ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম জুরিখ, সুইজারল্যান্ডের পুরোটা শহর। টই টই করে সারাদিন ঘুরলাম, কখনো বাসে কখনো ট্রেনে কখন নদীতে। দিনটা ছিল খুব সুন্দর পরিচ্ছন্ন আকাশ, রৌদ্রোজ্জ্বল দিন আর সহনীয় তাপমাত্রা।
সকাল ছটায় এয়ারবাস থেকে নেমে ইমিগ্রেশন পেরিয়ে যখন বাইরে এলাম নিজেকে ঝরঝরে লাগছিল, সারারাতের জার্নির পরও। ঘুম আর তন্দ্রা মাঝে মাঝে জেগে উঠার ভিতর ছোট রাত্রের সময়টা কেটেছে। ছোট রাত বললাম এজন্য। পূবদিকে রওনা দিলে সব সময় সময়টা বেড়ে যায়। অভ্যস্থ ঘড়ির সময়ের চেয়ে ছয় ঘন্টা সময় কম পাওয়া যায়। এখন স্থানীয় সময় ভোর ছয়টা আর আমার বাড়ির সময় রাত বারোটা। অদ্ভুত একটা ব্যাপার। এইটুকু সময়ের মধ্যে ঘন্টা তিন হয় তো ঘুমানো হয়েছে ঐ জাগা আর ঘুমে ডুবে যাওয়ার ভিতর।
প্লেনের ভিতর একটানা ঘুমের সুযোগ নাই যদি না কেউ কুম্ভকর্ণ হয়। আমি আবার কুম্ভকর্ণের উল্টো স্বভাবের। খুব একটা ঘুম না হলেও ক্লান্তিতে ঢলে পরছি না।
এই সকালে ইনর্ফমেশনের ঝাঁপির ভিতর লোক বসে আছে।
তাদের জানালায় উঁকি দিয়ে বললাম। আজ সারাদিন জুরিখের জন্য, কি করতে পারি। ডে পাশ নিয়ে সারা জুরিখ ঘুরে বেড়াও। আইডিয়াটা মন্দ নয়। আমার তো এমনই কিছু করার ইচ্ছা। তাই একটা ডে পাশ নিয়ে কিছু ভ্রমণ বিষয়ক কাগজ ওরা দিল মেইন স্পট গুলো দেখার, সে সব ব্যাগে ঢুকিয়ে বেড়িয়ে এলাম এয়ারপোর্ট থেকে।
কি সুন্দর সকাল। এখনো শহুরে জীবনের ব্যাস্ততা শুরু হয়নি। বেশি কিছু না ভেবে পাশ দিয়ে যাওয়া একটা বাসের মধ্যে উঠে পরলাম। বাসটা যত দূর যাচ্ছে একদম শেষ পর্যন্ত গেলাম এই বাসে চড়ে। শহরের অনেকটা দেখতে দেখতে।
প্লেন থেকে নামার আগে নাস্তা করিয়ে দিয়েছে বিমানে। তাই খাওয়া দাওয়ার চিন্তা নেই। পেট ভরপুর আছে। এখন শুধু ঘুরব আর দেখব।
আমি যাচ্ছিলাম দেশে মায়ের ডাকে। পথে একদিন সারাদিন জুরিখে অবস্থান ছিল এবং সারাটা দিন সকাল ছটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত পুরোটা শহর ঘুরে বেড়িয়ে উপভোগ করে নিলাম। ওদের সিস্টেমটা ভালো লাগলো একটা ডে-পাস দিয়ে বাস, ট্রেন, জাহাজে চড়ে ইচ্ছে মতন যেদিক খুশি সেদিক ঘুরতে পারলাম।
বাসে চড়ে শহরের এ মাথা থেকে ওমাথা ঘুরে বেড়ালাম যখন কোন জায়গা দেখতে ভালো লাগলো নেমে গেলাম। খানিক ঘুরে বেড়িয়ে অন্য বাসে চড়ে বসলাম।
আগের বাসটাতেই ফিরতি পথে আসার পথে মাঝ শহরে যে জায়গাটা দেখেছিলাম, বেশ ভালো লেগেছিল, সেখানে নামলাম। বেশ খানিক ঘোরাফেরা করে, ঐ শহরের মাটির ঘ্রাণ নিয়ে পার্কের ভিতর বসে সেদেশের গাছ, পাখিগুলো দেখলাম। আসে পাশের দালানের বৈচিত্র আর মানুষের চলাফেরা অবলোকন করলাম। দেখলাম লম্বা স্ট্রিট বাস আর বাস গুলো আসা যাওয়া করছে। এরপর অন্যদিকের একটা বাসে চড়ে রওনা দিলাম। পৌঁছে গেলাম ল্যান্ডসমিউজিয়াম ডক। লিম্মট নদীর পাড়ে। নদীর পাড়ে কি সুন্দর পার্ক। পরিপাটি মনে হয় যেন ঘরের মতন সাজানো গোছান। সকালবেলার অলস সময়ে কেউ হাঁটছে, কেউ বসে আছে। কেউ বা যাচ্ছে কাজের ব্যাস্ততায়। অনেকটা পথ হেঁটে একদম নদীর কাছে চলে এলাম।
