মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গের ওপর অনেক কথাই বলা হয়ে গিয়েছে। পত্র-পত্রিকাতো বটেই, ব্লগেও কিছু পোস্ট এসেছে। দু'জন বাংলাদেশীর কথাও আলোচনায় এসেছে -–দীপংকর তালুকদার (অরেগন বিশ্ববিদ্যালয়) আর সেলিম শাহরিয়ার (নর্থ ওয়েস্টার্ণ বিশ্ববিদ্যালয়, ইলিনয়)। আসলে প্রায় ১০০০ বৈজ্ঞানিক Laser Interferometer Gravitational-Wave Observatory (LIGO)’র পুরো কোলাবোরেশানে কাজ করেন। কিন্তু এর মাঝে কার চোখে প্রথম এই তরঙ্গ ধরা দিলো? সম্মানটা পেয়েছেন ৩৩ বৎসর বয়েসী ইটালীয়ান Marco Drago।
মার্কো দ্রাগো
LIGO সম্বন্ধে জানতে নেট গুতালেই চলবে। সহজ কথায় আমেরিকার প্রায় দুই প্রান্তে দু’টি অতিকায় যন্ত্র, অসংখ্য লেজার প্রক্ষেপক, আয়না, প্রিজম, ডিটেক্টর আর দুনিয়ার হাবিজাবির সমষ্টি, পুরোটাই এক ধরণের রুলার। একটি LIGO Hanford Observatory, Richland, Washington এ। আরেকটি LIGO, Ligo Road, Livingston, Luisiana ‘তে। সমকোণে বসানো দু'’টি অতিকায় টানেল এক অবজারভেটরিতে মিলেছে।
লুইজিয়ানার LIGO
মোটামুটি তিন জন পদার্থবিদের প্রচেষ্টায় LIGO'’ জন্ম। মার্কিন Kip Stephen Thorne আর স্কটিশ Ronald William Prest Drever, এরা দু'’ন Caltech এর। আর বার্লিনে জন্ম নেয়া জার্মান, বর্তমানে মার্কিন Rainer Weiss; ইনি MIT’র। Caltech আর MIT মিলেই ১৯৯২’তে LIGO তৈরী করে, তবে সাথে বহু কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ও কোলাবোলেশানে আছে। টাকা দিচ্ছে National Science Foundation (NSF)। এর পেছনে বহু বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। তবে গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি প্রায় ৬২০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে পাঁচ বছরের এক আধুনিকায়ন শেষ হয়।
ওয়াশিংটনের LIGO
এই আধুনিকায়নেরও এক বড় ভূমিকা আছে মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ ধরায়। এখন এর লেজার বীমগুলো বহুগুণ শক্তিশালী, ডিটেক্টরগুলো অনেক বেশী সংবেদনশীল। মোটা দাগে বলা যায়, মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ থাকলে, “স্থান”কে সূক্ষাতিসূক্ষ্য পরিমাণে লম্বা করবে আর তাতে লেজারের "signal to noise ratio" স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী হবে। গতানুগতিক বা রুটিন রিডিংয়ের চেয়ে বেশী কিছু হলেই, কম্পিউটার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাছে ই-মেইল পাঠাবে।
আমেরিকার দুই প্রান্তে দুই LIGO। দূরত্ব প্রায় তিন হাজার কিলোর বেশী।
মার্কো ছিলেন তেমনই এক ব্যক্তি। কিন্তু এখানে একটা মজাও ছিলো। LIGO’তে মাঝে মাঝে কিছু false blind injection (secret) দেয়া হতো। অর্থাৎ গবেষকবৃন্দ কি সতর্ক আছেন, না কি তারা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে NSF এর fund খাচ্ছেন তা দেখার জন্য। মাত্র চারজন LIGO লীডার জানতেন, কখন কোন জায়গায় বানোয়াট সিগনাল দেয়া হচ্ছে। গবেষকবৃন্দ তাদের সমস্ত কাজ করে ফেললে ফল প্রকাশের আগে দিয়ে সবাইকে জানানো হতো যে ব্যাপারটি সাজানো। এমনটিই ঘটেছিলো ২০১০ এ।
১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫, মার্কো লুইজিয়ানা বা ওয়াশিংটন, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেই ছিলেন না। তিনি ছিলেন হ্যানোভার, জার্মানীতে। Max Planck Institute for Gravitational Physics এ কর্মরত অবস্থায়। তিনি ইটালীতে অবস্থানরত এক সহকর্মীর সাথে ফোনালাপে ছিলেন। এমন সময় তার পাইপ লাইনে ই-মেইল এলো যে উভয় LIGO ডিটেক্টরেই ৩ মিনিট আগে (স্থানীয় সময় ১১:৫০:৪৫) একটি “event”, বা নন-রুটিন রিডিং ধরা পড়েছে। এ ধরণের ই-মেইল রোজই এসে থাকে, তবে এবারের "signal to noise ratio" ২৪। যেখানে স্বাভাবিক অবস্থায় এটা ১০ হয়ে থাকে।
