সাত বন্ধু ইয়ুসিকের
এক যে ছিল ছোট্ট বন্ধু : ইয়ুসিকে। রোববারের দিনটা বড়ো ভালো লাগতো তার।
কোনোরকম ভয়-ভাবনা, ঝক্কি ছাড়াই সকাল থেকে সন্ধ্যে ত্ক এমন চমৎকার খেলাধুলো আর ছুটোছুটি আর কোনদিনই বা সম্ভব !
রোজই কী করে এমন করা যায়, ভাবতে বসে ইয়ুসিকে। সে ঠিক করে -
যে-দেশে বাস রোববারের , সেখানে যাবে সে ;
গিয়ে বলবে : রোজ কেন আসো না গো তুমি, রোজ এসো। ইয়ুসিকে ভাবে যে, ঐ যে ওখানে একটা বোন আছে , যেখানে
প্রত্যেক দিন সন্ধ্যেবেলা লুকিয়ে থাকে সূর্য্যি , ওরই মধ্যে থাকে সব ক'টা দিন।সত্যিই তো , রোজই সকালে যখন তার ঘুম ভাঙে সে দ্যাখে, যথানিয়মে সূয্যি মামা একটা নতুন দিন নিয়ে এসেছে। তাই , সূর্যের পিছন-পিছন পথ চলতে লাগলো ইয়ুসিকে ।
যেতে যেতে যেতে যেতে সে গিয়ে পৌঁছুলো ঘুরঘুট্টি এক বনে।এখানে এসে সূর্য কে একেবারে দেখায় গেল না।
শরীরে যত ক্ষমতা আছে সব নিয়ে ভীষণ জোরে দৌড়ুতে লাগলো ইয়ুসিকে, সূয্যি মামাকে তো ধরতে হবে , কিন্তু বোনের সীমানা আর শেষ হয়না।
কোথায় লুকিয়ে গেলো সূয্যি মামা , আমাদের খোকন তা দেখতেই পেল না।
এদিকে রাস্তায় যেতে যেতে দেখা এক বিরাট পিঁপড়ে- ঢিপির সাথে।
পিঁপড়েরা তো তাদের বাড়িতে ঢুকবার-বেরুবার সব পথ আটকে দিয়েছে -
সাঁঝের আঁধার ঘনিয়ে আসছে যে !
-- পিঁপড়ে দাদা , পিঁপড়ে দাদা , জানো তোমার রোববার কথা থাকে ? -- জিজ্ঞেস করে ইয়ুসিকে।
-- বোনের মধ্যে কত রাস্তা দিয়েই তো গেছি আমরা , কিন্তু রোববারের দেশ --- তা তো বাপু কোথাও দেখি নি। --- জবাব দ্যায় পিঁপড়েরা। --- তা , তুমি নীলকণ্ঠ পাখির কাছে একটু যাও দেখি , হয়তো সে জানতে পারে।
ইয়ুসিকে তখন নীলকণ্ঠের কাছে যায়।
শ্রীমতি নীলকন্ঠী বসে ছিল বারবাড়িতে , বসে বসে ঘুমপাড়ানী গান গাইছিল বাচ্চাদের জন্য।
-- পেন্নাম হই। আদাব, আদাব , নীলকন্ঠী দিদিমনি। যেন নাকি , কোথায় থাকে রোববার ?
- না তো , -- জবাব দ্যায় নীলকণ্ঠী। -- আমি তো বাপু সারা দিন ভর আমাদের খোকাখুকুর জন্য
পোকামাকড় খোঁজে উড়ে উড়ে বহুত দূর গিয়েছিলাম, কিন্তু ওরকম রাজ্যি তো দেখতে পেলাম না।
হয়তো বা প্যাঁচা জানতে পারে -- ঐ যে বিশাল ওক গাছটায় যে থাকে।
প্যাঁচা আমাদের জ্ঞানী মানুষ, সব শুনতে পায়, আর এমনকি রাত্তিরে দেখতেও পায়।
ইয়ুসিকে তখন যায় প্যাঁচার কাছে।
-- প্যাঁচা দাদা , প্যাঁচা দাদা , দাদার আমার সরেস মাথা ! দাদা বলতে পারো আমায় তুমি , কোথায় থাকে রোববার ?
প্যাঁচ সারাদিন ঘুমুবার পর তক্ষনি মাত্র উঠেছে , কেননা সন্ধ্যে হয়ে এসেছে কিনা তাই।
-- রোববারের বাড়ি এখান থেকে তো এখনো বেশ দূর, -- জবাব দেয় প্যাঁচা। -- ঠিক আছে তুমি বাপু সোজা পথ হাটো। ভয়ডর না করে হাটো। হাঁটতে হাঁটতে সোমবারের দেশ পেয়ে যাবে। সোমবার খুব কাজের মানুষ আর অমায়িক , বুঝলে কিনা --
সেই তোমার পথ দেখিয়ে দেবে।
দূরে বা কাছে যাই হোক , সোমবারের দেশে পৌঁছে গেলো ইয়ুসিকে।
-- পেন্নাম হই, আদাব আদাব, সোমদাদা , -- ইয়ুসিকে বলে ওঠে ,-- রোববারের কাছে যাবার রাস্তাটা একটু দেখতে পারো ভাই?