নদীর উপর সাদা রঙের একটা বোট, মানুষজন লাইন দিয়ে আছে চড়ার জন্য। আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম লাইনে। যাই জাহাজে ভেসে লেইক, নদী ঘুরে আসি জুরিখ শহরের মাঝ দিয়ে।
লিম্মাট নদী জুরিখ শহরটিকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে তার মাঝ বরাবর প্রবাহিত হচ্ছে। যে কোন নদীর পাড়, শহর অন্য রকম সুন্দর করে তোলে। সৌন্দর্য ছাড়া ও ব্যবসা, অর্থনৈতিক ভাবে নদীর গুরুত্ব অনেক। আদিকাল থেকে মানুষ নদী পথে চলাচল করে অনেক সহজে পন্য বহনের পথও নদীপথ।
ইউরোপে নদীগুলোকে এমন ভাবে নিজেদের মতন বেঁধে দিয়েছে মানুষ, নদী ইচ্ছে করলেই স্থাপনা ভেঙ্গে ভাসিয়ে নেয় না। বিভিন্ন দেশের নদী রাইন, মাইন, সেইন, রোন, মিউজ বা মিডেলজি নদীর পাড় গুলো আমার অসাধারন লেগেছে।
শুধু গ্রামিণ ফসলের মাঠ নয় শহুরে জীবনও গড়ে উঠেছে নদীর পাড় ঘিরে।
লিম্মট নদীর উপর শহরের কেন্দ্রস্থলে বেশ কয়েকটি সেতু রয়েছে। গাড়ি, মানুষ পার হয়। আমিও সেতু ধরে অনেকটা হেঁটেছিলাম পরে।
নদী এবং হ্রদে পঞ্চান্ন মিনিটের লুপ ঘুরে আসে এই ছোট জাহাজ। কয়েকটা স্টেশনে থামে। ইচ্ছে হলেই যে কোনো স্টপে নামা যায়। ঘুরে ফিরে আবার অন্য কোন বোটে উঠে পরা যায়। বা অন্য বাহনে চড়েও যাওয়া যায় যেদিক খুশি সেদিক।
আমি পুরো সময়টা নদীর একপাড় দেখতে দেখতে গেলাম আর অন্য পাড় দেখতে দেখতে আসলাম। একটাই শহর অন্য রকম লাগে নদীর ভিতর থেকে দেখতে আর রাস্তা থেকে শহরের ভিতরে থেকে দেখতে। নদী থেকে যেদিকটা দেখা যায় রাস্তা থেকে তা কিন্তু দেখা যায় না। শহরের হাইলাইট স্থাপনা গুলো নদীর মধ্য থেকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করলাম। জুরিখের দর্শনীয় স্থানগুলো অন্যরকম করে দেখলাম। বাসে করে যাওয়ার সময় এক রকম লাগছিল।
প্রথম নাম শুনেছিলাম হাঙ্গেরিয়ান গোলাস, অনেক আগে, কোন এক ঈদের নাটকে। একজন খুব যত্ন করে বানিয়েছে আর তা মুখে দিয়ে সবাই মুখ বিবৃত করে ফেলেছে। নতুন ধরনের খাবার সবাই খেতে পারেনা।
সেদিন জুরিখের ক্রজের ম্যেনুতে সেই গোলাস খেয়ে দেখলাম আমি। খারাপ লাগে নাই। আসলে নতুন কে আমি স্পোর্টসলি গ্রহণ করি সব সময়ই। নতুন খাবারের স্বাদ নতুন হবে।
বহেমিয়ান হয়ে যখন বেরিয়ে যাই তখন হাতের, মুখের সামনে যা পাই তা দিয়েই পেট ভরে নেই। খাওয়া নিয়ে অহেতুক ভাবনায় সময় নষ্ট করার কোন কারন নাই। বরং নতুন ধরনের খাবার টেস্ট করতে আমার ভালই লাগে। চেষ্টা করি সেই দেশের অথ্যেনটিক খাবরটি খাওয়ার। তবে বর্তমান সময়ে সব দেশে, সব রকমের খাবার পাওয়া যায়। আদি অকৃত্তিম খাবার পাওয়া মুসকিল। আয়োজন করে যেতে হয় কিছু রেস্টুরেন্টে।
