কাল বাজার করতে গিয়ে পেলাম প্রচণ্ড ভীড়। আর ভীড় যদি হয় চাইনিজদের তা হলে বুঝতে হবে, পৃথিবীতে তাদের সংখ্যাগড়িষ্ঠতা। ঠেলাঠেলি করে বাজার সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে যখন ভাবছিলাম ওরা সব আজ ঝাঁপিয়ে পরেছে কেনো সব কেনার জন্য। তখনই মনে হলো মাসটা ফেব্রুয়ারি। চাইনিজ নতুন বৎসর শুরুর সময়। আর গতকালই ছিল নিউ ইয়ার ইভ। তার উপর শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সব মিলে সোনায় সোহাগা হয়েছিল তাই।
আজ সন্ধ্যায় চাঁদ উঠার সাথে চন্দ্র বৎসর লুনার নিউ ইয়ারের উৎসব শুরু হবে চীনা, তাইওয়ান. ভিয়েতনাম এবং পৃথিবী জুড়ে এই উৎসব পালনকারিদের মাঝে। এবং আনন্দের ভাগ পেয়ে যাবো আমরাও ছোট খাটো বিশ্বতে এক সাথে মিলে থাকার সুযোগে।
চাঁদ উঠার সাথে চাইনিজদের নতুন বৎসর শুরু হবে। সব জাতীর মতন নতুন বৎসরে প্রথম দিনটি বিশেষ তাতপর্য পূর্ণ। তারা, ''গং ছিয়া ফাই সি অথবা কংফু হেই ফেট ছয়ে" ক্যান্টোনিজ ভাষায় স্বাগতম, অগ্নি বানর বৎসর। এই ভাবেই শুভ নববর্ষ বা হ্যাপী নিউ ইয়ার স্বাগতম জানাবে। বারোটি প্রাণীতে ভাগ করা চাইনিজ বৎসরগুলো বারো বছরে প্রতি প্রাণী ফিরে আসে। এবারের প্রাণী বানর। এবং অগ্নি বানর ২০১৬।
রাশিচক্র ক্রমানুসারে বারো প্রাণী : ইঁদুর, ষাঁড় বাঘ, খরগোস, ড্রাগন, সাপ, ঘোড়া, ছাগল, বানর, গৃহপালিত মোরগ, কুকুর, এবং শুয়োর প্রতি বারো বছরের চক্র অনুযায়ী চীনা ; পশু রাশিচক্র এভাবে হয়। চন্দ্র মাসের হিসাবে দিনের কিছু তারতম্য হয়। কিন্তু বারো বছরে প্রতিটি পশু ফিরে ফিরে আসে।
চীনা নববর্ষ শীতের শেষ বসন্তের সাথে চাঁদ, সূর্যের হিসাব মতন শুরু হয়। কাজেই ইংরেজী একই তারিখে নতুন বছর শুরু হয়না। অনেকটা আরবী মাসের মতন চাঁদের হিসাব অনুযায়ি সময়ের তারতম্য হয়।
নতুন বছরের পনের দিন পর্যন্ত ল্যান্টার্ন উৎসব পালন করা হয়। উৎসবের শুরু থেকেই অনেক কিছু এড়িয়ে বা না করার চেষ্টা করা হয়। যাতে বছরটি হতাসা, যন্ত্রনা, দুঃখের না হয়। অনেকটা আমাদের নববর্ষে যেমন, দিনটি ভালো কাটানোর চেষ্টা করা হয়। বৎসর যেন ভালো যায়। সাধ্যি মতন ভালো খাবার , ভালো থাকার যে ঐতিহ্য প্রচলিত প্রথা।বাঙালিরা পালন করেন। তেমনি একই রকম নিয়ম বিদ্যমান দেখা যায় চীনা সংস্কৃতিতে, সমাজ ব্যবস্খায়। ঐতিহ্য ও সংস্কার সুপ্রসন্ন সময় ভাগ্যবান, সমৃদ্ধ বছর চাওয়া। তবে তার নতুন বছরের উৎসব পনর দিন ধরে পালন করে।
চীনারা অনেক বিষয়ে এখনও যত্নবান। এখনও ঐতিহ্য পালন করা হয় যত্ন সহকারে। শুধু খাবার এবং কাপড় পড়ায় নতুন বছর পালনের বিষয় সীমা বদ্ধ নয়। কি খাবে কি ব্যবহার করবে, আচার আচরণ। কোন জিনিস প্রাধান্য দিতে হবে আর কি এড়িয়ে যেতে হবে তার বিরাট তালিকা। উৎসব আনন্দ এখনও যত্নের প্রচুর ছাপ। এবং অনুগত ভাবে পালন করা হয়। আমার কাছে মনে হয়, চীনারা যেমন একটি শব্দের জন্য একটি চিহ্ন ব্যবহার করে অনেকটা তেমন প্রতিটি বিষয়ে কি ভালো কি খারাপ তার বিশাল তালিকা মুখস্ত রাখে। ব্যবহারে আচারে চলনে সব কিছুই যত্নের ব্যাপক ব্যবহার।
