একা একা প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখতে যাবার সবচেয়ে বড় সমস্যাটা হলো যে, আপনাকে ওরা বেছে বেছে একেবারে কর্নারের সিটে পাঠাবে। এটা আমার জন্য নতুন কিছু না। স্টার সিনেপ্লেক্সে আমার মুভি দেখার মানেই হলো পেছনের সারির একেবারে এক মাথার কোন একটা সিটে বসা। তবে এবার টিকেট নেবার আগেই আবদার করে বসলাম, "এক্সকিউজ মি, সিটটা জেনো মাঝে পরে।" উত্তর আসলো, " অবশ্যই স্যার, আপনার যেখানে ইচ্ছা নিতে পারেন"। বলাকাতে কিংবা অন্য কোন ৪২০ সিনেমা হলে মুভি দেখতে গেলে হয়তো যেকোন যায়গায় সিট মিলতে পারে, তবে এইরকম কার্টেসি পাওয়া যাবে না। আমি যে এই সমাজের অন্যতম একটা ব্যক্তিত্ব, এবং আমিও যে 'স্যার' সম্বোধনটা ডিজার্ভ করি সেটা উপলব্ধির জন্য হলেও সিনেমা দেখতে এখানেই আসি সবসময়।
সিটটা অস্থির একটা পজিশনে ছিলো। প্রথমে এক কাপল আসলো, তাদের সিট আমার ডানদিকে। মেয়েটা এসেই আমার সিটের সন্নিহিত সিটটাতে বসে পরলো। কিন্তু তার জাঁদরেল প্রেমিক এক মুহুর্ত কি জেনো ভাবলো, অতঃপর তাকে বসতে বললো পাশে, আর নিজে বসলো আমার সিট সংলগ্ন সিটে। জাহ, সালা, বেশি হিংসা করে প্রেমিকা নিয়ে। ওর চিন্তা বাদ। এবার আমার বাম দিকে আসলো এক বাবা আর মেয়ে। যথারিতি আগের মতই মেয়েটা আমার সিট সংলগ্ন বা দিকের সিটে বসে পরলো। তার পর সেই একই কাহিনী। শেষমেষ আমার দুই পাশে রইলো দুই পুরুষ। মাঝে সিট নিয় কোন লাভই পেলাম না। এর চেয়ে একপাশে দেয়াল থাকলেও বেটার, আই মিন কর্নারের সিটই শ্রেয়।
যাহোক, দুঃখের কথা রেখে এবার মুভির কাহিনীতে আসি। যারা দেখেন নি তাদের জন্য সামান্যতে সামারিটা বলছি-
একটা রিয়েলিটি শো কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে “দেশা দ্যা লিডার” সিনেমার গল্প। জনগনকে ভোটের মাধ্যমে তাদের নেক্সট লিডার নির্বাচন করতে হবে। মোট ভোটার থেকে লটারীর মাধ্যমে নির্বাচিত একজন ভোটারের জন্যও থাকছে বিশেষ পুরস্কার। সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে যে লিডার বিজয়ী হবেন তিনি যাবেন লটারিতে বিজয়ী হওয়া ভোটারের বাড়িতে, থাকবেন দুইদিন। সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে বিজয়ী লিডার হলেন হায়দার হোসেন (তারিক আনাম খান) এবং লটারিতে বিজয়ী হওয়া সেই ভোটার হলেন সেলিম (শিপন)। অনুষ্ঠানটির উপস্থাপিকা হচ্ছেন সৃষ্টি (মাহিয়া মাহি)। চ্যানেলের নাম-'চ্যানেল ৯৯'
.
