'গার্ডিয়ান' শব্দটির সাথে কেমন যেন ভয় আর শ্রদ্ধা দুটোই জড়িয়ে আছে। তেমনি এক গার্ডিয়ানের দেখা পেলাম ২০১০ সালে। গল্পটি বলার আগে ব্যাকগ্রাউন্ডটা বলে নেই...সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাষনামলের রেশ তখনো কাটেনি। সাংবাদিকতা আর রাজনীতিতে বারবার ঘুরে ফিরে আসছে সেসব গল্প। গ্রামীন ব্যাংকের ঋণ তত্ত্ব দেয়া আমাদের ড: মোহাম্মদ ইউনুস ততদিনে নোবেল প্রাইজও পেয়ে গেছেন। হাতে খড়ির আগে রাজনীতির পাঠও চুকে গেছে তাঁর। হঠাৎ করে বিশাল বোম ফোটালেন নরওয়েজিয়ান এক ডকুমেন্টারি মেকার টম হেইনম্যান। বানালেন "মাইক্রো ক্রেডিট ডেবট" একদলা কাদা মেখে দিলেন ড: ইউনুসের মুখে। কে এই 'টম হেইনম্যান'?
উত্তর খুঁজতে গিয়ে শ্রীলংকা গার্ডিয়ান নামের একটি ওয়েব সাইট পেলাম। সেখানে তার একটি সাক্ষাতকার ছাপা হয়েছিল এবং সাক্ষাতকারটি নিয়েছিলেন বাংলাদেশী এক সাংবাদিক। কে এই বাংলাদেশী সাংবাদিক? ৮/ ৯ বছরের পেশাগত জীবনে ওই নামের কোন সাংবাদিক আমি জানিনা। টম হেইনম্যানের মতো মারকুটে পরিচালকের সময়োপযোগী সাক্ষাতকার নিতে পারেন এমন বাংলাদেশী সাংবাদিককে আমার চেনার কথা। আমি খুঁজতে লাগলাম। দু' বছর পর তাকে আমি আবিষ্কার করলাম। নিরবে। একেবারে নিজের চেষ্টায়। সারারাত অন লাইনে তাঁর সাথে আমার কথা হোল। তিনি আমাকে সময় দিলেন। রাজমনি সিনেমা হলের সামনে একটি বিল্ডিংয়ের নির্দিষ্ট এক কক্ষে।
কলাপসিবল গেটের ভেতরের আধো অন্ধকারের একটি দরজা দেখতে পেলাম। ভেতর থেকে বন্ধ। আমি পুনরায় তাকে কল দিলাম। একটি লোক দরজা খুলে দিলেন। কক্ষটিতে ১৪/ ১৫ জন লোক বসে আছে। এককোনে একজন লোক বসে আছে। হাতে গিটার সামনের টেবিলে হইস্কির গ্লাস। আমাকে কাছে ডাকলেন। আমি বুঝতে পারলাম। তিনিই সেই লোক যাকে আমি আবিষ্কার করেছি। অন্য সবার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন...বললেন, "আমার মতো ডাকসাইটে একজন মানুষকে এই ছেলে খুজেঁ বের করতে পেরেছে।" আমি দেখলাম, তার পায়ের কাছে একটি লোক বসে বসে তার হাত পা টিপছে। তিনি বলছেন আর বাকিরা শুধুই শুনছেন। যুক্তিতে তাকে হারানোর মতো কেউ সেখানে নেই কিংবা সত্যিই যুক্তিতে তাকে হারানো যাবেনা। তিনি দর্শনের কথা বলছেন, গণিতের কথা বলছেন, সঙ্গীতের কথা বলছেন এমনকি বাংলা সিনেমার নায়িকাদের কথাও বাদ যাচ্ছেনা। তিনি বলছেন, "আমাদের সবার ভেতরেই কেউ একজন আছেন এবং তিনি একক। যেমন ধর্মে বলা হয়েছে আল্লাহ এক, তার আকার নেই, দেখা যায়না। আমাদের ভেতরেও যিনি আছেন তিনিও তেমনি। আমাদের বাইরের দেহটা খোলশ মাত্র, অকেজো হয়ে যাবে, ঝরে যাবে একদিন কিন্তু ভেতরের জনের মৃত্যু নেই। অন্যকোন খোলশে আবার স্থান করে নিবে আমাদের আমি।"
একে একে যারাই এই কক্ষে প্রবেশ করছে তারা আর বের হবার অনুমতি পাচ্ছেনা। কক্ষটিতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক রয়েছেন বলেও পরিচয় করিয়ে দেয়া হোল আমার সাথে কিন্তু তাদের আমি কোনদিন কোথাও দেখিনি। কক্ষে আছেন হাল আমলের বাংলা সিনেমার একজন নায়কও। এছাড়া প্রবীণ অভিনেতা প্রবীর মিত্রও চুপ করে অনেকটা মাথা নীচু করে বসে আছেন। বারবার তিনি বয়সের দোহায় দিচ্ছেন তারপরও বাধ্য করা হচ্ছে মিষ্টি, পরোটা আর গ্রীল খেতে। হইস্কির বোতল বের হোল। সবাইকে গ্লাস ভর্তি করে দেয়া হোল। এবার নাকি এক চুমুকে খেতে হবে। যা কিছু ঘটছে তা যেন তিনিই ঘটাচ্ছেন কিংবা অন্যরা এতটাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আছে যেকারনে তিনি যা বলছেন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলছে। জানলাম তিনি বাংলাদেশের প্রথম ব্যাচের ইংলিশ মিডিয়ামের মেধাবী ছাত্র। তিনি গান লিখেন, সিনেমা বানান, তিনি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া সাংবাদিক, তিনি গড ফাদার। সেদিন রাত বারোটার পর আমি ছাড়া পেয়েছিলাম। তারপর ধীরে ধীরে জেনেছি তার অতীতের নানা চমকপ্রদ ঘটনা।