-- আদাব, আদাব, ইয়ুসিকে ! -- সোমবার জবাব দ্যায় , -- রোববার যে -দেশে থাকে সে ছ'দিনের পথ।
রাস্তা তোমায় বলে দিচ্ছি না হয় , কিন্তু তার আগে একটু সাহায্য করো না ভাই -- ঘাসবিচালিগুলো পরিষ্কার করতে হবে।
রাজি হয়ে গেলো ইয়ুসিকে। দুজনে বেশ মিলেমিশে কাজ করলো;
সন্ধ্যের দিকে সুগন্ধি ঘাসবিচালির পালুই তৈরি করে রাখলো অনেকগুলো।
মনদিয়ে কাজ করার জন্যে তার অনেক প্রশংসা করলো সোমবার ,
তারপর মঙ্গলবারের বাড়ির রাস্তা দেখিয়ে দিলো।
মঙ্গলবারের বাড়ি অবধি গেল ইয়ুসিকে। গেলো এমন সময় যখন কিনা সে একটা ঘর তুলতে যাচ্ছে।
-- আদাব , আদাব , পেন্নাম হই, মঙ্গল দাদা !
রোববারের কাছে যাবার রাস্তাটা দেখিয়ে দেবে ভাই ?
-- রোববারের বাড়ি পাঁচ দিনের পথ। রাস্তা দেখতে পারি বৈকি , তবে কিনা -- প্রথমে নতুন এই পাঠশালা তৈরি করতে হবে।
জলদি করে আমায় সাহায্য করো দেখি।
খাসা কাজ করলো তারা দুজনে , তৈরি হলো পাঠশালা।
মঙ্গলবার ইয়ুসিকে-কে বুধবারের কাছে যাবার রাস্তা দেখিয়ে দিলো।
- আদাব, আদাব, পেন্নাম গো , বুধী মাসী ! একটু বাপু দয়া করো না , দেখিয়ে দাও না রোববারের বাড়ি যাবার পথ!
বুধবারের কিন্তু ভীষণ জরুরী কাজ পড়ে ছিল: খোঁয়াড় থেকে পালিয়ে গেছে বাছুর ,
কোথায় যে ইচ্ছে মতো শয়তানি করে বেড়াচ্ছে কে জানে।
-- দুষ্টুটাকে ধরতে একটু সাহায্য করো না বাবা , উদ্বিগ্নভাবে অনুরোধ করে বুধবার।
-- আর তারপর ধীরেসুস্থে আলাপ করা যাবে , কেমন ?
দুজনে মাইল শিগগিরই পালিয়ে-যাওয়া বাছুরটা পাকড়াও করলো।
ইয়ুসিকের খুব প্রশংসা করলো বুধবার তার চটপট কাজের জন্য , তারপর বললো :
-- রোববারের কাছে যেতে লাগবে আরো চার দিন। তুমি বিষ্যুদের যাও দেখি। সে খুব ভালো রাস্তা চেনে।
বৃহস্পতিবার থাকতো অনতিদূরেই। দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ছিল সে , যেন ইয়ুসিকের জন্যে অপেক্ষা করছিলো।
-- আরে এসো , এসো ইয়ুসিকে ! অভ্যর্থনা জানায় বৃহস্পতিবার।
--- আমি শুনেছি , তুমি তো বেশ সাহসী ছেলে হে , সক্কলকে খুব সাহায্য করে বেড়াও।আমাকেও একটু সাহায্য করো না।
বাগানটায় আগাছা বাছতে হবে আর ফুলগাছগুলোয় জল দিতে হবে।
কাজের ধরণটা প্রথমে বড় একটা ভালো লাগলো না ইয়ুসিকের।
কিন্তু ফুল গুলো যখন মাথা দোলাতে শুরু করলো , মনে হলো মাথা নুইয়ে নুইয়ে ধন্যবাদ জানাচ্ছে ,
তখন ভাবলো ইয়ুসিকে -- বাগানের কাজটা তাহলে মন্দ তো নয়।
এতো ভালো যে সাহায্য করলো তার ওপর খুশি না হয়ে উপায় কী বিষ্যুদবারের !