নতুন বছরে কি কি করতে হবে এবং করতে হবে না কিছু তালিকা দেয়ার চেষ্টা করি।
পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ঘর পরিষ্কার করা হয় বছর শুরুর আগের কয়েকদিন ধরে। কিন্তু বছর শুরুর দিন ঘর ঝাড়ু দেয়া যাবে না। সৌভাগ্য ঝেড়ে ফেলে দেয়া হতে পারে এই ভাবনায়।
লাল রঙের লণ্ঠন এবং "ফু" বা ভাগ্য অক্ষর,ঝালর ঝুলিয়ে বাড়ি সাজানো হয় । রাস্তা আসে পাশেও ঝুলানো হয়। সেীভাগ্য বরণের নানা চিহ্ন বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে রঙ হয় লাল, সোনালী।
নববর্ষের শুরুটা যেন পরিচ্ছন্ন ভাবে শুরু হয়। সর্বত ভাবে সে প্রচেষ্টা করা হয়। পরিষ্কার বাড়িতে কোন ভাবেই যেন কোন দুর্ভাগ্য প্রবেশ না করতে পারে।
নববর্ষের উৎসবে পুনর্মিলন, আত্মীয়দের বাড়িতে যাওয়া এক সাথে খাবার খাওয়া অপরিহার্য। সঙ্গবদ্ধ সৌহার্দর বিবেচনায়।। এই সব বিষয়গুলো খুব গুরুত্ব সহকারে পালন করা হয়। নতুন কাপড় পরা থেকে খাবারের ম্যেনুতে কি ধরনের খাবার রাখলে তা সারা বছরের জন্য মঙ্গল এবং সমৃদ্ধির হবে, প্রতিটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পালনের চেষ্টা করা হয়।
মাছ অপরিহার্য খাওয়া। নববর্ষ খাবারের ব্যাখ্যা এভাবে দেয়া যায়। স্প্রিং রোলস স্বর্ণের বার। বাতাবি লেবু- সম্পদ আনবে, সেলারি- প্রজ্ঞা, বরই-একটি ধারালো মনের জন্যে। লেটুস-বেঁচে থাকার জন্য এবং মিষ্টি -একটি মিষ্টি বছরের জন্য।
এছাড়াও গতানুগতিক খুব প্রচলিত ভাবার, ডাম্পলিং - পুরাতন চীনা মুদ্রা, অনুরূপ- দীর্ঘ নুডলস এবং পীচ- দীর্ঘায়ুর প্রতীক।
নতুন জামাকাপড় - বিশেষ করে উজ্জ্বল, খুশি রঙ। লাল, সমৃদ্ধি প্রতীক। ঘুমাতে যাওয়ার আগে চপ্পল ও জুতো নিয়ে যাওয় অশুভ
ড্রাগন বা সিংহ নাচ দেখা জরুরী এবং মন্দিরে গিয়ে বছরের জন্য প্রার্থনা।
নববর্ষের সময় ঋণী না থাকার চেষ্টা করা এবং ঋণ না করা।
চীনা নববর্ষের প্রথম দিনে এড়ানো হবে:
চিকিৎসাবিজ্ঞান: চান্দ্র বছরের প্রথম দিনে ওষুধ মানে একটি পুরো বছরের জন্য অসুস্থতা পেতে হবে।
নববর্ষের নাস্তা জাউ, না খাওয়া উচিত দরিদ্রতা আসবে।
প্রথম দিনে কাপড় না ধোয়ার পরামর্শ থাকে।
বছরের প্রথম দিনে চুল ধুয়ে ধনী হওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়া। ভাগ্য ধূয়ে বিদায় করে দেয়ার মতন অবস্থা না করাই ভালো।
ধারালো বস্তু: ছুরি কাঁচি, দুর্ঘটনা, অশুভ জিনিস এবং সম্পদ নিঃশেষ হতে বলে মনে করা হয় তাই এর ব্যবহার এড়ানো হয়।
বাইরে যাওয়া, মহিলা তার বাড়ি ছেড়ে না যেতে পারে; অন্যথায় সে সমগ্র আগামী বছরের জন্য দুর্ভাগ্য অর্জন করবে
একজন বিবাহিত মেয়ে ও তার বাবাকে মন্দিরে দেখার জন্য অনুমতি দেওয়া হয় না। এই বাবা দুর্ভাগ্য আনতে পারে। পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক কষ্ট ঘটাচ্ছে বিশ্বাস করা হয়।
