বৈঠকি ভাষায় স্মৃতিচারণা করা যাক সেই দিনটির কথা।
অগাস্ট, ২০১৮
আজ দ্বিতীয়বার যাওয়া হইল খোলামোড়া রুটে। ২০১৪তে প্রথম এই রুটে গেসিলাম, ভার্সিতি ফ্রেন্ডদের সাথে। তাই এই লেখায় দুই ট্রিপের তুলনা প্রায়ই আসতে পারে। মাত্র ১০টাকায় ২৫মিনিটের রিফ্রেশিং একটা ভ্রমণ ছিল যাওয়াটা, আসার পথটাও ফিরসিলাম ঐভাবেই। সেবার আমাদের নিয়ে গেসিল ভার্সিতি ফ্রেন্ডের ফ্রেন্ড, যে কিনা জগন্নাথে পড়ে। পুরান ঢাকার জন্য আশেপাশের ঘুরার জায়গা তো এরাই চিনবে! এবার আমি নিয়া গেলাম দিপ্ত ও লিওনকে।
সেবার গিয়ে ফেরার পর কিছু ছবি তুলসিলাম আরেকজনের মোবাইলে। সেগুলা তো হার্ডডিস্ক নষ্টের জন্য গেসেই, প্লাস এই জায়গার নামটাও ভুইলা গেসিলাম। নামটা খুবই খটমটে, এমনকি 'খ' দিয়েই শুরু নামটা, খোলামোড়া। যদিও মানতেই হবে, নামটায় চমৎকার ছন্দ আছে। তাছাড়া তখন নিজের স্মার্টফোন ছিল না। তাই জায়গায় গিয়া সেখানকার পরিচিতিসূচক কোথাও যে ছবি তুলতে হয়, সেই ট্রেন্ড চালু হয় নাই আমার মধ্যে!
ভুইলা যাবার কারণেই গতবছর প্রি-টাঙ্গুয়ার ত্যুরে (সদরঘাট-কামরাঙ্গিচর) যাবার সময় এই রুটটায় টাঙ্গুয়ারগামী বন্ধুদের নেয়া হয়নি। তার বদলে পনের মিনিটের ট্রলার ত্যুর দিয়ে গেসিলাম নদির এপারেই, কামরাঙ্গিচরে।
দূরে দেখা যায় কামরাঙ্গিচর
আজ আর ভুল করলাম না। রীতিমত ম্যাপ দেখে চার বছর আগের ট্রিপ দেয়া জায়গাটার নাম বের করলাম। আশ্চর্য হইল, খোলামোড়া নাম ম্যাপে দেইখাও মনে হয়নাই এই জায়গায় আমি গেসিলাম!
আজকে সাথে ছিল দিপ্ত। বুড়িগঙ্গার পারে যাওয়ার কথা শুইনা তার মধ্যে রনযদ টাইপ বিক্রিয়া দেখা দিল। রনযদ বিক্রিয়া মানে রন আর যদ এই দুবন্ধুর সদরঘাটের নাম শুনলেই নাকে বুড়িগঙ্গার দুর্গন্ধ পাওয়া। তবে তাদের সাথে দিপ্তর পার্থক্য হইল, পিরোজপুরবাসি বোনকে বিদায় দিতে অনেকবার সদরঘাট যাওয়াতে তার এই বিশেষ অনিহা তৈরি হয়েসে। সে যাকগে।
বুড়িগঙ্গায় সারবাধা নৌকা
বাবুবাজার বৃজে এসে লোকজন জিগ্যেস করতে করতে পনের মিনিট হাঁইটা আমরা সোয়ারিঘাট পৌছলাম। তারপর চড়লাম বিডব্লিউটিএ এর ওয়াটারবাসে। তখন অবশ্য নোঙ্গর খুলে ফেলসে, প্রায় সাথে সাথেই জলযানটা ছাড়ল, সাড়ে পাঁচটায়। সেবার অবশ্য এইরকম বদ্ধ জলযানে যাইনাই, ছাদ ওয়ালা লঞ্চের ছাদে বইসা দুপুররোদে গেসিলাম।
বুড়িগঙ্গায় লঞ্চ
পঁচিশ মিনিটে বুড়িগঙ্গার হাওয়া মাখাইয়া নদির ওপারে খোলামোড়া নামলাম। বাজার পার হয়ে চার বছর আগের স্মৃতি হাতড়ে নদির পাড়ঘেঁষে যাওয়া একটা নির্জন রাস্তায় আসলাম। এই পথ ধরেই এর আগে গেসিলাম, এবারো তা পেয়ে গেলাম।
বুড়িগঙ্গায় পিঁপড়ার মতন চলা নৌকা
খোলামোড়া নৌবন্দর