সে ইয়ুসিকে-কে বলে দ্যায় -
রোববারের ওখানে যেতে মোটে তিন দিনের পথ বাকি , তারপর রাস্তা দেখিয়ে দ্যায় যাবার।
শুক্রবারের কাছে তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেলো ইয়ুসিকে। ঠিক তখনি কাপড়চোপড় ধোওয়ার বিরাট আয়োজন চলছিল। কাপড় ধোওয়ার মেশিনের হাতল ঘোরানো সব সময়ই মনের মতো কাজ ছিল ইয়ুসিকের ;
তাই এখন -- ডাক শোনার অপেক্ষা না করেই সে কাজে লেগে গেল। শিগগিরই সে অবস্থাটা কব্জা করে আনলো।
শুক্রবার কাছ থেকেই সে জানতে পারলো , রোববারের নাগাল পেতে আর দুদিনের রাস্তা বাকী।
ইয়ুসিকে এবারে যায় শনিবারের কাছে। শনিবারেও ঝক্কি ভাবনার অনন্ত ছিল না।
-- আদাব , দিদি ; পেন্নাম হয় গো শনি দিদি।
রোববারের কাছে যাবার রাস্তাটা একবারটি দেখিয়ে দাও না !
-- রোববারের কাছে যাওয়া -- সে তো মোটে একদিনের পথ ! -- জবাব দ্যায় শনিবার।
-- তা , আমাকে একটু সাহায্য করোনা ভাই : ঘরগুলো পরিষ্কার করতে হবে ,
আর -- হ্যাঁ, গোসলখানায় জল গরমের জ্বালানি কাঠ গোছগাছ করে রাখতে হবে ;
এক্ষুনি তোকে রাস্তায় রওয়ানা করে দিচ্ছি --
এ আর এমনকি !
ইয়ুসিকে তো মহাফুর্তিতে কাজে লেগে গেল।
হেথা-হোথা , একবার-দুবার টুকটাক করে একটু ছোটাছুটি -- ব্যস, কাজ শেষ।
তারপরেতে ইয়ুসিকে নিজেই বাথরুমে গিয়ে গা-হাত-পা ধুলো।
হ্যাঁ , এইবারটি বেশ ফিটফাট হয়ে রোববারের অতিথি হওয়া যায়।
রোববারের দেশে সবকিছুই এত সুন্দর ! আর সবচেয়ে সুন্দর তো রোববার নিজে।
শিগগিরই অন্যান্য অতিথিরাও এসে গেল --
মানে, অন্যান্য সব দিনগুলো ;
ইয়ুসিকে তো আগে থেকেই চেনে তাদের। রোববার সক্কলেরই খুব প্রশংসা করে বলতে লাগলো যে , তার দেশে সে-ই হচ্ছে সবচেয়ে ভালো যে সারা সপ্তাহ ধরে চমৎকার কাজ করে গেছে। তখন সব ক'টা দিন মিলে একবাক্যে বলে উঠলো ,
-- ইয়ুসিকে যদি সাহায্য না করতো তাদের তাহলে ভাল লোক হওয়ার সুনাম কেউই পেত না।
কথাটা মনে ধরলো ইয়ুসিকের। এরপর সবাই মাইল নাচগান করলো ,
আর তাতেই তো শেষ পর্যন্ত সে রোববারকে রোজ যাবার কথা বলেই ভুলে গেলো।
অবশ্য তাতে কি ! এখন তো সব ক'টা দিনই তার বন্ধু হয়ে গেছে , তাই না ?
শেষ।
রুশ থেকে অনুবাদ : হায়াৎ মামুদ
লেখা এবং ছবি : সিলভি ভিয়ালাল
আমার কথা :
যখন পড়তে পারতাম না শুধু ছবি দেখলাম , সেই সময় থেকেই সোভিয়েত বই গুলো আমার সঙ্গী।
আব্বা বই গুলো কিনে আনতেন আর বোনেরা পরে শোনাতো। প্রগতি প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগে। এখন আর বই ছাপা হয়না। সময় পাল্টে যায়। পাল্টে যায় ছেলেবেলা।
ছোটবেলায় রাশিয়ান বই গুলো বানান করে পড়েছি। এখনো সেই স্মৃতি শুধু স্মৃতি মনে হয়না। হয়তো অন্য কিছু।
ছোটবেলায় যখন ছুটির জন্য অপেক্ষা করতাম , মানে আমার ছুটি না আব্বার ছুটি। আমি তো তখন স্কুলেই ভর্তি হয়নি।আব্বা সারাদিন বাড়িতে থাকবে সেই ছুটি। আমি সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করি। আর ইয়ুসিকে আর তার বন্ধুরা আমাকে সারা সপ্তাহের রসদ যোগায়।
সে-ই হচ্ছে সবচেয়ে ভালো যে সারা সপ্তাহ ধরে চমৎকার কাজ করে গেছে।
১। সাত বন্ধু ইয়ুসিকের - ( আমার সোভিয়েত শৈশব )
২।রূপের ডালি খেলা - (আমার সোভিয়েত শৈশব)
৩। জ্যান্ত টুপি (আমার সোভিয়েত শৈশব)
৪।সভ্য হওয়া - (আমার সোভিয়েত শৈশব)
৫। মালপত্র (আমার সোভিয়েত শৈশব)
৬।শেয়ালের চালাকি ১ (আমার সোভিয়েত শৈশব)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৩:১৯