চার
২.৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ !
এলিসে'র কথা যদি সত্য হয় তা হলে মাত্র কয়েক দিনে মধ্যে এতোটা পথ কি করে অতিক্রম করে এলাম ? মানুষের পক্ষে আদোও কি সেটা সম্ভব ? এতোটা গতি কি মানুষ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে । কই তেমন তো কিছু শুনিনি বা পড়িনি । তাহলে ? অ্যাড্রোমিডার দূরত্ব তো আর পৃথিবী থেকে চাঁদ কিংবা মঙ্গলের মতো নয় যে, চাইলেই হপ্তা খানেকের মধ্যে ঘুরে এলাম ।
২.৫ মিলিয়ন লাইট ইয়ার । চাট্টিখানি কথা নয়। আলোর গতি'তে চলেও আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কি ওয়ে থেকে বের হতে কয়েক শো বছর লেগে যাবার কথা । অ্যাড্রোমিডার পর্যন্ত আসতেই আমাদের মরে ভুত হয়ে যাবার কথা ছিলো । অথচ মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে অ্যাড্রোমিডার এতো কাছাকাছি পৌঁছে গেছি । দিনক্ষণ অনুমান করতে না পারলেও আমাকে ধরে নিয়ে আনা হয়েছে সপ্তা খানিকের বেশি হবে বলে মনে হয় না । এরই মধ্যে এতোটা পথ অতিক্রম করে কিভাবে এলাম?
যতোই ভাবছি ভাবনাগুলো সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে । তাজ্জব না হয়ে পারছি না। নিশ্চয় এলি'স ভুল বলছে । কিন্তু একটি স্পেস ক্রাফটের ক্যাপ্টেন কেন,কোন স্বার্থে মিথ্যে বলতে যাবেন ? ধরলাম সে ভুল তথ্য দিয়েছে । কিন্তু চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকা নক্ষত্রগুলো তো আর মিথ্যে নয় । হাজার হাজার কোটি ডলারে ব্যয় করে আমাকে স্পেসে পাঠিয়ে কেউ নিশ্চয় মজা করবে না । না, কিছুতেই হিসেব মিলছে না । কোথাও মস্ত বড় একটি ফাঁক রয়ে যাচ্ছে । আমার মতো সামান্য একজন মানুষের পক্ষে তা খুঁজে বের করা সম্ভব নয়।
স্পেস ক্রাফট এক জায়গাতে স্থির হয়ে আছে । দেখে মনে হচ্ছে , এক চুলও নড়ছে । দূরে নক্ষত্রগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করছি । অতি আধুনিক ব্যবস্থা HDR পদ্ধতি । এ পদ্ধতিতে বস্তুর অনু-পরমাণুগুলোকে কোটিগুন বড় করে দেখা যায়। নক্ষত্রগুলো দেখার জন্য অণুবীক্ষণ যন্ত্র কিংবা টেলিস্কোপের মতো লেন্সের পেছনে চোখ রাখতে হচ্ছে না । মোবাইলের টাচ স্ক্রিনের মতো আঙুল দিয়েই খুব সহজে জুম ইন, জুম আউট করা যাচ্ছে । কোন গ্রহ বা নক্ষত্র কিংবা ব্ল্যাংক স্পেসের উপর টাচ করে জুম ইন আউট করে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে দেখা যাচ্ছে । শুধু তাই নয়, পাশে থাকা ছ ইঞ্চি বাই চার ইঞ্চি মনিটরে গ্রহ,নক্ষত্রের গঠন, আয়তন, বয়স,দূরত্ব সব তথ্য ভেসে উঠছে ।