তো রিয়েলিটি শো এর ফাইনাল শেষে হায়দার দুইদিন থাকার জন্য সেলিমের গ্রাম আয়নাপুরে যান। সেখানে জনগনের ভোগান্তিগুলো খুজে বের করতে থাকেন। এমতাবস্থায় সন্ত্রাসীরা হামলা করে বসে উনার উপর। এতে নির্বিচারে মারা পরে গ্রামের মানুষ। সেলিমের বাবা মা দুজনেই মারা পরেন। হায়দার ও সেলিমও আহত হন বুলেট লেগে।
এরপর দেখা যায় হায়দার সেলিমকে শহরে নিয়ে আসেন। তার রাজনৈতিক দল জাগরণ পার্টির দায়িত্ব তুলে দেন সেলিমের হাতে। এবং সেলিমকে জনগনের(জনগন বলতে ১৫০-২০০ মানুষ) সামনে দেশপ্রেমিক দেশা- দ্যা লিডার হিসেবে গড়ে তোলেন। এইদিকে আয়নাপুরে সন্ত্রাসী হামলায় হত্যাযজ্ঞ নিয়ে তদন্ত চলতে থাকে। যারা সেই হত্যাজজ্ঞে অংশ নিয়েছিলেন তারা সবাই একে একে খুন হতে থাকেন। এমনকি রিয়েলিটি শো এর প্রডিউসার জামান ও খুন হন।
এরপর উপস্থাপিকা সৃষ্টি (মাহি) একদিন ভিডিও ফুটেজগুলো ঘাটিয়ে আবিস্কার করলেন যে আয়নাপুরের সেই হামলায় জড়িত ছিলেন তাদের চ্যানেল ৯৯ এর প্রোগ্রাম প্রডিউসার জামান ভাই। সে সব কিছু সেলিমের সাথে আলোচনা করে সমস্ত ইনফরমেশন একত্র করলো এবং সেটা জাগরণ পার্টির হায়দার হোসেনের কাছে পাঠিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিলো।
উল্লেখ্য ইতমধ্যে উপস্থাম্পিকা সৃষ্টি এবং সেলিমের মধ্যে প্রেম শুরু হয়ে গেছে।
এইসময়ে দেখা গেলো সকল ধারনা ১৮০ ডিগ্রী কোনে ঘুরে গেছে। হায়দার হোসেনই (তারিক আনাম খান) সকল নাটের মূল। সেই সবগুলো খুন করিয়েছে নিজেকে নির্বাচনে জেতানোর জন্য।
অবশেষে সেলিম সব জানতে পারে। সে জনগনের (অ্যাকচুয়ালি জনগন বলতে বড়জোর ১৫০-২০০ জনই হবে) সামনে সবকিছু প্রকাশ করতে থাকে। ধীরে ধীরে সত্যিকারের নেতায় পরিনত হয় সে। দেশজুড়ে তার সুনামের ঝড় বইতে থাকে।
এমতাবস্থায় একদিন সে এবং সৃষ্টি রাতের বেলা হাতিরঝিলে ডেটিং করতে আসে। (উল্লেখ্যঃ এর আগে, এই জায়গাতেই সে এবং সৃষ্টি ইতঃপূর্বে একবার সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছিলো)
যাহোক, সৃষ্টি (মাহি) বাড়ি ফেরার পথে ট্রাক দিয়ে তার গাড়িকে চাপা দিয়ে তাকে মেরে ফেলা হয়। এরপর সেলিম তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। সে হায়দারকে হুমকি দেয় যে তার সব কিছু সে জনগণের কাছে ফাঁস করে দেবে। এইখানে হায়দারের উদ্দেশ্যে বলা একটা সেলিমের বলা একটা অস্থির ডায়ালগ আছে।
সেটা হলো-
"হায়দার.........(লম্বা টান)............থুহ।"
ছবির শেষ দৃশ্যে এমনটাই দেখা যায়্ যে সেলিম জনগণকে (জনগনের সংখ্যা হলো ৮০-১০০) সব জানিয়ে দেয়। এবং জনগন (৮০-১০০) হায়দার হোসেনকে মারতে তেরে আসে।
সিনেমাটির কাহিনী কনসেপ্ট মূলত তেলেগু মুভি ‘কো দ্যা লিডার’ এবং ‘ক্যামেরাম্যান গঙ্গা রামবাবু’ থেকে নেওয়া।
