এক
শিরোনাম দেখে যারা ভাবছেন আজ আমরা ষোড়শী কোন সুন্দরীর কাহিনী শুনব, তাদের শুরুতেই বলে দিলাম নিরাশ হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে! আরেহ, আপনাদের অনেকেই দেখি এটুকু শুনেই সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছেন! ঠিক আছে চলে যাবার আগে ষোড়শী টিনার ফোনালাপটুকু অন্তত শুনে যান .........
...... সিটিসেল কাস্টমার কেয়ারে আপনাকে স্বাগতম। বাংলায় শোনার জন্য ১ চাপুন, ইংরেজিতে শোনার জন্য ২ চাপুন ........................
আপনার নম্বরটি প্রিপেইড হলে ৫ চাপুন, পোস্টপেইড হলে ৬ চাপুন ..................... আমাদের কাস্টমার কেয়ার রিপ্রেজেন্টেটিভের সাথে কথা বলবার জন্য ০ চাপুন।
দুঃখিত আমাদের সবকটি লাইন এখন ব্যস্ত আছে। অনুগ্রহপূর্বক অপেক্ষা করুন। সিটিসেল কাস্টমার কেয়ারে কল করবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
- হ্যালো আসসালামু আলাইকুম, সিটিসেল কাস্টমার কেয়ার থেকে আমি সামিয়া বলছি। বলুন আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?
- হ্যালো আমি আপনাদের প্রিপেইড কার্ড রিচার্জ করতে পারছিনা।
- ম্যাম আপনি কি গোপন পিন নম্বরের সবগুলো ডিজিট সঠিকভাবে প্রেস করেছেন?
- জী করেছি, কিন্তু বলছে, This card is already used!
- ম্যাম, কত টাকার কার্ড ছিল?
- জী ২০ টাকার।
- ম্যাম, আরেকবার কষ্ট করে ট্রাই করে দেখবেন কি?
- জী আমি তিনবার সঠিক ডিজিট দিয়েছি কিন্তু তিনবারই ......
কথা শেষ হবার আগেই টিনার মোবাইলের ব্যালেন্স শেষ হয়ে যায়। ২০ টাকার কার্ড রিচার্জ করতে না পারার কমপ্লেইন করতে গিয়ে তার মোবাইলের আট টাকা ইতিমধ্যে শেষ! তাই টিনা আরেকবার ফোন করবার প্রয়োজন বোধ করল না। বান্ধবীর বাসা থেকে আসবার পথে অপরিচিত এক দোকান থেকে কার্ডটি কিনেছে বলে রিকশাভাড়া দিয়ে আবার সেই দোকানে গিয়ে দোকানদার মামার কাছ থেকে টাকা ফেরত চাওয়ারও কোন মানে হয় না।
সিটিসেল কাস্টমার কেয়ার রিপ্রেজেন্টেটিভ সামিয়াও সারাদিনে এত কলের মাঝে টিনার কলটির কথা বেমালুম ভুলে যায়!
দুই
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রান্তিক গেট।
ছাত্রলীগ নেতা লিমন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আনিসকে রীতিমত ধমকাচ্ছে, ‘এই হালা, দুই নম্বর কার্ড বেচস ক্যান! পুরা দোকান শুদ্ধ ভাইঙ্গা দিমু’
মোবাইল রিচার্জের দোকানদার আনিস বেচারা ভয় পেয়ে বলে, ‘ লিমন মামা ভুল হইয়া গ্যাছে, এক্ষুনি আপানার নম্বরে ৫০ টেকা ফ্লেক্সি কইরা দিতেছি’
আনিস ধরেই নিল যে লিমন বটতলায় প্রায় দুই মাস ধরে সিরাজের দোকানে বাকিতে ভাত খায়, সেই লিমন ইচ্ছে করেই রিচার্জ করবার পরেও বলছে রিচার্জ হয়নি। ঝামেলা এড়ানোর জন্য আনিস তাই ৫০ টাকা লস দিয়ে হলেও লিমনের নাম্বারে ফ্লেক্সি করে দেয় আর মনে মনে লিমনকে ‘ফকিন্নির পুত’ বলে গালি দিতে থাকে।
তিন
কুয়েটের একুশে হলের ৪০৮ নম্বর রুম।
বন্ধু রাশেদের মাধ্যমে আসাদ আর রুহির মোবাইল ফোনে পরিচয়। তারপর একদিন রাশেদ অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, সেদিনের সেই ফোনালাপের সুত্র ধরেই রুহি-আসাদ দুজনেই এখন দুজনের বেশ ভাল বন্ধু কিংবা বন্ধুর চেয়েও হয়তোবা বেশী কিছু! সেদিনও যথারীতি রাত ১২ টার পর রুহি-আসাদের ম্যারাথন ফোনালাপ শুরু হয়। রাত তিনটায় এসে দুইজনেরই মোবাইল ব্যালেন্স শেষ হয়ে যায়। মেজাজ খারাপের চোটে আসাদ ধাক্কা মেরে সিএসই পড়ুয়া রাশেদের কাঁচা ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়, ‘এই শালা তোর কাছে রবির কার্ড থাকলে দেত তাড়াতাড়ি’
আধো ঘুম চোখে রাশেদ নেই বলবার পরই আসাদ এক ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে আশেপাশের তিন চারটি রুমে গিয়ে সবার কাছে রবির কার্ড আছে কিনা জিজ্ঞেস করতে থাকে। রাত তিনটায় আসাদের এই পাগলামি দেখে দেশসেরা হ্যাকার হবার স্বপ্নে বিভোর রাশেদের মাথায় নতুন এক আইডিয়া আসে!