সবখানে ঘরের ভাত মাছ পাব তার তো কোন ঠিক নেই। আর নিজেদের খাবার সেতাে বছর জুড়ে সব সময় খাওয়া হয়ই। নতুন কিছু না খেলে কেমনে হবে। অনেক ধরনের বার্গার, স্যান্ডউইচ, কাবাব পরিচিত অনেক খাবার ছিল ম্যনেুতে। আমার কাছে মনে হল গোলাসটা কখনো খাওয়া হয়নি অন্য সমস্ত খাবার তো খেয়েছি নতুন কিছু খেয়ে দেখি, সেটাই ট্রাই করলাম এবং ভালই লেগেছে আমার কাছে। ঘুরতে ঘুরতে ব্রাঞ্চ করে নিলাম হাঙ্গেরিয়ান গোলাস দিয়ে। হাঙ্গেরিতে নয় সুইজারল্যান্ডে তৈরি। কি জানি সেফ হাঙ্গেরিয়ান ছিল কিনা, সেটা জানা হয়নি।
নতুন একটা নদীতে চলতে চলতে নতুন একটা খাওয়ার পরখ করা সময়টা মন্দ ছিল না। সাথে ছিল অনেক মানুষের মজাদার গান, নাচ আনন্দ। বিভিন্ন গ্রুপ বিভিন্ন ভাবে মজা করছে। কেউ হই হই করছে, কেউ গল্প করছে। আবার কেউ গান করছে। কেউ বা শুধুই দৃশ্য অবলোকন করছে। বিভিন্ন গ্রুপ বিভিন্ন ভাবে আনন্দ করছে। বিভিন্ন দলে অনেক মানুষ। আমি ছিলাম একা। আমার পাশে একজন মহিলা ছিলেন অনেক বয়স্ক একা। উনার সাথে গল্প করে ভালো সময় কেটে গেল। আমি ভেবেছিলাম উনি অন্য কোন দেশ থেকে এসেছেন। তিনি জানালেন স্থানীয়, জুরিখেই বসবাস করেন। বেরিয়ে পরেন কখনো একা। ভালো লাগে উনার জাহাজে করে নদীর উপর ভাসতে। আসলে নিজের মতন জীবনটা উপভোগ সবাই করতে পারে না। হয়তো আরো অনেকে ছিলেন, আমাদের মতন একা। সবার সাথে আলাপ হয়নি।
রিভার ক্রুজ এটাকে বড় ধরনের জাহাজের ক্রুজের সাথে মিলালে চলবে না। ফিরে এসে ওল্ড জুরিখে চলে গেলাম। নদী পথেও নেমে যেতে পারতাম ওখানে। কিন্তু আমার নদীর উপরের হাওয়া ভালো লাগছিল। শান্ত মনোরম পরিচ্ছন্ন একটা পরিবেশ ছিল। ওল্ডসিটির দালান দেখা শেষ হাঁটতে হাঁটতেই বোটানিকাল গার্ডেনে চলে এলাম। আবার সেখান থেকে হেঁটে চলে আসলাম গ্যানিমেড ভাস্কর্যের কাছে। জিউস এবং তার প্রেমিক ঈগল গ্যানিমিড ভাস্কর্যের ধারনা। এটি সমকামী প্রেমের একটি স্মৃতি সম্ভ ১৯৫২ সালে তৈরি করা হয়েছে। সুইজারল্যান্ডে নগ্ন পুরুষ ভাস্কর্য যত দেখলাম, তেমন নারী ভাস্কর্য দেখলাম না।
এখানে হ্রদের শুরু এবং শহর ভাগ হয়ে গেছে। কাছেই ছিল সুইজারল্যাণ্ডের স্পেশাল চকলেটের দোকান কিনলাম কিছু। একটু হাঁটার পরে ক্যাবারে ভলতেয়ার হল। বিশ্ববিখ্যাত দাদা আন্দোলনের জন্মস্থান। ১৯১৬ সালে জুরিখে শুরু হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে, দাদা সঙ্গীত শৈল্পিক পারফরম্যান্সের নতুন এবং আশ্চর্যজনক রূপের সাথে বর্তমানকে প্রশ্ন করার ইচ্ছা জাগিয়েছিলেন। সাহিত্য, নৃত্য, এবং চিত্রকলার আধুনিক ছাপ। এই পুরাতন হলটি এখনও আছে। এর ভিতর ঢুকে দেখলাম অনেক মানুষ, এরা হয়তো নতুন প্রজন্মের নতুন অন্দোলনের চিন্তা চেতনার ধার দিচ্ছেন সেখানে।
