দূর্গা পুজোয় গিয়েছিলাম,অনেকদিন পর। পুজো দেখা উদ্দেশ্য না, বান্ধবীর সাথে দেখা করা। যে এসেছে অনেকদিন বাংলাদেশ থেকে। কিন্তু আমার এখানে আসা হলো না ওর। সুযোগ হচ্ছে না আমারও ওর কাছে যাওয়ার। সময়টাই প্রতিবন্ধক দুজনের দেখা হওয়ার। আর কয়েক দিনের মধ্যে চলেও যাচ্ছে। তাই ভাবলাম পূজা মন্ডপে গিয়েই ওর সাথে দেখা করি। ভালোই কাটলো পুজোর অনুষ্ঠান, গান আনন্দ আর অনেক অনেক মানুষের সাথে দেখা হল, অনেকদিন পর। পুজো চলছে একদিকে, চলছে থ্যাংকস গিভিং দুটো মিলেই মহা আনন্দ উৎসব সময় চারপাশে। লং উইক এন্ডের তিনদিনের একটা ছুটি অনেকেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে,পরিবারের সাথে দেখা করতে। শীতের আগে কটেজ কান্ট্রিতে আনন্দের শেষ উইকএ্যন্ড সময়টা কাটাতে। রাস্তায় এমন জ্যাম লেগে আছে , সবার আনন্দে দেঢ় ঘন্টার সময় পুরো আড়াই ঘন্টা লেগে গেল আমার। রাস্তায় উল্টোপাশে দুর্ঘটনা হয়েছে অথচ অন্যপাশের মানুষগুলো সেই দুর্ঘটনা দেখার জন্য স্থির গতিতে গাড়ি চালিয়ে জ্যাম লাগিয়ে বসে আছে। অদ্ভুত মানুষের মানসিকতা। আজকাল এই দুর্ঘটনার ছবি তুলে ভিডিও করে পয়সা কামাই। টিকটক, রিল বানায় অথবা টিভিতেও খবর পাঠায় আর তার কারণে হাজার হাজার মানুষ রাস্তার উপর জ্যামে বসে থাকে। অকারণ অনেকটা সময় ঝরে গেলো পথে, দেরি হলো। মন্দিরে পৌঁছে দেখলাম চারপাশে মানুষ আর মানুষ আর গাড়ি পার্কিংয়ের কোন জায়গা নেই। তিনবার চক্কর দিয়ে কাছাকাছি কিছু না পেয়ে অনেকটা দূরে গিয়ে পার্কিং করলাম। এক সময় এই শহরে একটা মন্দির, অনেক দূরে একটা মসজিদ ছিল। এখন পাড়ায় পাড়ায় মন্দির, মসজিদ। আর গীর্জাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে প্রায়। মসজিদ, মন্দিরের কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে অনেক গীর্জা। বাংলাদেশীদের নিজস্ব মসজিদ, মন্দির গড়ে উঠেছে এখন এই শহরে। এক সময় এ্যাপার্টমেন্টের পার্টিরুমে বা কারো লিভিংরুমে জামাতে নামাজ পরতে দেখেছি এই শহরের মানুষদের। তাদের এখন নিজস্ব ইবাদতখানা তৈরি হয়েছে। সবাই মিলে জমায়েত হচ্ছে আনন্দ উৎসব হচ্ছে।
আবহাওয়া বেশ ভালই ছিল । আর মন্দিরের ভিতরে তো মানুষের শরীরের উত্তাপে গরম হয়ে আছে । তার উপর রংবেরঙের আলোর ঝলক, বাজনা,সাথে মাইক্রোফোনের শব্দ, বেশ জমজমাট অনন্দময় হাসিখুশি মানুষের মুখ, ঠান্ডা লাগার কোন উপায় নেই। যদিও চারপাশের মানুষের প্রচুর ঠান্ডা এই সময় লাগছে। আমারও গলার শব্দ বের হচ্ছে না বেশ কয়েকদিন ধরে। ভিতরে গানের শব্দ আর কথা বলার কোন উপায় রইলো না তাই আমরা অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে এলাম কারণ আমরা গল্প করছিলাম ।