চার
অফিস যাবার পথে জিইসি মোড়ে রিকশা থেকে নেমেই শরীফের দিকে তাকিয়ে পরিচিত হাসি দেয় রবিন, ‘ কিরে শরীফ এয়ারটেলের দুইটা ৫০ টাকার কার্ড দেত’
-‘ রবিন ভাই রিচার্জ কইরা দেই? কার্ড বেচা বন্ধ কইরা দিসি’
-‘কিরে কেন? মানিব্যাগে মোবাইলের কার্ড থাকা মানে বিপদের বন্ধুকে সাথে নিয়ে ঘোরা’
-‘ কি করমু ভাই বলেন! সেদিন কার্ড বেইচা ১০০ টাকা লস দিসি। এক মামা আমার কাছ থেইকা কার্ড কিনা আমার সামনেই রিচার্জ কইরতে গিয়া দ্যাখে সেই কার্ড আগেই নাকি কোন ব্যাডা ব্যবহার কইরা ফেলছে! কাহিনী কি কিছুই বুঝি নাই- পুরা বেকুব হইয়া গেসিলাম। হেই থেইকা কার্ড বেচা বন্ধ কইরা দিসি’
সদ্যই জিপি ছেড়ে ইবিএল এ জয়েন করে ব্যাংকার বনে যাওয়া রবিনকে বিষয়টি কিঞ্চিত ভাবিয়ে তুলল। ব্যাংকার না হয়ে অনলাইন পত্রিকার সাংবাদিক হলে রবিন আজকেই হয়তোবা কাল্পনিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে ‘বাজার নকল মোবাইল কার্ডে সয়লাব’ কিংবা ‘নকল রিচার্জ কার্ড বানানোর গোপন আস্তানা থেকে শত শত নকল কার্ড উদ্ধার’ এই জাতীয় কোন ব্রেকিং নিউজ লিখে ফেলত!
পাঁচ
তাড়াহুড়ো করে টিউশনিতে যাবার আগ মুহূর্তে কি মনে করে ড্রয়ার থেকে এক লিটার আইসক্রিমের বক্সটি বের করে রোহানের রীতিমত পাছায় হাত ( মাথায় হাতের চেয়েও খারাপ অবস্থা আর কি!)
নাহ বক্সের ভেতর আইসক্রিম ছিল না অবশ্যই, আইসক্রিম থাকলে সেই বক্সটি নিশ্চয় ড্রয়ারে রাখা হত না। ব্যবহৃত আইসক্রিমের বক্সে ছিল বিভিন্ন অপারেটরের ও বিভিন্ন টকটাইমের প্রায় দুইশতাধিক ব্যবহৃত কার্ড। রোহানের বুঝতে অসুবিধা হল না এটি কার কাজ। চিৎকার দিয়ে মাকে ডাকল তাই, ‘ মাআআআআআ! আমার আইসক্রিমের বক্সটি খালি কেন?’
