রাজীব নূরের বাবা মারা যান সম্ভবত করোনাকালীন সময়ে। (আল্লাহ উনাকে জান্নাত নসিব করুন ) উনি বাবাকে খুব ভালোবাসতেন। বাবাকে হটাৎ হারিয়ে ফেলাকে উনি মেনে নিতে পারেননি। উনি স্বাভাবিক ভাবেই ঘরের মধ্যে চলে গিয়েছিলেন। বাবাকে কবর দিয়ে এসে ঘরে ঢুকে বড় একটা ধাক্কা খেলেন। উনি দেখলেন উনার বিছানায় উনার বাবা বসে আছেন। রাজীব নূর উনার মৃত বাবাকে দেখেছিলেন।
আমার আব্বা মারা গেলেন ১ মাস হয়ে গেলো। ছোটবেলা থেকে কখনো ভাবিনি অন্তত একদিনেই জন্য আব্বা কে ছাড়া থাকতে পারবো। ছোটবেলায় রাতে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি বহুবার। কাউকে কারণটা বলিনি। বলিনি আব্বা ছাড়া আমি কিভাবে থাকবো ? কার সাথে হাটবো , কে পিঠে হাত বুলিয়ে দেবে। মাথার কাছে গল্পের বই রেখে দিবে , একটা রাশিয়ান শৈশব দেবে , কার জন্য পড়ন্ত বিকালে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবো ? কাউকে বলতে পারিনি কখনো সবাই ভে বছে শরীর খারাপ করছে। পেতে ব্যথা।
সেই ব্যথা নিয়ে এতো বছর কাটিয়ে দিলাম। আবার মারা যাবার আগের রাতেও ফুরিয়ে উঠলাম। আব্বাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো ভেবে। সেদিন সকালে যখন দেখলাম আব্বা মারা গেছেন , কি স্বভাবিক ভাবেই না মেনে নিলাম। চোখে কোনো পানি আসলো না , চিৎকার করে উঠলাম না এমনকি চোয়াল কাঁপলোনা এতুটুকুও ! আব্বা কে ইম্পেরিয়াল লেদার সাবান দিয়ে গোসল করানো হচ্ছে। মাই তাকিয়ে দেখছি। আব্বা ইম্পেরিয়াল লেদার সাবান ঈদে ঈদে মাখতেন। সেই কথা আগেও লিখছে। সেই স্মৃতিচারণ লিখতে গিয়ে চোখ ঝাপসা হয়েছে।
কি কিন্তু কি অদ্ভুত ! আব্বার নিস্প্রান দেহে যখন সাবান মাখিয়ে গোসল করাচ্ছে তখন একটুকুও কান্না আসলো না। সেই কান্না আমার এখনো আসেনি।
খাটিয়া কাঁধে নিয়ে যখন হাটছি তখন আবার ছেলেটা শক্ত করে হাত ধরে থাকলো। ফুঁপিয়ে বললো , "দাদা কি জান্নাতে চলে গেছে ? দাদার জন্য বড়ই রাখছি হাতের মধ্যে। দাদা কে দিয়ে দিবো। "
তখন আমার হুহু করে কেঁদে উঠা দরকার ছিল। এমন কান্না তো অনেক কেঁদেছি। কিন্তু আজ কেমন স্তব্ধ।
জানাজায় কিছু বলতে হয় ছেলে হিসেবে। সামনে হাজার হাজার লোক। আমি তেমন কিছু বলতে পারলাম না। খুব শান্ত কণ্ঠে বললাম , মোঃ রুহুল ইসলাম কারো কাছে হেডস্যার ছিলেন , কারো কাছে শিক্ষা গুরু , কারো কাছে অভিভাবক , কারো কাছে ভালো মানুষ। আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন মোঃ রুহুল ইসলাম কেমন ছিলেন ? আমি বললো মোঃ রুহুল ইসলাম আমার বাবা ছিলেন।
