ঘুম ভেঙ্গে গেল হঠাৎ, রাত এখনও শেষ হয়নি। মশারির ভিতর দম বন্ধ লাগছে। ফ্যান চলছে তুমুল জোড়ে কটকট একটা আওয়াজ হচ্ছে। অথচ বাতাস এক ফোটাও মশারির ভিতর আসছে না। নীলা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন , আমার পাশে হাতপা ছড়িয়ে শুয়ে আছে নির্ভাবনায়। শ্বাস প্রশ্বাস হচ্ছে ছন্দময়। আমি নীলার মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে, বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে বাইরে এলাম। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ছাট গায়ে লাগছে। ছোট ছোট জলের কনা একটু একটু করে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাকে। বৃষ্টির পানিতে হাত বাড়িয়ে দিলাম। হাস্নুহেনার গন্ধ আসছে। তীব্র গন্ধ আমার নাকে লাগছে। অথচ আশেপাশে কোথাও হাস্নুহেনার গাছ আছে মনে করতে পারছি না।
আমার এক কাপ চা খেতে ইচ্ছা করছে। ভীষণ চায়ের তেষ্টা পেয়েছে। ফ্লা্ক্সে চা বানানো আছে , নীলা জানে মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমি চা পান করি। তাই সব সময় চা, তৈরি করে ফ্লাক্স ভর্তি করে রেখে দেয়।
আমি আধ ভেজা হয়ে গেছি। ঘুরে দাঁড়ালাম ঘরে যাওয়ার জন্য। আমার পিছনে একটি মেয়ে, সুন্দর ফর্সা গোলগাল হাতে সোনালি রিম দেয়া সাদা কাপে ধূয়া উঠা চায়ের কাপ, প্লেটে বসিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে রেখেছে।
নীল শাড়িতে মেয়েটিকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। ফর্সা মুখটির চেহারা ভালো করে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু মেয়েটি যে অসম্ভব রূপবতী এতে কোন সন্দেহ নাই।
আমি হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটি নিলাম। ওর আঙ্গুলের সাথে আমার আঙ্গুলের ছোঁয়া লেগে গেল। আর তখনই আমার স্মৃতিতে ভেসে এলো সমস্ত স্মৃতি। মেয়েটি রূপা। রূপার সাথে কাটানো মধুময় সেই সব স্মৃতি ভাবতে ভাবতে আমি বারান্দায় পাতা চেয়ারের উপর বসে পরলাম। বাতাসের ঝাপটায় বৃষ্টি মাঝে মাঝেই ছূঁয়ে দিচ্ছে আমাকে।
বৃষ্টি ভেজা বারান্দায় বসে আমি গরম চা পান করছি। রূপার দেয়া চা। বেশ ঘন লিকারের কড়া চা। কাপের গরম, ছ্যাকা দিচ্ছে আমার আঙ্গুলে।
বুকের ভিতরও যেন একটা ছ্যাকা লাগছে। কেমন জ্বলে উঠছে বুকের ভিতর।
রূপা আর আমি একসাথেই বড় হচ্ছিলাম। পাশাপাশি বাড়ি আমাদের। অবাধ যাতায়াত ছিল এবাড়ি ওবাড়ির। আমার কাছে তার যত আব্দার। পুতুল থেকে আয়না, চুড়ির বায়না ধরত যখন তখন। লাল ফিতা, কানের দুল হাটে গেলে এনে দিতাম। অংক থেকে বাংলা ইংলিশ শেখানোর দায়িত্বও আমার ছিল। আমি পড়িয়ে না দিলে রূপার পড়া হতো না। তবে পড়ার চেয়ে আর সব কাজে ওর মনোযোগ বেশি ছিল।
রূপা বেনি দুলিয়ে নাচত আমার চোখের সামনে। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চলে এলাম ঢাকা। বেশ কিছু কাল পর ফিরে গিয়ে যখন রূপার সাথে দেখা হলো, ওকে চিনতে কষ্ট হলো।
হাসিখুশি বেনি দুলানো, ফ্রক পরা কিশোরি রূপা, পূর্ণ যৌবনা নারী হয়ে গেছে। দুষ্টামিতে ভরপুর রূপা কেমন শান্ত দিঘীর টলটলে জলের মতন। ভরা বর্ষার রূপ ওর অঙ্গ জুড়ে। মাঝে মধ্যে বিদ্যুতের চমক হানে, যখন হাসে চোখের চকিত চাহুনি যেন বিদ্যুৎ হানে আমার মনে।
আগের মতন সহজ সরল ভাবে দুজনে আর খেলতে পারি না। কথা বলতে পারি না। কেমন আড়ষ্ঠতা এসে ভর করেছে আমাদের মাঝে। সুযোগ পেলেই আমি লুকিয়ে লুকিয়ে রূপা কে দেখি।
মা একদিন বলে, রূপাকে বিয়ে করবি?
