পৌরাণিক মতে, বৈদিক দেবতা সূর্যমূর্তির পদযুগলে ব্যবহৃত পাদুকা স্বর্গলোক থেকে এসেছে। সুপ্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষে যে, পাদুকার ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল তার প্রমাণ প্রাচীন সূর্য দেবতার মূর্তি কিংবা কার্তিকের মূর্তির পায়ে পাদুকা পরিধান রীতি। 'তৈত্তিরীয় সংহিতা'য় 'কাঞ্চী উপানহা উপমুঞ্চতি'তে জুতা সম্পৃক্ত সর্বপ্রাচীন তথ্য পাওয়া যায়। পৌরাণিক নানা গ্রন্থ রয়েছে জুতা প্রসঙ্গে। মহাভারতের অনুশাসন পূর্বে জুতা নিয়ে রয়েছে এক চমকপ্রদ কাহিনী। তা হলো_ এক রৌদ্রময় দুপুরে জমদগি্ন ওপর দিকে তীর নিক্ষেপ করছিলেন আর তার স্ত্রী রেনুকা তা মাটিতে পড়ার পরে তা নিয়ে আসছিলেন। কিন্তু প্রখর রৌদ্রের কারণে মাটি প্রচণ্ড গরম থাকায় খালি পায়ে রেনুকার পক্ষে পতিদেবের নিক্ষেপিত তীর নিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছিল না। অর্ধাঙ্গিনীর এ দুরবস্থা দেখে জমদগি্ন ক্ষোভে অগি্নমূর্তি হয়ে সূর্যকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ধনুকে তীর সংযোগ করতে উদ্যত হন। নিশ্চিত বিপদে আতঙ্কিত হয়ে সূর্যদেবতা জমদগি্নর শরণাগত হয়ে তাপ নিবারণের জন্য ছাতা ও জুতা প্রদান করেন।
প্রাচীনকালে রচিত গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায়, সেকালে 'গুরুপাদুকা' এবং 'পাদুকা প্রতিমা' নামের দুই ধরনের জুতা ছিল। 'গুরুপাদুকা'র তৈরির উপকরণ দেখে সহজেই অনুমান করা যায় এটি ছিল অভিজাত উচ্চশ্রেণীর জন্য। কারণ এগুলো তৈরি হতো মূল্যবান চন্দন কিংবা দেবদারু কাঠ দিয়ে এবং তাতে থাকত মণি, রত্ন, রুপার ধাতব পাত। 'পাদুকা প্রতিমা' ছিল চটি জুতা ও খড়মের মতো।
কিছু কিছু শাস্ত্রীয় গ্রন্থে একালের বুট জুতার মতো দেখতে হাঁটু পর্যন্ত বিস্তৃত 'আজুনুপত্রচরণ' নামে আরেক শ্রেণীর জুতার উল্লেখ রয়েছে। এর উপকরণ ছিল 'চামড়া' ও 'মুঞ্জ' নামক একরকম তৃণ (কেউ কেউ অনুমান করেন, 'মুঞ্জ' থেকে 'মোজা' শব্দটি এসেছে)। আধুনিক পণ্ডিতদের মতে, 'মুঞ্জ' মোটেও মোজা নয়, এটিও এক ধরনের জুতাই ছিল।
সেকালের এক সময় নারকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি পাদুকার প্রচলন শুরু হয়। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক কিংবা খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের সর্বাধিক খ্যাতিসম্পন্ন সংস্কৃত কবি ও নাট্যকার কালিদাসের 'কাদম্বরী'র বর্ণনা মতে, সন্ন্যাসীদের বিশেষ প্রিয় ছিল নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে তৈরি পাদুকা।
প্রাচীন ধ্রুপদী সাহিত্যের ভাষ্য মতে, দেবতারা নয় মানুষই জুতা উদ্ভাবন করে ব্যবহার শুরু করে। 'গোভিল গৃহ্যসূত্র' (৩য় প্রপাঠক)-এ এমন উল্লেখ রয়েছে যে, খালি পায়ে চলাফেরায় বিভিন্ন রকমের সমস্যা সমাধানের জন্য জুতা বা পাদুকার উদ্ভব হলেও তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু কিছু বাধ্যবাধকতা ছিল। কোনো পণ্ডিতের ধারণা, পাদুকা বা জুতার ব্যবহার এ অঞ্চলে শুরু হয় গ্রিক দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডারের মাধ্যমে। গ্রিকদের আগমনের আগে এ অঞ্চলের অধিবাসীরা বুট জুতার মতো আঁটসাঁট জুতা ব্যবহার তো দূরের কথা, এমনকি দেখেওনি। গ্রিকদের দেখে এ অঞ্চলের অধিবাসীরা বুট জুতো অনুকরণ করে তা ব্যবহার শুরু করে। যার প্রভাবে খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতক থেকে সূর্য এবং কার্তিকের মূর্তির পদযুগলে দেখা যেতে থাকে বুট জুতা। এই ধারণার বিপক্ষে যে যুক্তি রয়েছে তা হলো_ সূর্যদেবতার মূর্তি কিংবা কার্তিকের মূর্তির পদযুগলে বুট জুতা পরিধান রীতি সুপ্রাচীন। তা কালে-কালে এই ভারতীয় উপমহাদেশে যে পাদুকা ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল তারই একটি নমুনা। যা গ্রিক কিংবা অন্য কোনো সভ্যতা থেকে ধার করা নয়। এ বিষয়ে পর্যটক এরিয়ান-এর ভ্রমণ কাহিনীতে চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন_ 'যুদ্ধ শেষে গ্রিক সৈন্যরাই ভারতবর্ষের জুতার নমুনা সংগ্রহ করে নিজ দেশে নিয়ে গিয়েছিলেন।'
এসব বিতর্ক কিংবা রহস্যময়তার জন্যই বোধহয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'জুতা আবিষ্কার' নামক কবিতায় লিখে ফেলেন। যেখানে রাজা হবুচন্দ্রের কৌতুকময় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেবতা নয়, ভিন্ন কোনো সভ্যতা থেকে ধার করে নয় জুতা আবিষ্কার করে সাধারণ এক প্রজা।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১১ সকাল ৯:১৬