ডায়ালগ টা মোটামুটি মুখস্ত। একটুকুও আটকালো না। ঠোঁট কাঁপলোনা। চোখ ভিজলোনা। কতইনা স্বাভাবিক।
আব্বাকে পারিবারিক কবরস্থানে নিয়ে আসা হলো। কবর শোয়ানো হলো। কিছুক্ষন পর আব্বাকে আর দেখতে পারবো না। মনে হচ্ছে বারবার। চোয়াল কাঁপছে। কিন্তু চোখ ভিজছে না। এতো শক্ত আমি কখনোই ছিলাম না।
আব্বাকে কবে নামানো হবে , আমি আব্বাকে শোয়ানোর জন্য কবরে নেমে গেছি। কোনোদিন ভাবিনি আমি আব্বাকে কবরে নামাবো। কি অদ্ভত ভাবে শান্ত আছি তখন। অনেক অনেক লোক। উপরে আমার ছেলে দাদার জন্য কাঁদছে। কিন্তু কি অদ্ভুতভাবে আমি চুপ করে আছি।
কবরে মাটি দেয়া হচ্ছে। আব্বার মাথার কাছে বসে মাটি দিচ্ছি। সাথে আমার ছেলে ছোট হাতে দাদার কবরে মাটি দিচ্ছে। কে কেন বললো ফেরেস্তা মাটি দিচ্ছে। মাটি দিতে দিতে ছেলে বললো , বাবা , দাদার জন্য রাখা বড়ই হারিয়ে ফেলেছি। আমি কি দাদার কবরে বড়ই গাছ লাগাতে পারবো ?
আমি শান্ত গলায় বললাম , পারব।
আব্বা কে রেখে বাড়ি ফিরছি। বুকটা খুব ভারী হয়ে উঠছে। কলিজায় টান লাগছে। টোকা দিলেই ফেটে পড়বো হয়তো। আমার ছেলে হাত ধরে হাটছে। হাটতে হাটতে আমাকে বললো , বাবা , তুমি আমাকে এতো ভালোবাস কেন জানো ?
আমি বললাম, না।
আমার ছোট্ট ছেলেটা বললো , তোমার বাবা তোমাকে খুব ভালোবাসতো তো তাই!
বুক ফেটে কান্না চলে আসছে। আমি চুপ করে আছি। ছেলেটা আমার হাত শক্ত করে ধরে আছে। হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো- ব্লগার রাজীব নূর লিখেছিলেন , উনি উনার মৃত বাবা কে দেখেছিলেন কবর দিয়ে আসার পর। আমিও হয়তো দেখবো। দেখার সাথে সাথে হয়তো চিৎকার করে কেঁদে উঠবো।
না, আব্বাকে এখনো দেখিনি। সীমাহীন ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করছি যদিও।
নিহাল ওর দাদার মাথার কাছে বড়ইয়ের গাছ লাগিয়েছে। গাছটা বেড়ে উঠবে কিনা জানিনা। যদি বেড়ে উঠে , প্রচুর বড়ই ধরবে তাতে। পাখপাখালির আনাগোনা হবে। মানুষ জন খাবে। আমাদের বাড়িতে অনেকগুলো ফলের গাছ ছিল , প্রায় সবই আব্বার লাগানো। তিনি গাছের ফল বিতরণ করতেন।
আমাদের বাড়ির সাথে সেই বড়োই গাছটা ছিল , সেই গাছের পাশে আব্বা চেয়ার নিয়ে বসে থাকতেন। প্রচুর বড়ই ধরলে তিনি খুব খুশি হতেন। বড়োই যখন পাকা শুরু করতো তখন পাখিদের আনাগোনা বাড়তো। সারাদিন কিচিরমিচির। বেশি কিচিরমিচির করতো পাড়ার বাচ্চারা। কেউ বড়োই গাছের পাশ দিয়ে গেলে আব্বা বলতেন , কিরে ? বড়োই লিবি (নিবি) ?
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:২৬