সেবার পানি কম ছিল, এবার বর্ষায় রীতিমত ফুলতেছে বুড়িগঙ্গা, পানির রঙেও তার প্রতিচ্ছবি। সেবার নদীর কূল রাস্তা থেকে অনেক দূরে ছিল। আমরা বন্ধুরা নেমে সবজি ক্ষেতটেতের দিকেও নামসিলাম। এবার অবশ্য নদির কূল রাস্তা ছুইসে, তাই কোন সবজিক্ষেত নাই।
এবার কিছু উৎপাতের পরিমাণ একটু বেশি লাগল। যেমন রাস্তাটায় ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলা বেশ উৎপাত করল। নাকে বুড়িগঙ্গার গন্ধের বদলে উৎপাত করল প্রতিবছর কোরবানির পরপর তৈরি হওয়া বিশেষ সুগন্ধ! এছাড়া নদিপাড়ে জিরানোর সময় মশা খানিক উৎপাত করল।
এতকিছু সত্ত্বেও নদির পাড়জুড়ে হাঁটা, হালকা বাতাসের ঝিরিঝিরি, রঙচায়ের স্বাদ আর চার বছর আগের নস্টালজিয়াটা নিরিবিলি কিছু সময়কে স্পর্শ করে গেল।
ওয়াটারবাসে
লঞ্চের অন্দরমহল
একটা দোকানে বসলাম, রাস্তার সাথেই। তখন যোগ হইল দিপ্তর মুডফেরানো আলাপচারিতা। টানা দুদুটা জব লিংকে পাইলে, মাসে মাসে ২৫হাজার টাকা পাইলে আর বসুন্ধরা থেকে জব অফার আসলে আমিও আজ কিছু মুডফেরানো আলাপ করতাম। কিন্তু দিপ্তর বদলে আজকে আমার মুখে কিছু দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা যাইতে লাগল। লিওনও দিপ্তর মুখে তার ট্রেডমার্ক হতাশাটা শুনতে না পাইয়া অবাক হইল। দিপ্তর ট্রেডমার্ক এখন বদল হইসে। 'ব্যাপার না, প্যারা নাই' নামক আশাবাদি শব্দযুগলগুলো দীর্ঘশ্বাসকে রিপ্লেস করেসে। সময়ের জাদু।
প্রায় ঘণ্টাখানেক উপরোক্ত আড্ডা একটা দোকানের বেঞ্চে দিয়ে তারপর ফেরার পথ ধরলাম। এবার ওয়াটারবাস না, আগের সেই ছাদওয়ালা ছোট লঞ্চ। দক্ষিণমুখি এই যাত্রায় বেশ বাতাস পাওয়া গেল। মনে হইল, সত্যিই এতক্ষণে বুড়িগঙ্গার হাওয়া মাখাইতেসি। সূর্য বেশ আগেই ডুবছে, চাঁদ এতক্ষণ চুপটি কইরা ছিল, এখন সূর্য পালায়ে যাইতেই সে তার রূপালি আঁচল বুড়িগঙ্গায় বিছায়ে দিল। তার ঝিলিক আইসা দিপ্তর চোখে লাগতেই, পরবর্তিতে লিওনের ভাষায়, দিপ্ততে যেন পিনিক ভর করল। এতদিন একসাথে পড়ালেখা করে আড্ডা দিয়ে যা জানতে পারি নাই, পচিশ মিনিটের জার্নির ঐ পিনিক তা জানায়ে দিয়ে গেল। বলতে লাগল, তার জন্ম নাকি বরিশালে, দশ বছর পর্যন্ত বরিশালে বেড়ে উঠসে সে। সেখানকার কাহিনি বলতে থাকল। আর সুযোগ পেলে এখনো নাকি প্রায়ই সেখানে যায়। এসব শুইনা মনে হল, লিওনের এতদিনের 'বঙ্গীয়বরিশালগৌরব' ছিনাইয়া নিয়া গেল দিপ্ত। স্বয়ং লিওনের মুকুটেও এত বরিশালীয় পালক নেই।
খোলামোড়ার রাস্তা
খোলামোড়া্র রংচা
সবজিক্ষেতের বদলে বুড়িগঙ্গার পানি
বলতে বলতে দিপ্ত হঠাত বরিশাল যাওয়ার ভ্যারা তুলল। কালকেই যাবে, দরকার হলে সে স্পন্সর করবে। আমরা যেন যাই। এই আবদার শুনে দিপ্তর বরিশালের মেলায় হারিয়ে যাওয়া ভাইটি কনফিউশনে পইড়া গেল। শেষমেশ বুড়িগঙ্গার খোলা হাওয়া মিলায়ে যাইতেই দিপ্তর পিনিকটা স্তিমিত হইয়া আসলো।
সাথে সাথে আমাদের একবেলা খোলামোড়া ইদট্রিপটিও!