এই পথে হাঁটার মজা হলো একটা শহরের অনেক কিছু চেনা যায়। ছোট ছোট ব্যবসা বানিজ্য, রাস্তার পাশের আর্ট, ভাস্কর্য অনেক বেশি ধারনা দেয় একটা শহর তার জীবন যাপন সম্পর্কে। একদিকে যেমন অনেক আধুনিক স্থাপনা তেমনি অনেক পুরাতন দালান, পাশাপাশি নিজস্ব ঐতিহ্যে গৌড়বে দাঁড়িয়ে আছে। এই ইতিহাস রক্ষার বিষযটি সুন্দর। নিজস্বতা ধারন করে থাকা। এর কাছেই ছিল সি জে জং হাউস মিউজিয়াম। কিন্তু সেখানে আর গেলাম না। পুলের উপর দিয়ে হেঁটে আসলাম অপর পাড়ে হান্স ওয়াল্ডম্যান ভাস্কর্যের কাছে। এরপর বাস নিয়ে চলে গেলাম ওপরানহাউস। অনেকটা দূরে অন্যপাশে এই ভবনটি অবস্থিত। দালানের উপরে রাজহাঁসের ছড়ানো ডানা আর তার মাঝে নারী পুরুষ শিশুর ভাস্কর্যটি দৃষ্টি টেনে নিল। ভিতরে দারুণ কারুকাজময় ঘর, মঞ্চ, ছাদ, দেয়াল। অনেকটা সময় ধরে এই দালানটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। নাটক মঞ্চায়ন হয় ১৮৯১ সন থেকে সেখানে।
ভাবলে অবাক লাগে কত আগে থেকে কত উন্নত চিন্তা ভাবনা এবং তা এখন পর্যন্ত ধরে রাখা। যে দেশেই যাই ঐতিহ্য, ইতিহাস ধরে রাখার এই প্রবনতাটি আমার খুব ভালোলাগে। যতটুকু সুযোগ পাই দেখে নেই প্রকৃতির পাশাপাশি।
খুব ব্যাস্ততা বা ভীড় দেখলাম না। খুব শান্ত মনে হচ্ছিল আমার শহরটাকে। অথচ এটা সবচেয়ে বড় এবং জনবহুল শহর সুইজারল্যাণ্ডের।
বাসে করে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে যখন শহরের শেষ প্রান্তের দিকে চলে গেলাম, কিছু কিছু জায়গায় দেখলাম রাস্তার পাশেই সুন্দর নার্সারি। সারিসারি ছোট ছোট আঙ্গুরের গাছ। ছোট ছোট নিজস্ব ওয়াইনারি স্থানীয়ভাবে যেখানে ওয়াইন তৈরি হয় । ছোট ছোট আঙ্গুরের গাছ গুলো দেখতে ভালই লেগেছিল। ওয়াইনারি দেখেছিলাম অনেক আগে। সেটা ছিল বিশাল ব্যাপার নাপা ভ্যালি ওয়াইনারিতে যাওয়া।
ফেরার পথে আমি দশ দিন কাটাব সুইজারল্যান্ড তখন শুধু জেনেভা নয় ঘুরে বেড়াবো সারা সুইজারল্যান্ডে। একটা দেশে গেলে শুধু একটি শহর দেখলে আমার ভালো লাগেনা। অনেকগুলো প্রভিন্স, অনেকগুলো শহর যার প্রত্যেক জায়গায় ভিন্নতা আমি সবকিছু ছুঁয়ে দেখতে চাই। সেটা করেছিলাম ফেরার সময় সুইজারল্যান্ডে থেমে।
এবং সবচেয়ে মজা হয় যখন আমি একা ঘুরতে বেরুই কারো সাথে সময় মিলাতে হয় না। কারো জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। কারো সাথে প্রোগ্রাম মিলানোর কোন বিষয় নেই। নেই টানাটানি আমি এখানে যাব তো আর একজন অন্য জায়গায় যাবে। সময়ের কারণে বেড়ানোর আনন্দটা নষ্ট হয় অনেক সময় যদি সমমনের মানুষ সাথে না থাকে।
আমি খুব উপভোগ করি সারাদিন ঘুরে বেড়ানো। জাস্ট কয়টা কাপড় ব্যাগে ফেলে বেরিয়ে পরা।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ২:১৩