এটা এতই জোরালো ছিলো যে মার্কো ধরে নিলেন এটা সত্যি নয়, অর্থাৎ আরেকটি injection। অনেক সময় যন্ত্রপাতি টিউনিং করার সময়ও injection (open injection) হয়ে থাকে। মার্কো হ্যানোভারের আরেক সহকর্মী Andrew Lundgren কে জিজ্ঞেশ করলেন যে কেউ এ ধরণের open injection ঘটিয়েছে কিনা, যার কোন লগ রাখা হয়নি। Lundgren সে ধরণের কিছু জানেননা বলে জানালেন। এরপর তারা দু’জনেই লিভিংস্টোন আর হ্যানফোর্ডে ফোন করলেন যে সেখানে কেউ যন্ত্রপাতি নিয়ে গুতাগুতি করেছে কিনা। লিভিংস্টোনে তখন ভোর ৫টা। হ্যানফোর্ডে রাত দু’টার সামান্য পর। একটি থেকে জবাব এলো “সব কিছু স্বাভাবিক আছে”। তখন মার্কো কোলাবোরেশানের সব্বাইকেই ই-মেইলে জানালেন যে কেউ কোন injection এর ব্যাপারে জানে কিনা। কেউ “হ্যাঁ” বলেনি। সেক্ষেত্রে এটা বানোয়াট করাও সম্ভব ছিলোনা কেননা ওভার হলিংয়ের জন্য সিক্রেট blind injection এর যন্ত্রপাতি বন্ধ ছিলো।
যাহোক, সবাই জেনে গেলো যে LIGO ‘তে একটি খুব বড় সিগনাল ধরা পড়েছে। ক’দিন পর LIGO লীডাররা জানালেন যে এই ইভেন্টটি সম্ভবত false নয়।
যখনই গবেষকরা বুঝলেন যে কিছু একটা সম্ভাব্য আবিস্কার দিগন্তে উঁকি দিচ্ছে, তখনই তারা engineering run mode থেকে data taking mode এ switch করলেন। অফিসিয়ালি ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ এই ঘটনার “সোর্স” খোঁজা শুরু হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বৈজ্ঞানিকেরা ইতিমধ্যেই পাওয়া তথ্যের নির্ভরযোগ্যতার জন্য আরও ডাটা খুঁজছিলেন। ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ ইত্যাদি ফিল্টার, আরও বহু কিছু যাচাই বাছাইয়ের জন্য পাঁচ দিনে ধরে অনবরত ডাটাস্ট্রিমের প্রয়োজন ছিলো। অবশেষে ৫ অক্টোবর ২০১৫ নাগাদ, সেটা তারা পেয়ে গেলেন।
কিন্তু কর্তৃপক্ষ পুরো ব্যাপারটাই চেপে রাখতে চাচ্ছিলেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। যেন আবার বলতে না হয়, “...Oops! Sorry, we were wrong!”। এত বিশাল এক আবিস্কার। কিন্তু যদি কোন কারণে ভুল প্রমাণ হয়, তবে একাধারে NSF, MIT, Caltech, LIGO আর হাজারেরও অধিক বৈজ্ঞানিকের বেইজ্জতি। তাই এই গোপনীয়তা। কিন্তু তথ্য ঠিকই বেড়িয়ে যায়।
অবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে এর ঘোষণা আসে। ১১ ফেব্রুয়ারী ২০১৬ ওয়াশিংটন ডিসি’র National Press Club এ সাংবাদিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে দাওয়াত দেয়া হয়। সেখানে NSF, MIT, Caltech, LIGO Scientific Collaboration (LSC)’র কর্মকর্তা আর বৈজ্ঞানিকবৃন্দের উপস্থিতিতে LIGO Laboratory’র Executive Director David Reitze ঘোষণা দেন, “We did it!”।
এরপর মার্কো বলেন -
“I’m going to call up my family and say, ‘You know, I was the first to see this.’”
বাস্তব জীবনে মার্কো মৃদুভাষী। তিনি পিয়ানো বাজান আর দু'টো ফ্যান্টাসী নভেল বার করেছেন।
তাহলে এটাই কি শেষ? না, এটা সবে শুরু। ইতিমধ্যেই চীনারা এ বিষয়ে বিশদ গবেষণার জন্য পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। সারা বিশ্বব্যাপী এ নিয়ে আরো নতুন গবেষণা হবে। আসবে নতুন তত্ত্ব। অনেকে ভাবছেন এ দিয়ে কোয়ান্টম গ্র্যাভিটি ব্যাখ্যা করা যাবে কিনা। আরও কত মুনির কত মত! দেখা যাক কি হয়...
আত্ম-বিজ্ঞাপণমূলক কথা - ক'দিন আগে আইনস্টাইনের Gravitional Field Equations এর আবিস্কারের ব্যাপারে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম।
আজি হতে শত বর্ষ আগে
সূত্র:
Gravitational waves: How LIGO forged the path to victory
Gravitational waves: breakthrough discovery announced - as it happened
LIGO Scientific Collaboration
Marco Drago
LIGO Caltech
Here’s the first person to spot those gravitational waves - by Adrian Cho
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:৪১