তাবু টানিয়ে খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। সাধারণ ভাত ডাল নিরামিষ। সবাই মহা আনন্দে খাচ্ছে। আমিও খেলাম তারপর আমরা তাবুর ভেতরে বসে অনেকক্ষণই গল্প করলাম আবার ভেতরে গিয়ে অন্য পাশে একটা রুমে বসলাম ।
একটা জিনিস উপভোগ করলাম খুব এ শহরে আমার শহরের মানুষরা, বেশ ভালো আয়োজনে অনুষ্ঠান করছে ।
আমার আরেক বান্ধবীর মন্দির আছে। সেখানে গেলেও ভালো আন্তরিকতা পাই। ভেবেছিলাম এক চক্কর যাব । কিন্তু যখন আমি বের হলাম তখন রাত বাজে বারোটা বাড়ি ফিরতে প্রায় দুটো হবে। তাই আর গেলাম না। দেশ থেকে আসা বান্ধবীর ভাই পূজা আয়োজক সবাই মিলে মিশে এই বিদেশে কি সুন্দর দেশীয় ভাবধারা বজায় রেখে সবকিছু করছে । সাহিত্য অনুষ্ঠান, জাতীয় দিবস অনুষ্ঠান, ধর্মিয় উৎসব, পারিবারিক উৎসব, রাজনীতি। আবার দেশের মতন লাগালাগি মারামারি সেসবও করছে। বাঙালি স্বভাব বলে কথা।
মজা করে খেলাম।ভাইয়ের বউটি পুরোই গিন্নীবান্নী ভাব, কি সুন্দর সব তদারকি করছে। আমাকে ধরিয়ে দিল অনেক অনেক মিষ্টির একটা প্যাকেট। পূজার প্রসাদ এ খাওয়ায় সবসময় অভ্যস্ত। আমাদের বাড়িতে খাওয়ার আসতো প্রতিবেশীদের সবার বাড়ি থেকে, সবজি নিরামিষ মিষ্টান্ন , খিচুড়ি। এছাড়া মন্ডপে মন্ডপে ঘুরে প্রাসাদ খাওয়া সবই পুরানো, মজ্জাগত ভালো লাগার বিষয়। বান্ধবীর ভাইয়ের বউ এবং আরো সব মহিলাদের নিজ হাতে বানানো পিঠাপুলি মিষ্টি জিলাপি।
এখানে মানুষরা কত কর্মদক্ষ হয়ে ওঠে, সারাদিন জীবন ধারনের কাজ কাম। এরপর ঘর সামলিয়ে, অফিস সামলিয়ে এই সমস্ত বিশাল যজ্ঞের আয়োজনে সবাই আনন্দের সাথে লেগে থাকে, নিজের আনন্দে মহা উৎসাহে। খুশি খুশি মনে সবাই ভাগীদার হচ্ছে সব কাজের সাথে।
দুই বেলা খাওয়ানো হচ্ছে প্রতিটি মানুষকে যারাই আসছে । খুব সাধারণ নিরামিষ খাওয়া কিন্তু তাতেই সবাই খুশি। এবছর পহেলা বৈশাখে আমার দক্ষিণ ভারতীয় উৎসব পালনের অনুষ্ঠানে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে দেখেছিলাম খাওয়া-দাওয়া খুব সাধারণ পুজার উৎসব দেখলাম, সবজি ভাত ডাল দিয়ে কি সুন্দর খাওয়া হচ্ছে, মাছ মাংস না থাকলেও কোন সমস্যা নেই। অনেকদিন পরে ছোটবেলার অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেল পুজোয় গিয়ে। সাথে দেশ থেকে আসা বান্ধবীর সাথে ভালো সময় কাটল।
