১৩০২ বঙ্গাব্দের ২ ফাল্গুন এ লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "১৪০০ সাল" কবিতাটি চিত্রা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। সমগ্র রবীন্দ্র রচনাবলী হয়তো অনেকেরই পড়ার সময় সুযোগ হয়ে ওঠে না। কিন্তু এই কবিতাটি পড়েননি এমন লোক খুব কমই পাওয়া যাবে। কত স্নিগ্ধ আর সহজ ভাবে তার ফাগুন-প্রভাতের বার্তা তিনি ভবিষ্যতের কাছে পৌছে দিয়েছেন।
কবিগুরু ১৯৩০ সালের ১৪ জুলাই, বার্লিনের প্রান্তে Caputh গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে আর্কিটেক্ট Konrad Wachsmann এর ডিজাইন করা এক বিখ্যাত গ্রীষ্মকালীন নিবাস আছে। সেটা তিনি তার আজীবনের বন্ধু অন্যতম শ্রেষ্ঠ তত্ত্বীয় পদার্থবিদ Albert Einstein এর জন্য নক্সা করে দিয়েছিলেন। আইনস্টাইন তার বোন Maja’র কাছে লিখেছিলেন - "The little house in Caputh is a flop, but a very nice one"।
খুব বেশী হৈচৈ, বা মনোযোগ এড়াতে পদার্থবিদ্যার গুরু এখানে চলে যেতেন। এর লেকে তিনি নৌকা চালাতে ভালবাসতেন।
এই ছোট্ট বাড়ীতেই সাহিত্য আর বিজ্ঞানের দুই দিকপালের সাক্ষাৎ। কবিগুরু আইনস্টাইনকে বলেছিলেন –
“You have been busy, hunting down with mathematics, the two ancient entities, time and space, while I have been lecturing in this country on the eternal world of man, the universe of reality.”
তারও ১৫ বছর আগে ১৯১৫ সালে তিনি প্রকাশ করেন সেই কালজয়ী জেনারেল রিলেটিভিটির থিওরী।
সালটা ১৯০৫। সুইটজারল্যান্ডের বার্ন শহরে এক ২৬ বছরের যুবক সুইস প্যাটেন্ট অফিসে কেরাণীর চাকরী করে। সে বসে বসে বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশানের পরীক্ষা করে আর বিজ্ঞান চর্চা করে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে সে তার ডক্টোরাল থিসিস জমা দিয়েছে। এই সময়েই Annalen der Physik (Annals of Physics) জার্নালে Annus Mirabilis papers এর প্রথম চারটি পেপার প্রকাশ হয়। চতুর্থটি ছিলো বিখ্যাত স্পেশাল থিওরী অফ রিলেটিভির পথিকৃত। এর কিছুদিন পর পঞ্চম আর্টিকেলটি প্রকাশিত হয় যেখানে সেই বিখ্যাত ভর আর শক্তির সাম্যতার সমীকরণটি রয়েছে। এই পাঁচটি আর্টিকেল, বিশেষ করে শেষের চারটি আধুনিক পদার্থবিদ্যার বুনিয়াদের মত। এগুলোতে ব্যাখ্যা করা আছে Photoelectric effect, Brownian motion, Special relativity আর Mass–energy equivalence।
সেই বৎসরটি আরও অনেক কারণে বিখ্যাত। সে বৎসর Sigmund Freud তার “Jokes and their Relation to the Unconscious” প্রকাশ করেন। পাবলো পিকাসো ব্লু পিরিয়ড থেকে রোজ পিরিয়ড শুরু করেন। জেমস জয়েসের প্রথম বই "Dubliners" সমাপ্ত হয়। কিন্তু খ্যাতিতে সব কিছু ছাড়িয়ে যায় পদার্থবিদ্যার এই নতুন থিওরী।
এরপর কেটে গেলো আরও দশটি বছর। অবশেষে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ১৯১৫’র ২৫ নভেম্বর বার্লিনের প্রুশান অ্যাকাডেমী অফ সায়েন্সে আইনস্টাইন উপস্থাপনা করেন বর্তমান পদার্থবিদ্যার ধরে নেয়া দুইটি স্তম্ভের একটি – জেনারেল থিওরী অফ রিলেটিভিটি। মূলতঃ সেদিন তিনি জেনারেল রিলেটিভির Gravitational field equations যা Einstein equations নামেও পরিচিত, তা প্রকাশ করেন। এর আগের তিন দিনে (৪, ১১, ১৮) তিনি আরও তিনটি পেপার প্রকাশ করেন। ১৮ নভেম্বরের পেপারে জ্যোতির্বিদ্যার বিখ্যাত সমস্যা, বুধ গ্রহের perihelion এর এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সমাধান দেয়া হয়।
কোপার্নিকাস নিজেও বুধ গ্রহের গতিপথের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সমস্যার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন -
"this planet has . .. influenced many perplexities and labours on us in our investigation of its
wanderings."