প্রথমে মনিটরে ভেসে উঠা তথ্যগুলো এড়িয়ে স্রেফ কৌতূহল বশত এলোমেলো টিপাটিপি করতে থাকলেও এক সময় বিষয়টাতে আগ্রহী হয়ে উঠলাম । দেখছি,পড়ছি আর অবাক বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি এই ভেবে যে, কি করে এমন সব অপার বিস্ময় সৃষ্টি হতে পারে। নিজে নিজে তো অবশ্যই সৃস্টি হতে পারে না। এতো বড় ইঞ্জিনিয়ারিং নিজ থেকে সৃষ্টি হওয়া একেবারে অসম্ভব । গ্রহ নক্ষত্রগুলোর একটির সাথে অন্যটির কোন কোন ক্ষেত্রে সামান্য মিল থাকলেও প্রতিটি গ্রহ, নক্ষত্র স্বতন্ত্র। যে যার অবস্থান,লাইন,গতি বজায় রেখে স্থান পরিবর্তন করছে। ফলে অদৃশ্য এক শৃঙ্খলা সর্বত্র বিরাজমান। কেউ কারো সীমা অতিক্রম করছে না। যিনি এমন বিস্মৃয় সৃষ্টি করেছেন, তিনি নিজে কতোটা বিস্ময়কর সে ভেবে ক্রমেই অবাক হচ্ছি । নিজে খুব একটা ধর্মভীরু না হলেও যতোই দেখছি ততোই অদৃশ্য সেই স্রস্টার প্রতি অনুরক্ত না হয়ে পরছি না ।
ভাবা যায়, চোখের সামনে কোটি কোটি বছর আগে সৃষ্টি হওয়া গ্রহ নক্ষত্রগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভাবলেই শরীর শিহরিত হয়ে উঠে। এমন সব বিস্ময় যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি না জানি কত বড় বিস্ময়কর।
দৃষ্টি সীমার গোচরে গ্রহ, নক্ষত্র, ব্লাক হোলগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম । প্রক্সিমা সেন্টরাই এর মতো নক্ষত্রগুলো এতো বেশি উজ্জ্বল যে, সেগুলো খুব বেশি জুম করে দেখা যাচ্ছে না । সেগুলো থেকে বিচ্ছুরিত আলোয় ছটায় চোখ ধাঁদিয়ে দিচ্ছে । সে কারনে অপেক্ষাকৃত শান্ত ও পাথরে গ্রহগুলো সহজেই আমার মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হলো । ধীর স্থির ভাবে সময় নিয়ে সেগুলোকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম । নেশায় পেয়ে বসলো আমায়।
একটি গ্রহ থেকে অন্যটির দূরত্ব হাজার হাজার লাইট ইয়ার হলেও আমার কাছে মনে হতে লাগলো ঝুড়িতে রাখা অসংখ্য কমলা লেবুর মধ্য থেকে একটি একটি করে কমলা লেবু নেড়েচেড়ে দেখছি । এতোটা নিখুঁত ও ঝকঝকে ছবি পৃথিবীতে ও কোথাও দেখেছি কিনা মনে করতে পারলাম না। পৃথিবীর কথা মনে হতেই । পৃথিবীর উপগ্রহ চাদের কথা মনে হলো ।
জানালা থেকে চোখ না সরিয়েই আমি বললাম, এলিস......
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো , বলো চার্লি ।
আমি কি এখান থেকে পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদ দেখতে পারি ?
এলিস একটু সময় নিয়ে বলল , দু:খিত চার্লি সেটা সম্ভব নয় । আমরা এতোটাই দূরে চলে এসেছি যে , এখান থেকে তুমি, পৃথিবী কিংবা চাঁদ কোনটাই দেখতে পাবে না । মিল্কি ওয়ে' গ্যালাক্সির খুব কম গ্রহ নক্ষত্রই তুমি এখান থেকে দেখাতে পাবে ।
তোমার কন্ট্রোল রুমে বসেও কি দেখা যাবে না ?
এবার এলিস কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর বলল, না চার্লি । দেখা যাবে না ।
এলিসের উওর শুনে হঠাৎ করেই মনটা উদাস হয়ে গেলো। প্রসঙ্গে পাল্টে আমি প্রশ্ন করলাম, তোমরা কি আমায় বন্দী করে রেখেছো ?
এলিস হেসে বলল না, তা কেন হবে ? T90B12 D মহাকাশ যানের অন্য সবার মতো তুমিও একজন সম্মানিত নভোযাত্রী ।
তাহলে আমাকে, ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছো না কেন ?