আমার শুধু মনে হচ্ছিল একটা গান তখন খুব বাজতো পুজো মন্ডপে, "বলেছিলে তাই চিঠি লিখে যাই কথা আর সুরে সুরে মন বলে তুমি রয়েছো যে পাশে আঁখি বলে কত দূরে"। নস্টালজিক এই সমস্ত গান আমাদের বুকের ভিতর পূজোর ঢাকের বাদ্যের সাথে সমান তালে মিলেমিশে আছে পাড়া-প্রতিবেশী পরিচিত অনেকে আসতেন আমাদের বাড়িতেও প্রণাম করতে বাবা মাকে। নিজেদের বড় দাদা বউদি বা মামা, কাকা, মামী, কাকিমার সম্মান দিতেন আমার বাবা মাকেও। একটা আবেগ ভালোবাসার আদান-প্রদান চলতো কোন হিসাব-নিকাশ না করে । তার মাঝে বেড়ে ওঠা মনে এখনো কোনো বিভেদ দেখি না, মানুষের মাঝে । আমাদের দেশে বারো মাসে তের পুজার সবটাই খুব ঘটা করে হয়। এর মধ্যে পৌষ সংক্রান্তিটা আমি খুব মিস করি। আহা কয়েকদিন ধরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শুধু পিঠাপুলি খাওয়া। কারো বাড়ি না গেলে সেজন্যও তারা রাগ হতেন। খাবার পাঠিয়ে দিতেন পর্যন্ত। উৎসবের এই আনন্দ ভাগাভাগি করেই বড় হয়ে উঠেছি কোন রকম বিভেদ দেখিনি।
তারই একটা উদাহরণ পেয়ে গেলাম সাথে সাথেই সেই রাতে।
অনেকটা সময় কাটিয়ে উঠতে হলো বাড়ি ফেরার জন্য যেতে হবে বহুদূর । মাঝ রাত হয়ে গেলেও তখনও দারুন ভিড় । পুরো এলাকা পাশে গির্জা স্কুল অফিসের পার্কিং গুলো তখনো ভর্তি হয়ে আছে গাড়িতে। আমি বাইরে এলাম, বান্ধবী, ভাই, বোন, বউ ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে।
গেটের কাছে শুনলাম, কেউ আমার নাম ধরে আপা আপা করে ডাকছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম একজন ছুটে ছুটে আমার কাছে এগিয়ে এলো। ভদ্রলোককে আমি ঠিক চিনলাম না। ছুটতে ছুটতে এসে জড়িয়ে ধরলেন আমার হাত । তিনি অনেক আবেগ প্রবণ হয়ে কথা বলছেন। ভদ্রলোককে কাছে দেখেও আমি ঠিক চিনতে পারলাম না। তিনি মহা উৎসাহী আমার অবাক হয়ে চেয়ে থাকা দেখে, আমাকে ওনার পরিচয় দিতে থাকলেন। আমি কিছুতেই চিনতে পারছি না উনাকে দেখে তবে নাম শুনে চেনা লাগল । আমি যে উনাকে ঠিকঠাক মতন চিনতে পারছি না সেটা বুঝে, পাড়ার প্রতিটি বাড়ির নাম বলে উনাদের বাড়িটা কোনখানে, সেই লোকেশন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। তখন আমি চিনতে পারলাম। তবে আসলেই আমি কখনো উনাকে দেখেছি বলে আমার মনে পরলো না । তবে অনেকক্ষণ কথা বলে বুঝতে পারলাম উনি আমার অনেক ছোট। আমি তো সেই আঠারো বছরে বেরিয়ে গেছি বাড়ি থেকে, শহর থেকে তখন তারা ছিল ছোট ছোট ছেলে কিশোর। এখন বড় হয়ে গেছে সবাই তাদের ছেলেরা হয়তো কিশোর। তাই তারা আমাকে চিনলেও আমার ঠিক মতন চেনা নেই তাদের। কিন্তু আমি যে কে আমার পরিবার আমার সমস্ত নারী নক্ষত্র খুব ভালো করে চেনা তাদের। অতি উৎসাহী হয়ে উনি ফোনে আমার ভাইবোনদের খুঁজতে শুরু করলেন কথা বলার জন্য এবং আমার বোনকে পেয়ে তাকে ভিডিও কলে পেয়ে, উনি দেখালেন যে উনি আমার সাথে। আমার দেখা পেয়েছেন এই অনেক দূরের দেশে। এই যে আবেগ এই যে ভালোবাসা।