শিশুর কান্না; পরিবারে দুর্ভাগ্য আনবে, যতটা সম্ভব খুশী রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয় শিশুদের।যেন কেঁদেকেটে বৎসর কান্নাময় না করে ফেলে।
চুরি: মানে নতুন বছরে বরবাদ হয়ে যাওয়া। সম্পদ ভবিষ্যদ্বাণী বিশ্বাস সব চুরি হয়ে যাবে । যথা সম্ভব চুরি যাওয়া ঠেকানোর চেষ্টা করা দরকার।
নববর্ষের সময় রান্নার পদ নির্বাচনে মঙ্গলামঙ্গল বিশেষ ভাবে বিবেচনা করা হয়।
ক্ষতিগ্রস্ত জামাকাপড়: মামুলী কাপড়চোপড় পরা বছরের জন্য আরও দুর্ভাগ্য সৃষ্টি করতে পারে।
সাদা বা কালো কাপড় এই দুই রং ঐতিহ্যগতভাবে শোকের সাথে সংযুক্ত না পরার নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
এছাড়া আরো অসংখ্য নিয়ম মনে হয় প্রতিটি বস্তু আচার আচরেণের সাথে একটা নিয়ম জড়িত।
বারো প্রাণীর ক্রমানুসারে, ইঁদুর, ষাঁড়, বাঘ, খরগোস, ড্রাগন, সাপ, ঘোড়া, ছাগল, বানর, গৃহপালিত মোরগ, কুকুর, এবং শুয়োর।
প্রতি বছর বারো বছরের চক্র অনুযায়ী, চীনা পশু রাশিচক্র। জন্ম বৎসরের সাথে মিলিয়ে দেখে নিন আপনার মিল হয় কোন পশুর সাথে। বা আপনি জন্মসাল অনুসারে, জাতক কোন পশুর।
বারোটি পশু এবং তাদের জাতকরা যেমন গুণ সম্পন্ন হন।
ইঁদুর: প্রখরবুদ্ধিমান, গ্রহণযোগ্যতা সম্পন্ন, কমনীয়, শৈল্পিক, মিশুক.
ষাঁড়: অনুগত নির্ভরযোগ্য, পুঙ্খানুপুঙ্খ, শক্তিশালী, যুক্তিবাদী, অবিচলিত, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
বাঘ: উত্সাহী, সাহসী, উচ্চাভিলাষী, নেতৃত্ব, আস্থাবান, সহজাত।
খরগোস: বিশ্বস্ত, সহমর্মি, বিনয়ী, কূটনৈতিক, আন্তরিক, মিশুক, তত্বাবধায়ক।
ড্রাগন: লাকি নমনীয়, পাগলাটে, কল্পনাপ্রবণ, শৈল্পিক, আধ্যাত্মিক, সহজাত।
সাপ: দার্শনিক, সংগঠিত, বুদ্ধিমান, স্বজ্ঞাত, মার্জিত, মনোযোগী, নিষ্পত্তিমূলক।
ঘোড়া: অভিযোজ্য অনুগত, সাহসী, উচ্চাভিলাষী, বুদ্ধিমান, দুঃসাহসিক, শক্তিশালী।
মেষ: রুচিসম্পন্ন ধূর্ত, উষ্ণ, মার্জিত, কমনীয়, স্বজ্ঞাত, সংবেদনশীল, শান্ত।
বানর: তীক্ষ্নবুদ্ধিসম্পন্ন কমনীয়, ভাগ্যবান, অভিযোজ্য, উজ্জ্বল, বহুমুখী, প্রাণবন্ত, স্মার্ট।
গৃহপালিত মোরগ: সৎ অনলস, বুদ্ধিমান, লোকদেখানো, নমনীয়, বিচিত্র, আত্মবিশ্বাসী।
কুকুর: অনুগত মিশুক, সাহসী, পরিশ্রমী, অবিচলিত, প্রাণবন্ত, অভিযোজ্য, স্মার্ট।
শুয়োর: মাননীয় বিশ্বপ্রেমিক, নির্ধারিত আশাবাদী, আন্তরিক, মিশুক।
সব দেখে শুনে মনে হয় যত দূর প্রান্তে যেমন মানুষ বাস করুক। উৎসব আনন্দ, বিশ্বাস সব মিলে মিশে যায়।
মানুষের ভীরুতা কুসংস্কারে আবদ্ধ করে ফেলে। আর নিয়ম আরোপিত হতে থাকে।
সব মিলিয়ে উৎসব তাও মজাদার। আতস বাজীর ঝলক আর শব্দে কান চোখের আনন্দের সাথে বারোটাও বাজতে পারে। তারপরও প্রচুর আতস আলো জ্বলে আনন্দের হাত ধরে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:৩৯