কমলাপুর স্টেশনে নেমেই মেজাজটা তাঁতিয়ে উঠল আমার । চৈত্রের সূর্যটা যেন ইচ্ছা করে আমার সাথে শত্রুতা করছে । মনে হচ্ছে কামারের হাঁপর দিয়ে অনবরত কেউ বাতাস দিচ্ছে গায়ে।
শিখা এক্সপ্রেস এর তাপানুকুল লেখা বগি থেকে বের হয়ে এসে গরমের হল্কার ফলাগুলো যেন বেশীই বিঁধছে গায়ে । সঙ্গে থাকা ভারী লাগেজটাকে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে গলার কাটা । দাত কিড়মিড় রাগ নিয়ে সেটাকে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে হাটতে শুরু করলাম ।
আজ আবার হরতাল। গত কয়েকদিন যাবত হরতালে যে পরিমাণ গাড়ি পোরানো হয়েছে তাতে আমার সাধের কোটি টাকার লেক্সাস গাড়িটি বের করার দুঃসাহস একদম করি নি।
রিকশায় ই যেতে হবে । হাটতে হাটতে সূর্য , রাজনীতি ঢাকার গাঘেঁষা দালান সবগুলোকে শাপ শাপান্ত করছিলাম মনে মনে। কিছুদুর হাটার পর ই একটা রিকশা পেলাম , “ এই খালি... হাক ছাড়লাম , কিন্তু রিকশাওয়ালা আমার দিকে একবার তাকিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
...... মনে মনে একটা বাজে গালি দিলাম ।
আর কিছুদুর হাটতেই গাছের নিচে ছায়ায় দারানো কয়েকটা রিকশা দেখলাম । একটা ছোট ঠেলাওয়ালার থেকে তরমুজ কিনে খাচ্ছিল কয়েকজন রিকশাওয়ালা । তরমুজ ফালির প্রত্যেকটিতেই তার বীচির দ্বিগুণসংখক মাছি তাদের ন্যায্য হিস্যা আদায়ে বেস্ত ।
এই , গুলশান গোল্ডেন টাওয়ার , হাত দিয়ে ইশারা করলাম ।
না ভাই, ওইদিকে যামু না ।
গরমে কিম্বা অপমানে জানি না রাগে আমার পিত্তি জ্বলে উঠল । অফিসের বড়কর্তা আমি । সবাই আমার কথায় উঠে বসে । না শোনার অভ্যাস বহুদিন যাবতই আমার নেই ।
হন হন করে হাটা শুরু করলাম আমি । হাটতে হাটতে বড় রাস্তার কাছা কাছি এমন সময় কই যাইবেন ? শুনে পাশে তাকালাম । পানের দোকানের সামনে দাড়িয়ে টাকপরা তেল চিটচিটে , কাল বেটে এক রিকশাওয়ালা। হাতে এক খিলি পান ।
- গোল্ডেন টাওয়ার , ভাড়া কত নিবা ?
- সত্তুর টাকা ।
- এই খানে দারালে গোল্ডেন টাওয়ার দেখা যায় , আর তুমি মিয়া ভাড়া চাও সত্তুর টাকা ! পঞ্চাশ দিব ।
দরাদরি করতে লাগলাম । আমি সবজায়গায় জিততে পছন্দ করি । আফসার চৌধুরীকে কেউ ঠকিয়ে গেছে এমন নজির নেই ।লোকটা পান মুখে দিল, কিছু একটা চিন্তা করল তারপর বলল
-আচ্ছা উডেন ।
আমি উঠে বসলাম । আর যাত্রী টানার সাথে ব্যাগ টানা ফ্রি এমন তত্ত্ব থেকে হোক বা দায়িত্ব থেকে হোক যত্নসহকারে রিকশাওয়ালা ব্যাগটা তুলে দিল ।
- হুডটা তুলে দিও তো ।
রিকশা চলতে শুরু করল । মাথার উপরে হুড তোলা থাকলেও সূর্য যেন আমার স্যান্ডেলের ফাক ফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসা চামড়ায় গরম খুন্তির ছ্যাকা দিচ্ছিল । আমি তুলনামূলক কম ভাড়াতেই পেয়েছি বলে মনে মনে তৃপ্তি অনুভব করলাম। গোল্ডেন টাওয়ারের দূরত্ব একদম কম না । তার উপরে সিটি কর্পোরেশনের রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও খানাখন্দের আশীর্বাদ তো আছেই ।
রিকশাওয়ালা পা টেনে টেনে প্যাডেল চালাচ্ছিল । উচ্চতা একটু কম বলেই হয়ত । আমি তার তেল চিট চিটে পায়ের দিকে তাকালাম । স্যান্ডেলহীন পা আর তাতে অসংখ্য ফাটল । শার্টটার রং এতটাই চটে গেছে এককালে কি রং ছিল বোঝা কঠিন। সারা গায়ে ঘাম ঝরছে , শার্টটা ভিজে জবজবে । মুখের চামড়ায় অনেক ভাজ । কপালের দুপাশটা চাপা আর শিরশিরে আঙ্গুল । আমি দেখেছি, সব গরিব ই একই রকম । তাদের চেহারাও কেমন যেন এক ।
পিচিক করে রাস্তায় সে পানের পিক ফেলল । কিছুখন পর পর শার্টের হাতায় ঘাম মুছছে সে। পরিবেশ বিষয়ক দু’একটা উপদেশ দিতে গিয়েও চুপ রইলাম । এই শ্রেণীর মানুষ কথা বাড়ালেই সাহায্য চাবে ।
- স্যার , এইবার ঢাকায় গরম বেশি পড়ছে ।
- হুম।
- আপনাগো ঢাকায় তো গাছপালা বেশি নাই হেইজন্য গরম আরও বেশী ।
- হুম।
- স্যার তিনমাসের লইগা ঢাকায় আইছি , এই তিনমাস খেতের কাম নাই, গাড়ি চালামু কিছু টাহা কামামু হেইর পর আবার বাড়ি যামু ।
- বাড়ি কে কে থাকেন ?