এক সুন্দর জীবন যাপনের মধ্যে দিয়ে পেয়েছি সৌহার্দের সম্পর্ক। আমার ভাই বোন আমার বাবা মা, তাদের আত্মীয়-স্বজন ।
আমার বোনকে পেয়ে তাকে বললেন, এই যে আপাকে পেয়েছি। আপা এখন ভাইয়ের বাড়িতে নাইয়র এসে থাকবেন। কি সুন্দর কথা অথচ তিনি মোটে অল্প কিছুদিন এখানে এসেছেন। কিন্তু বোনকে নাইয়র নেয়ার দায়িত্ব তার চলে এসেছে। আমি তাকে না চিনলেও তিনি আমাকে শিকড় থেকে চিনেন। এই যে আবেগ এই ভালোলাগা এটা আমাদের শহরের মানুষের প্রত্যেকের মধ্যে বিড়াজিত । একে অপরকে আত্মীয় ভাবা, জাতি ধর্ম কোন বাঁধা নয় অবশ্য । এটা আমরা যারা অবারিত আনন্দে মেলামেশা করে বড় হয়েছি তাদের মধ্যে আছে। অন্তত আমাদের বড় হওয়ার সময় পর্যন্ত আমরা কোন বিভেদ দেখিনি, করিনি। যার ধারাবাহিকতা আমাদের এখনও আছে । আমি যখন বাড়ি গিয়েছিলাম প্রায় রাস্তায় হাঁটতাম একদিন দুটো অল্প বয়সি বউ আমার পথ আটকে বলেছিল আপা কেমন আছেন? আমি তো তাদের চিনতে পারি না। তখন ওরা পরিচয় দিল আমরা ওই বাড়ির বউ ওমুক ছেলের বউ। এই মেয়েরা অন্য জায়গা থেকে এসেছে। আমার সাথে কোনদিন দেখা হয়নি অথচ ওরা আমাকে চিনে ফেলেছে। তাদের শাশুড়ি যিনি আমার বাবাকে বড় দাদা ভাবতেন তিনিও এখন আর নাই। অথচ আমাদের সাথে সম্পর্কের সূত্র তারা ধরে রেখেছে। অনেক আমন্ত্রন করল আমাকে তাদের বাড়ি যেতে। মা নেই তাতে কি হয়েছে আপা, আমরা তো আছি এখন। এই আন্তরিকতা শুধু দেশে নিজের শহরের মানুষের থেকে চেনা, পরিচিতর কাছেই পাওয়া যায়।
বর্তমান সময়ে এমন আন্তরিকতা, ভালোবাসার ধারাবাহিকতা আছে কিনা আমার জানা নেই । ছেলেমেয়েরা আজকাল মোবাইলে থাকে। ঘরের ভিতর থাকে নিজেদের মধ্যে থাকে । তারা আগের মতন পাড়া প্রতিবেশীর সাথে মিলেমিশে খেলাধুলা যোগাযোগ ধর্মীয় জাতীয় সামাজিক ভাবে সম্পর্কে সম্পর্কিত কিনা, আমার জানা নেই। ছেলেটার এমন আন্তরিকতা দেখে আমার শুধু আমার পুরানো সেই কবিতার কথা মনে পড়ছে । "আমাদের গ্রামখানি ছবির মতন। মাটির তলায় এর ছড়ানো রতন আম গাছ জাম গাছ তাল গাছ যেন মিলেমিশে আছে ওরা আত্মীয়
আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর, থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর ৷ পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই একসাথে খেলি আর পাঠশালায় যাই।"