আমার দেখা অন্যতম দীর্ঘ বাংলা সিনেমার তকমা পাবে এটা। শেষের দিকে সিটের উপর পা তুলে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করেছিলাম। তবে হঠাৎ হঠাৎ নায়কের আজাইরা এবং ফালতু হুংকারে চোখ দুইটা মিলাতে পারি নাই। বাধ্য ছেলের মত স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম আর ছবি দেখার আগে নিচতলা থেকে যেই হাতঘরিটা কিনেছিলাম সেটার টাইম পর্যবেক্ষন করছিলাম।
আমি আজ পর্যন্ত যত রিয়েলিটি শো দেখেছি তার ম্যাজরিটির ফাইনালই রাতে হতে দেখেছি। দিনের বেলা ফাইনাল হয় এমনটা এই মুভিতে দেখে খুব বেমানান মনে হলো।
গ্রামের ছেলে সেলিম। বাট আশ্চর্জ হই তার কথা বার্তায়। বাপরে, একেবারে সাবানা আলমগীর যুগের মুভির কথা মনে পড়লো। যেখানে নায়ক কিংবা নায়িকা বস্তিবাসী হলেও সাংঘাতিক শুদ্ধ কথা বলে। এই মুভিতে সেলিম অজপাড়াগায়ের ছেলে হওয়া সত্যেও কি অস্থির টাইট টাইট জিন্স পরে, ফিটিং শার্ট পরে। গাঁয়ের পোলাপান লুঙ্গি ছাড়া দেখলে বিশ্বাসই হয়না বাংলাদেশে আছি নাকি।
মুভিতে জননেতা হায়দার (তারিক আনাম খান) যেভাবে জনসভায় নিজের কাধের চাঁদর/শাল (আমি চাঁদর আর শালের তফাৎ বুঝি নাহ ) সেলিমের কাধে তুলে দেন, সেটা দেখে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর গলার গামছার কথা মনে পড়ে যাবে।
সেলিম কিন্তু হায়দার হোসেনের কথাতেই তার জাগরণ পার্টির দায়িত্ব গ্রহন করে নাই, তাকে কনভিন্স করার নেপথ্যে ছিলো সৃষ্টি (মাহি)। তাও আবার একদিন রাতে গোরস্থানে।
যারা কুড়িল ফ্লাইওভার আর হাতিরঝিল দেখেন নাই এখনও, তারা এই মুভি ভালো করে দেখলেই হবে। এই মুভিতে মনে হয় রাস্তা বলতে এই দুইটাই ছিলো। যা কিছু হয় সবই কুড়িল ফ্লাইওভারের উপরে নইলে হাতিরঝিলের নিচে।
টু বি অনেস্ট, যতই 'দেশা দ্যা লিডার'...... দেশপ্রেমিক, কান্ডারী ভাব দেখাক না কেনো, নায়কের গালের খোচা খোচা দাঁড়ি আর ঘর্মাক্ত মুখ দেখলে মনে হবে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে দেউলিয়া তরুন। বড়জোর ভলান্টিয়ার মনে হইতে পারে, বাট নেতা নাহ।
আপনারা বাংলাতে জাকির নায়েকের লেকচার শুনেছেন নিশ্চয়ই? আমার কাছে মনে হয়েছে এই মুভিতে প্রধান চরিত্র গুলো বাদ দিলে, বাকি গুলোর ৭০% এর কন্ঠ বোধহয় ঐ লোক দিয়েছেন যিনি জাকির নায়েকের লেকচারের বাংলা ড্রাবিং করেন। (আমার আন্দাজ। তবে আওয়াজটা সেইরকমই)
মাহির অভিনয় ভালো ছিলো। অন্যদিকে নায়ক শিপনের অ্যাকটিং সেই তুলনায় শুধু বাজেই না, সাংঘাতিক বাজে। ফালতুর চরম সীমায় উপনীত হয়েছে তার অ্যাকটিং। ১০ এর মধ্যে আমি আন্ডা দিবো নায়ককে। তবে পুরো সিনেমায় সবচেয়ে ভালো পারফর্মেন্স ছিলো দরবার খান চরিত্রে টাইগার রবি এবং মধু চেয়ারম্যান চরিত্রে সোহেল খানের।
সবশেষে, এইরকম মুভি যদি প্রেক্ষাগৃহে আলোড়ন তোলে তাহলে সত্যিকার অর্থেই ভাবতে হয় যে আলোড়ন ব্যাপারটাও কতটা ফালতু হতে পারে!