আমি রাজি হয়ে যাই। রূপার সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায়।
আমি পরীক্ষার জন্য ঢাকা ফিরে আসি। পরীক্ষা শেষে একটা চাকরি খুঁজি । মাঝে মাঝে বাড়ি যাই রূপার সাথে কাটিয়ে আসি। রূপা মায়ের সাথেই থাকে।
চাকরি একটা পাওয়া গেল স্কুলের হেড মাস্টার স্যারের সুপারিশে। উনার এক ছাত্রের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে ম্যানেজারের কাজ। একটু গুছিয়ে নিয়ে, মেস ছেড়ে একটা বাসা ভাড়া করে, রূপাকে নিয়ে এলাম।
জীবনে সুখের দিনগুলো হাতের মুঠোয় আমাদের। সপ্তাহের ছুটির দিনগুলো রিকসা করে রূপাকে ঢাকা শহর দেখাই। আহসানমঞ্জিল, সোনার গাঁ। পুরান ঢাকা লালবাগের কেল্লা। চিরিয়াখানা। বোটানিক্যাল গার্ডেন, বলধা গার্ডেন। বায়তুল মোকারম মসজিদ। নিউমার্কেট, শহিদমিনার, জাতিয় স্মৃতি সৌধ।
ঢাকায় এসে রূপা যেন সেই বালিকা হয়ে গেল। হাসি আর কথা থামে না। যখন তখন আব্দার বিরিয়ানি খাওয়ার। আইসক্রিম খাওয়ার। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চটপটি খেতে সব চেয়ে পছন্দ করে রূপা। প্রচণ্ড ঝাল দিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে উহ আহ করে খাবে। কদবেল হাতে নিয়ে রিকাসায় বসে খেতে খেতে যাওয়াও ওর পছন্দের একটা বিষয়। মাঝে মধ্যে নাগরদোলায় চড়ার বায়না ধরে। আমি কৃত্রিম রাগ দেখাই প্রতিদিন যেতে হবে ঘুরতে। আজ না যাই। রূপার চোখ ছলছল হয়ে যায় সাথে সাথে। গম্ভীর মুখে দরজার পাশে বসে থাকে। আমি তখন ওকে আদর করে টেনে উঠাই। চোখ মুছিয়ে দিয়ে চুমু খাই। বলি দূর পাগলী মজা করছিলাম। যাও তৈরি হও তাড়াতাড়ি।
মহা উৎসাহে কয়েকটা শাড়ি নিয়ে হাজির হয়, কোনটা পরব তুমি বলে দাও। আমি কিছুই বুঝি না কোন শাড়িতে কেমন লাগে। তবু যে কোন একটা শাড়ি টেনে বলি, এটা পরো আজ। রূপা যা পরে তাতেই মানিয়ে যায়। ওকে অনেক সুন্দর লাগে।
বেলুন হাতে নিয়ে রিকসায় বসে থাকে রূপা। পাশে বসে আমি তখন ভাব করি, যেন আমরা কোন বাচ্চার জন্য বেলুন কিনে নিয়ে জন্মদিনের পার্টিতে যাচ্ছি। এখানে সেখানে যাওয়ার আব্দার লেগেই থাকে ওর। আমিও হাসি মুখে ওর আব্দার পূরণ করি। ভালোলাগে ওর আনন্দময় সুখি সুখি মুখ দেখতে।