এর পর Tyco Brahe'র সময় কেটে গিয়েছে। তার শিষ্য Johannes Kepler চেষ্টা করেছেন। তিনি পৃথিবী আর সূর্যের মাঝ দিয়ে বুধ গ্রহের চলে যাওয়ার (transit) সময় ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৬৩১ এর ৭ নভেম্বরের ট্র্যানসিট, তার বর্ণিত সময়ের মাত্র পাঁচ ঘন্টা এদিক ওদিক হয়ে ছিলো। কিন্তু তিনি এ ঘটনা দেখে যেতে পারেননি। তার আগেই তার মৃত্যু হয়েছিলো। এরপর আদিগুরু নিউটন "Kepler's laws of planetary motion" এর উন্নতি ঘটান। তার ব্যাখ্যা করা থিওরী প্রায় দু'শো বছর টিকে ছিলো। ১৮৪৬ সালে ফরাসী জ্যোতির্বিদ Le Verriere নিউটোনিয়ান মেকানিকস ব্যবহার করে ইউরেনাস গ্রহের গতিপথের সমস্যার জন্য দায়ী এক অজানা ভারী বস্তুর স্থান পিন-পয়েন্ট করেন। সে সময়ের অন্য জ্যোতির্বিদগণ তাদের টেলিস্কোপ সে জায়গায় তাক করলে প্রথম বারের মত সৌরজগতের অষ্টম গ্রহ নেপচুন আবিষ্কৃত হয়। ১৮৪৬ এর ২৩ সেপ্টেম্বর Johann Galle নেপচুন আবিষ্কার করেন। Urbain Le Verrier এর প্রেডিক্সানের মাত্র এক ডিগ্রীর মাঝে এটা পাওয়া যায়। এটাই একমাত্র গ্রহ, যা গাণিতিক ভবিষ্যদ্বাণীর মাধ্যমে আবিষ্কৃত হয়েছে। এর সাথেই নিউটনের থিওরী শীর্ষবিন্দুতে পৌছে যায়। কিন্তু এর কিছু পরেই Verriere বুঝতে পারেন, বুধ গ্রহের গতিপথের সমস্যার জন্যও সূর্য্যের কাছাকাছি সেরকম কিছু অজানা ভারী বস্তুর প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে সেটা নেই। ব্যস্, নিউটন মহোদয় সমস্যায় পড়ে গেলেন। শেষমেষ উদয় হলেন আইনস্টাইন। তিনি খুব সফলতার সাথে এটা ব্যাখ্যা করেন। ১৯১৯ সালে পরীক্ষামূলকভাবে জেনারেল থিওরী প্রমাণিত হলে আইনস্টাইনের তারকা খ্যাতি জুটে যায়।
আর মাত্র ক’টি দিন। এরপর সেই থিওরীর শতবর্ষ পূরণ হতে যাচ্ছে। যদিও পদার্থবিদ্যার আরেক স্তম্ভ, কোয়ান্টাম ফিজিক্সের সাথে এর সাক্ষাৎ বিরোধ, তবুও এটা ছিলো এক আশ্চর্যজনক আবিষ্কার। সমস্যা হচ্ছে, বর্তমানে শক্তিশালী বিভিন্ন যন্ত্রের কল্যাণে মানুষ আজ বহু কিছু দেখতে পায়। তাতে দেখা যাচ্ছে গ্যালাক্সী সমূহ আরও দ্রুততর গতিতে পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ বিগ ব্যাং এর পর বিগ ক্রান্চ হবার আপাতত কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছেনা। এর মানে এই নয় যে জেনারেল রিলেটিভিটির তত্ত্ব ভুল হয়ে গিয়েছে। ছোটখাট সমস্যা দেখা দিচ্ছে। দেখা যাক নতুন কোন থিওরীর দরকার পড়ে যায় কিনা?
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:১৪