ঘর থেকে বের হবার কোন প্রয়োজন নেই বলে তুমি ঘর থেকে বের হতে পারছ না। অবশ্য চাইলে তুমি এক্ষুনি বের হতে পারো । আমরা সবাই যার যার রুমে থেকেই একটি নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়ে কাজ করছি । একান্ত বাধ্য না হলে কন্ট্রোল রুমে যেতে হয় না । তাছাড়া T90B12 D মহাকাশযান'টি একটি উন্নত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ধারা পরিচালিত হচ্ছে । পুরো শিপের কন্ট্রোল তার হাতে । সে ভাবেই তাকে প্রোগ্রামিং করা হয়েছে । শুধু মাত্র কয়েকটি বিষয়ে সে আমাদের নির্দেশ মানতে বাধ্য । যে ক'জনার নির্দেশনা মানতে সে বাধ্য তাদের মধ্যে তুমি ও একজন । এ ছাড়া সে স্বাধীন ।
বলো কি ! তাহলে তো আমরা সবাই এক কথায় বন্দী।
না, বিষয়টা এভাবে ভেবো না । শুধু এটুকু জেনে রাখো মিশন শেষ না হলে আমরা কেউ ফিরে যেতে পারবো না । আবার এমনও হতে পারে অ্যান্ডোমিডায় বসবাস উপযোগী কোন গ্রহ পাওয়া গেলে আমরা সেখানেও থেকে যেতে পারি । পুরো বিষয়টা নির্ভর করছে পরিস্থিতির উপর ।
আমার কেন যেন মনে হলো এলিস আমার সঙ্গে মিথ্যা বলছে । কেন মনে হলো জানি না । তবে এ অনুভূতিটাকে আমি চিনি । এ অনুভূতি কখনো মিথ্যা হতে পারে না ।
এলিস ? আমি একটু কঠিন কণ্ঠে ডাক দিলাম ।
বলো চার্লি ।
তুমি মিথ্যা বলছো, তাই না ?
এলিস একটু সময় নিয়ে পাল্টা জিজ্ঞাসা করলো, কি মিথ্যা বলছি, চার্লি ?
এই যে বললে পৃথিবীতে ফিরে যাবার কথা । তুমি ভালো করেই জানো T90B12 D মহাকাশযানের লগ বুকে ফিরে যাবার কোন নিদের্শনা নেই। এলিস আবারো কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল, সে জন্য তো থেকে যাবার কথাও তো বলেছি চার্লি ।
হ্যাঁ এটাই তোমাদের এ মিশনের মূল উদ্দেশ্যে । কারণ আমার অনুভূতি বলছে, আমাদের পৃথিবীতে ফিরে যাবার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ । সেটা তোমাদের প্লানেও নেই । এটা ওয়ান ওয়ে মিশন। তাই না ?
এলিস এবার চুপ করে রইলো কোন উত্তর দিলো না ।
চুপ করে থেকো না এলিস, সত্যিই যদি তুমি চাও আমি তোমাকে সর্বাত্মক সাহায্য করি তাহলে আমার সব প্রশ্নের জবাব তোমাকে দিতে হবে ।
কিছু সময় চুপ থেকে এলিস বলল , বেশ কি জানতে চাও বলো ।
তোমরা আমাকে কেন নিয়ে এসেছো ?
তোমার বুদ্ধি মত্তার জন্য । তোমার আই কিউ লেভেল পৃথিবীর সর্বকালের মধ্যে সেরা । এছাড়াও তোমার রয়েছে ভবিষ্যৎ বলার ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা । যা আমাদের এই অভিযানের এই মুহূর্তটির জন্য বিশেষ দরকার । এটাই তোমাকে এ অভিযানে সংযুক্ত করার একমাত্র কারণ ।
এলিসের সোজা সাপটা জবাবে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম । নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,তাই বলে তোমরা কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে নিয়ে আসবে?
দেখো চার্লি এমন একটি ব্যয় বহুল মিশনের যদি ভলেন্টিয়ারের জন্য ঘোষুনা করা হতো তাহলে কোটি কোটি মানুষ সে সুযোগটা নেবার জন্য আবেদন করতো । সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে তুমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতে পারো । তাছাড়া তোমাকে এভাবে নিয়ে আসা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় ছিলো না । কেননা আমাদের রির্পোট বলছে , স্বেচ্ছায় হলে তুমি আসতে না । তাই মানব সভ্যতার বৃহত্তম কল্যাণের স্বার্থে তোমাকে এভাবে নিয়ে আসা হয়েছে । বিষয়টির জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দু:খ প্রকাশ করছি । যদিও এ সিদ্ধান্তটি রাষ্ট্রীয় এবং ওয়ার্ল্ড অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস সোসাইটির (WASS)'র ।
আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না । মুহূর্তের মধ্যে সকল সত্য উন্মোচিত হয়ে যাওয়ায় নিজেকে খুব অসহায় মনে হতে লাগলো । জানালায় চোখ রেখে বাহিরে তাকিয়ে রইলাম । ঠিক তখনই বহু দূরের একটা অন্ধকার পাথুরে গ্রহে কিছু একটা নড়ে উঠে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।
মূল গল্প মূলত এখান থেকে শুরু ।
চলবে ...............