এরপর ২০১১ সালের আগষ্ট মাস। উইকিলিকসের ফাঁস করা তারবার্তায় বলা হোল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ারস গীতা পাসি এক বার্তায় বাংলাদেশের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফজ্জামান বাবরকে অনুরোধ করেছিলেন যেন ওই সাংবাদিক জেলে থাকাকালিন তার পরিবারের দেখভালের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। সে অনুযায়ী লুৎফজ্জামান বাবর প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক পৌছে দিতেন তার পরিবারকে।
ওই সাংবাদিক আমাকে ফোন করে সেদিন দেখা করতে বললেন। আমি গেলাম। দ্বিতীয় বার তার সাথে আমার দেখা হোল। এবার বেশভুষা আগের মতো নেই। লম্বা লম্বা গোঁফ। বলে রাখা ভালো যতবারই তাঁর সাথে আমার দেখা হয়েছে কোনবারই তাকে আমি এক দেখায় চিনতে পারিনি। তিনি রেগে আছেন। বিএনপির এক বড় নেতাকে ফোন দিলেন। বললেন যেখানেই থাকেন ১০ মিনিটের মধ্যে দেখা করতে হবে। ওই নেতা ১০ মিনিটের মধ্যেই এলেন। তিনি ওই নেতাকে গালি গালাজ করলেন, বাবরকেও গালি গালাজ করলেন। ছাড়লেননা বিএনপির চেয়ারপারসনকেও।
সর্বশেষ সাংবাদিক দম্পতি সাগর রুনির মৃত্যু নিয়ে তার সাথে আমার বিস্তারিত কথা হয়েছিল।
দেশে এমন অনেক সাংবাদিক আছেন যারা ফোন দিলে দেশের উচ্চ পর্যায়ের নীতি নির্ধারকরা ফোন ধরে আর যদি না পারে তবে পরে ব্যাক করে। যাদের কথায় কোন কোন দেশের ভিসা অনুসন্ধান ছাড়াই যে কাউকে দিয়ে দেয়া হয়। শুনেছি অনেকে বড় নেতাদের বক্তৃতা লিখেও দেন অনেক প্রভাবশালী সাংবাদিক। দেশে সুনাম কুড়ানো অনেক অনুসন্ধানী সাংবাদিকও আছেন। অনেকে সাংবাদিকতা করতে করতে অনেক বড় হয়ে গেছেন তারা এখন শুধুই কলাম লিখেন। প্রতিবেদন করেননা। সাগর রুনির মৃত্যু নিয়ে কোথাও তাদের কোন মর্মস্পর্শী কলাম বা প্রতিবেদন আমার চোখে পড়েনি। অথচ এদেশে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার এবং দেশটির ক্ষমতাসীন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান বেনজির ভুট্টোর ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টোর প্রেমের গল্প ব্রেক করার মতো সাংবাদিক রয়েছেন। আর দেশে এত এত ঘটনা ঘটে সেসব সাংবাদিকরা একদম চুপ করে থাকেন...হয়তো কৌশলগত কারনেই। তথ্য থাকার পরও কোন তথ্য প্রকাশ করা হবে আর কোনটা হবেনা সেটি নির্ধারিত হয় ওই গণমাধ্যমের নিজস্ব রাজনৈতিক ও আদর্শিক অবস্থান অনুযায়ী। এই অবস্থানটা অবশ্য ঠিক করেন মালিকরে নিয়োগ দেয়া একজন সাংবাদিকই। যিনি ম্যানেজমেন্টের অংশ হয়ে ওই দায়িত্বটা পালন করেন। প্রতিবেদকদের নির্দেশনা দেন কোন এঙ্গেলে কি প্রতিবেদন করতে হবে।
শুধু প্রতিবার আমার পাড়ার সিগারেটের দোকানদার আমাকে দেখলেই জিঙ্গেস করে, "ভাই, আপনাদের ওই যে সাংবাদিক জামাই -বউ মাইর্যা হালাইলো.... ওইডার কিছু অইলো?" আমার কোথায় যেন কেমন এক আঘাত লাগে। আমি কথা ঘুরাইতে বলি ভাই, নতুন অনেক চ্যানেল হইছে জানেন? আমি চিন্তা করে পাইনা কি করে একটি চ্যানেল তার প্রথম দিনের নিউজেই 'নিজের যাত্রা শুরু' দিয়ে লিড নিউজ করেন। আমার অধ:পতন অধ:পতন লাগে।
মনে হয় সেই শ্রীলংকা গার্ডিয়ানের কথা... যেখানে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর গুম হবার পর..বাংলাদেশে গুম হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে “ The Bengal Tigers in the R&AW cage ” শিরোনামের একটি প্রতিবেদন বের হয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে বিরোধী দলের ৮৭ জন নেতার নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছিল তাদের হত্যার জন্য খুনি আনা হয়েছে। ওইসব খুনি কারা, কোথায় ট্রেনিং করেছিল তাও বলা হয়েছিল। পরে ওই প্রতিবেদনের সুত্র ধরে সরকারের তরফ থেকে বলা হোল শ্রীলংকা গার্ডিয়ান নামে শ্রীলংকায় কোন পত্রিকা বা অন লাইন নিউজের অনুমোদিত ওয়েব সাইট নেই। এবার এই প্রতিবেদনটির প্রতিবেদকের নাম জেসিকা ফক্স।
আমি গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন খুঁজি। গার্ডিয়ান খুজিঁনা।
(দয়াকরে এ লেখাটির বানান ঠিক করে নিন)