সাথে আমাকে খুব যত্ন করে। রান্না করে, সুন্দর করে চা বানিয়ে দেয়। ওর বানানো চা না খেলে আমার দিন ভালো শুরু হয় না। এমন মধুর দিনগুলোর মাঝে রূপা অসুস্থ হয়ে গেল। কিছু খেতে পারে না। বমি আর বমি। কোথাও যেতে চায় না। মাথা ঘুরে বমি আসে। বাধ্য হয়ে রূপাকে নিয়ে গ্রামে যাই। মা দেখে হাসে, বলে দূর বোকা ও তো মা হবে। এটা কোন অসুখ না।
থাক আমার কাছে পহেলা পোয়াতি যত্ন -আত্মি করা লাগে। ও কি পারবে এক একা কিছু করতে। রেখে যা আমার কাছে। ।
রূপাকে রেখে আসতে খুব কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু ওর ভালোর জন্যই রেখে আসতে হলো মায়ের কাছে গ্রামে।
সময় কাটছিল না কিছুতেই। একবার গিয়ে দেখে এসেছি ওকে। আর কয়েকটা মাস। বাচ্চা হয়ে গেলে ওকে নিয়ে আসব বাচ্চাসহ। সারাদিন বসে বসে অনেক পরিকল্পনা করলাম। ঘর কেমন করে সাজাব। বাচ্চার জন্য কি কি কিনতে হবে। রূপার কি লাগবে। বিশাল একটা লিষ্ট রেখে দিল সুটকেসের ভিতর রূপা।
আমি ফিরে আসার আগে রূপা নীল শাড়ি পরে সাজল রাতে। ওকে মায়াবতী পরীর মতন লাগছিল। লাল একটা ছোট্ট কুমকুমের টিপ কপালে। কাজল টানা চোখে টলমল জল ভর্তি রূপা কোন রকমে বলেছিল, আমার মনে হয় আর আমাদের দেখা হবে না।
কি বলো এই সব, মন শক্ত রাখো। এ সময় দূর্বল ভাবনা ভাবতে হয় না। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আমি বলেছিলাম।
সকালে চলে আসতে হলো, সারা পথ অনেক মন খারাপ লাগছিল।
ক’দিন ধরে কিছুতেই কাজে মন বসে না। জোড় করে চলছি ফিরছি। যেদিকে তাকাই শুধু রূপাকে দেখি। এমনি সময় সেই ভয়ানক খবরটা এলো।
রূপা পানিতে ডুবে মারা গেছে।
তুখোড় সাঁতারু রূপা পানিতে ডুবে কি ভাবে মারা গেল? এই রহস্য আজো আমার কাছে পরিস্কার নয়। যে পুকুর, আমরা এপাড় ওপাড় সাঁতার দিয়ে পারি দিয়েছি কতবার। রূপা সেই পুকুরে ডুবে মরে গেছে। আমি কথাটা আজও বিশ্বাস করতে পারি না।
শীতে আমি ঠকঠক করে কাঁপছিলাম। ভোর হয়ে এসেছে মসজিদ থেকে, আযানের ধ্বনী আসছে।
নীলা এসে আমাকে তুলে নিয়ে গেল ঘরে। সেদিন আমার প্রচণ্ড জ্বর এলো। আমি অবিরাম প্রলাপ বকছিলাম রূপার সাথে কথা বলছিলাম, জ্বরের ঘোরে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ১:৪৭