-‘ খালি কেন মানে? দুনিয়ার সব হাবিজাবি রুম আর ড্রয়ার ভর্তি করে রেখেছিস। নিজেও গুছাস না আমাকেও গুছাতে দেস না। এত্তগুলো ইউজড কার্ড দিয়ে তুই করবিটা কি? তাই ফেলে দিয়েছি’
-‘ এইটা তুমি কি করলা মা’- আহত সুরে আস্তে করে আর্তনাদ করে উঠে রোহান। সেই আর্তনাদ মায়ের কান পর্যন্ত পৌছাল না।
ছয়
ছাত্রী মীরাকে অংক করতে দিয়ে প্রথম আলো পড়তে থাকে রোহান। ম্যাথ অলিম্পিয়াড নিয়ে আজ চার পাতার বিশেষ সংখ্যা বের করেছে প্রথম আলো। রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে ফিজিক্সে অনার্স করা রোহান মুগ্ধ হয়ে দেশ সেরা ম্যাথ জিনিয়াসদের নিউজ পড়তে থাকে। ক্লাস ফাইভের স্কলারশিপে রংপুর জিলা স্কুল থেকে ১০০ তে ১০০ পাওয়া রোহান ম্যাথ অলিম্পিয়াডে দেশের সেরা হওয়া চিটাগাং কলেজের ছাত্র ধনঞ্জয়ের সাক্ষাৎকার খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তে থাকে।
মীরাকে আরো নতুন দুটো অংক করতে দিয়ে রোহান ম্যাথ অলিম্পিয়াডে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করা ঢাকায় থাকা বন্ধু জাবেদ সুলতান পিয়াসকে ফোন দেয়। তিন মিনিট কথা বলতে না বলতেই রোহান মোবাইল ব্যালেন্স শেষ হয়ে যাবার অ্যালারট শুনতে পায়। তাই সে পিয়াসকে লাইন কেটে গেলে সাথে সাথেই রিচার্জ করে সে আবার কলব্যাক করবে জানায়। লাইন কেটে যাবার পর রোহান তাই তাড়াহুড়ো করে রিচার্জ করেই আবার কলব্যাক করে পিয়াসকে।
অংক করতে করতেই মীরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, তার স্যার মানিব্যাগ থেকে কোন কার্ড বের না করেই দুমিনিটের জন্য চোখ বন্ধ করে, তারপর চোখ খুলেই নিউজপেপারের এক কোণায় ১৬টি ডিজিট লিখে ফেলে।এরপর সেই ডিজিটগুলো দেখে দেখে মোবাইল রিচার্জ করে ফেলে। পুরোটা সময় স্যার একবারের জন্যও মীরার দিকে তাকায়নি। বরং রোহানকে দেখে মনে হচ্ছিল তার সামনে একজন জলজ্যান্ত মানুষ বসে আছে সেটা সে বেমালুম ভুলে বসে আছে!
মীরা একবার ভাবল, স্যারকে জিজ্ঞেস করবে স্যারকি আসলেই বাসা থেকে ১৬ টি ডিজিটই মুখস্থ করে এসেছিলেন কিনা। কিন্তু মীরা তা করলো না। কারণ সদ্যই এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হওয়া মীরা বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারছে তার সামনে বসে থাকা এই মহান শিক্ষক দিন দিন তার সুন্দরী ছাত্রীর প্রতি দুর্বল হতে শুরু করেছে। তাই পুরো ব্যাপারটিকেই মীরা তাকে মুগ্ধ করবার কৌশল হিসেবে ধরে নিয়ে চুপচাপ আগের মত অংক করতে থাকল।
তবে আসল সত্যটি বললে আপনাদের মত মীরাও হয়তোবা কখনোই বিশ্বাস করত না, তার অতি প্রিয় রোহান স্যারকে আজকাল আর মোবাইলের কার্ড কিনে কিংবা দোকানে টাকা দিয়ে ফ্লেক্সি করে মোবাইল রিচার্জ করতে হয় না। প্রায় ছয় মাসের দীর্ঘ সাধনার পর রোহান এখন দুতিন মিনিট ধ্যানে বসলেই বেশীরভাগ ক্ষেত্রে প্রায় নির্ভুলভাবে রিচার্জ করে ফেলতে পারে এবং সেই নির্ভুল রিচার্জে সে ঠিক কত টাকার টকটাইম পাবে সেটা সে নিজেও জানে না!
- O -
[২০০৪ সালে চিটাগাং মুসলিম হাই স্কুলের সামনে এক দোকান থেকে জীবনের প্রথম সিম কেনবার সময় এক উত্তেজিত আঙ্কেল নেটওয়ার্কের ঝামেলায় ৩০০ টাকা রিচার্জ করতে না পেরে দোকানদারকে ফেরত দিয়ে দেয়। আমি পাশে দাড়িয়ে আড়চোখে তাকিয়ে ১৬ টি ডিজিটই মুখস্থ করে ফেলি। বাসায় এসে নতুন মোবাইলে নতুন সিম ঢুকিয়েই নিজের মুখস্থ বিদ্যার উপর ভরসা করে চরম উত্তেজনা নিয়ে সেই ১৬টি ডিজিট প্রেস করি এবং লাইফের প্রথম রিচার্জেই অবৈধভাবে ৩০০ টাকা পেয়ে যাই আজ এতদিন পর গল্পটি লেখার সময় সেই ঘটনাটির কথা মনে পড়ায় বেশ গিলটি ফিলিংস হচ্ছিল। আমার এই গল্পটি নাম না জানা সেই দোকানদার ভাইজানকে উৎসর্গ করা হল ]