আমার অদ্ভুত এক অসুখ আছে। আমি প্রায়শই ঘোর লাগালো কিছু গন্ধ পাই। যে গন্ধ আমাকে এক ঝটকায় বহুবছর আগে ফেলে আসা বিভিন্ন স্মৃতি বিজড়িত স্থানে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমি সেইসব জায়গায় চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে সরু একটা টানেলের ভিতর দিয়ে গভীর থেকে গভীরে তলিয়ে যেতে থাকি। তলিয়ে যেতে যেতে মস্তিষ্কে এলোমেলো ভাবে ঘুরতে থাকে সেই সময়ের সুন্দর-অসুন্দর স্মৃতিরা যা আমি বহুকাল ধরে পুষে রেখেছি। আমি ভীষণ স্মৃতিকাতুর মানুষ। স্মৃতি জমিয়ে রাখার জন্য আমার হরেক রকমের বয়াম আছে। সেখানে আমি আমার স্মৃতি গুলোকে খুব যত্নে পুষে রাখি।
তো যা বলছিলাম, আমার অদ্ভুত এক গন্ধের অসুখ আছে। যে গন্ধ আমাকে বর্তমান থেকে অতীতে নিয়ে বিচরণ করায়। একদিন মাগরীবের নামায আদায় করে রুমে বসে চা খাচ্ছিলাম হঠাৎ নাকে অদ্ভুত রকমের মায়া জড়ানো একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিলো গন্ধ টা আমার খুব কাছের, খুব আদুরে আর পরিচিত। আমি চোখ বন্ধ করে, বারবার নাক টেনে, গন্ধ শুকতে শুকতে চলে গেলাম আমার শৈশবে, আমার নানা বাড়িতে। যে বাড়িটার প্রত্যেকটা জায়গায় আমার স্মৃতির আনাগোনা। আমরা যখন নানা বাড়ি যেতাম তখন আমাদের নানী নিজ হাতে আমাদের রান্না করে খাওয়াতেন। নিজ হাতে কথাটি এই কারণে বললাম কারণ তার তখন যথেষ্ট বয়স হয়ে গিয়েছিলো। রান্না করার মতো অবস্থা তার ছিলো না। তাই আমার মামীরা তাকে রান্নার দায়িত্ব থেকে অবসর দিয়েছিলেন।
কিন্তু আমরা যখন বছরের নির্দিষ্ট একটা সময়ে নানাবাড়ি যেতাম তখন আমার নানীর কষ্ট হলেও আমাদের জন্য রান্না ঘরে ঢুকে যেতেন। নানীরা এমনই হয় আসলে, নাতীনাতকুরদের জন্য কলিজা খুলে দিয়ে দেন।আমার নানীও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। নানী রান্নাঘরে ঢুকে এটা-সেটা হাতড়ে, নিজ হাতে পাটায় মশলা পিষে তারপর রান্না করতেন। নানী যখন মশলা পিষতেন তখন আমি নানীর পাশে বসে মশলা পিষা দেখতাম। খুব সুন্দর একটা গন্ধ আসতো সেই পেষা মশলা থেকে। সন্ধ্যাবেলায় রুমে বসে চা খেতে খেতে এই গন্ধটাই আমি পাচ্ছিলাম।
এইতো সেদিন রাতে অফিস থেকে বের হয়ে বাস-স্টপের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ একটা গন্ধ পেয়ে থমকে গেলাম। এটা সেই গন্ধ, যে গন্ধটা কৈশরে আমি আমার পছন্দের মানুষের গা থেকে পেতাম। এতো গুলো বছর পর ভালোবাসাহীন ইট-কাঠের শহরে এই গন্ধ কিভাবে এলো! ভাবতে ভাবতে বাসে উঠে বসলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে।
মাঝেমধ্যেই আমার কর্পূর আর আগরবাতির গন্ধে ঘুম ভেঙ্গে যায়।মনে পড়ে যায় সেই শৈশবের কথা। যখন আমি লাশের ভয়ে লাশ দেখতে যেতাম না। আশেপাশে কেউ মারা গেলে কর্পূর আর আগরবাতির গন্ধে সারারাত জেগে পাড় করে দিতাম।
গন্ধ পাওয়ার এমন আরও অনেক ঘটনা আছে আমার। আমি আলু পোড়া আর কাপড় পোড়ানোর গন্ধ পাই, ধূপ জ্বালানোর গন্ধ পাই, মা-বাবার কাপড়ের গন্ধ পাই, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ফুলের গন্ধ পাই। এসব গন্ধ পেতে পেতে আমি নিজেই মনে হয় একটা গন্ধ হয়ে গেছি। কিছুদিন আগে আমাদের অফিসের একটা মিটিং এ বস হুট করে বলে বসলেন, শাওন ভাইয়ের শরীর থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ আসে। যা খুব কাছে গেলে অনুভব করা যায়। এটা শুনে আমার কলিগরা আমার দিকে ঢ্যাপঢ্যাপ করে তাকাচ্ছিলো। লজ্জায় মনে হচ্ছিলো আমি চেয়ারের নিচে ঢুকে যাই।
জানিনা এমন গন্ধ পাওয়ার বৈজ্ঞানিক কোনো ব্যাখ্যা আছে কিনা তবে হুটহাট এমন গন্ধ পেতে আমার ভালোই লাগে। এই গন্ধ গুলো আমাকে আমার অতীতে ভ্রমণ করায় সেই সাথে আমার স্মৃতি গুলোকেও জীবন্ত করে তুলে।
ছবিঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ দুপুর ২:৫১