- আমার বুড়া মায় , বউ আর তিনডা ছাওয়াল । ছোড ছাওয়ালডা দুধের বাচ্চা , মধ্যেরডা ইস্কুলে যায় । মায়রে ভাইরা দাহে না কিন্তু আমি মায়রে হালামু না ।
- হুম ভাল ।
- স্যার , দুঃখ বড় পোলাডারে লইয়া । হ্যাঁর মায় মারছে দেইখা রাগ কইরা দেশান্তরী হইছে । চাইর বছরে একফির ও বাড়ি আয় নাই ।
চৌরাস্তার মোড়ে আসতেই আমার রিকশার সাথে আরেকটা রিকশার ঠোকাঠুকি হল । ওই শালা ...হারামির পুত ...চউখে দেখিস না , ইত্যাদি নন সেন্সর গালির বৃষ্টি হল ।
বাকিটা পথ আর কোন কথা হল না । আমার বাসার সামনে গিয়ে যখন পৌঁছলাম তখন তিনটা বেজে গেছে । ভাড়া টাকা দিতে গিয়ে দেখলাম সব বড় নোট । ভাংতি আছে জিগ্যেস করতেই পান খাওয়া দাঁতে একটা হাসি দিল সে । ঘামে মুখ জবজবে ।
- মাত্র নামছি স্যার । বিসমিল্লাই হয় নাই এহনও ।
দারওয়ান দুটোর একতাকেও দেখতে পেলাম না । অগত্যা কি আর করা বললাম ,
- ভাই তুমি একটু দাড়াও , বাসা থেকে নিয়ে আসছি ।
লিফটে উঠে গেলাম । গোল্ডেন টাওয়ারের সবচেয়ে বড় ফ্ল্যাটের একটিতে থাকি আমি । ১০ বছর আগে পঞ্চাস লাখে কেনা ফ্ল্যাটটির এখন মূল্য তিন কোটিরও বেশি ।
দরজা খুলতেই আমার বাচ্চা তানিসা দৌরে এল । আমার দ্বিতীয়বার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী বেলাও আমায় ঠাণ্ডা জুস খাওয়ানোতে বাতিবেস্ত হয়ে পড়ল । আমি দুপুরে খেলাম, সাওয়ার নিলাম এসি ছেড়ে ঘুমিয়ে গেলাম । ভ্রমনক্লান্তির কারণে বোধ হয় একটা ভাল ঘুম হোল । মাগরিবের আযানের সময় যখন আমার ঘুম ভাঙ্গল তখন ই আমার রিকশা ভাড়ার কথা মনে এল ।
ঘোরের বসেই আমি দৌড়ে নিচে নামলাম। গার্ডরা বলল যে এক কাল ছোট খাট রিকশাওয়ালা ঘণ্টাখানেক দাড়িয়ে ছিল। একজন সাফারি পড়া ফর্সা , লম্বা লোককে খুঁজছিল যাকে সে মধ্য- দুপুরে কমলাপুর থেকে নিয়ে এসেছিল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আস্তে আস্তে রিকশা চালিয়ে চলে গেছে । আমি পঞ্চাশটি টাকা নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম । আমার হাতটি খুব ভারি লাগছিল ।
বিশ্বাস করুন, আজও পঞ্চাশ টাকার নোট খুললেই আমি ছোট খাট টেকো কাল এক রিকশাওয়ালা কে দেখি ঘামে জবজবে শরীর , মন খারাপ করা পান খাওয়া মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে আমার বাসার সামনে থেকে প্যাডেল চালিয়ে চলে যাচ্ছে ।