২০১০ সালের ৫ এপ্রিল রাষ্ট্রীয় গোমর ফাঁস করে দেওয়ার জন্য খ্যাত ওয়েবসাইট উইকিলিকসে প্রকাশ করা হয় একটি মার্কিন সামরিক ভিডিও চিত্র। এই ভিডিও চিত্রটি ধারন করা হয়েছিল ইরাকে যুদ্ধরত একটি মার্কিন অ্যাপাচি হেলিকপ্টারের গান-ক্যামেরার সাহায্যে। এটি প্রকাশ হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে এই ঘটনা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়।
সায়ীদ চামাঘ এবং নামির নুর আলদ্বীন দুজনেই দুটো জিনিস বহন করছিলেন। সায়ীদের কাঁধে ছিল একটা ব্যাগ এবং নামীরের কাছে ছিল একটা ক্যামেরা। সবাই তাদের স্বাভাবিক কার্যকলাপে ব্যস্ত ছিল। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত হমলার শিকার হন তারা
ভিডিওটি ধারন করা হয়েছিল ২০০৭ সালের ১২ জুলাই। এতে দেখা যায় একটি হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে বাগদাদের রাস্তায় দৃশ্যত স্বাভাবিকভাবে চলাচলকারী একদল বেসামরিক লোকের ওপর উম্মত্তভাবে গুলিবর্ষন করছে মাকিন সৈন্যরা। ভিডিওটিতে মার্কিন বাহিনীর বেতার সম্প্রচার অন্তর্ভুক্ত আছে। যা থেকে গুলিবর্ষনের সময় হেলিকপ্টার গানম্যানদের পারস্পরিক কথাবার্তা শোনা যায়। এতে দেখা যায় সৈন্যরা হত্যার জন্য ছুতো খুঁজছে। হত্যার পর পৈশাচিক উল্লাস করছে। আরো হত্যার জন্য উম্মত্ত হয়ে উঠছে তারা। এমনকি শিশুদের ওপর গুলিবর্ষনের পরও তাদের কোনোই ভাবান্তর দেখা যায়নি।
প্রথম দফা হামলার পর একটি গাড়ী আহতদের উদ্ধারের চেষ্টা করলে সেটার ওপর ৩০ এমএম কামান এবং পরে ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালানো হয়। এ ঘটনায় রয়টারের দুজন সাংবাদিক (সায়ীদ চামাঘ এবং নামীর নুর আলদ্বীন) সহ বার জন নিহত হয় এবং দুজন শিশুসহ অনেকে আহত হয়। এবপর স্থল বাহিনীর ট্যাংক আহত মানুষ এবং দুটি শিশুসমেত গাড়ীর সামনের অংশটি পিষে ফেলে।
নামির নুর আলদ্বীনের দেহের উপর দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হল ইউএস ইনফ্রানটির ব্রাডলি (ট্যাংক)
আর একটি যুদ্ধযান রাস্তায় পড়ে থাকা নামীর নুর আলদ্বীনের মৃতদেহের উপর দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হয়। এই অমানবিক কাজটা করার পর নিজেদের মধ্যে রসিকতা বিনিময় করে চালক এবং অন্য একজন।
ভিডিওতে স্পটতই দেখা গেছে রয়টারের সাংবাদিক ব্যাগ থেকে লম্বা লেন্সওয়ালা ক্যামেরা বের করে ছবি তুলছে। আরো কয়েকজন হেঁটে তাদের কাছে আসছে। কিন্তু ধারণকৃত বেতার সম্প্রচারে হেলিকপ্টারের গানম্যানরা এটিকে রকেট লাঞ্চার বলে উল্লেখ করে। একজনের কাঁধে ছিল একটি লম্বা ব্যাগ। ব্যাগ বহনকারীকে তারা একে-৪৭ ধারী বলে উল্লেখ করে। ভিডিও চিত্রে যা একবারেই মনগড়া বলে মনে হযেছে।
উইকিলিকসের প্রকাশ করা এই ভিডিও চিত্র ভিন্নমাত্রা পেয়েছে ওইসময়ের অব্যবহিত পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত মার্কিন স্থল বাহিনীর সদস্য ইথান ম্যকর্ডের প্রত্যাদর্শীর বিবরন প্রকাশের মধ্য দিয়ে। চরম হট্কারী এবং মর্মস্পর্শী ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর ইথান ম্যাকর্ড বিবেকের তাড়নায় সামরিক বাহিনী ত্যাগ করে যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। উল্লেখ্য উইকিলিকসের ভিডিওতে ইথান ম্যকর্ডকেও দেখা গেছে। ২০১০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাসে যুদ্ধবিরোধী এক সমাবেশে মাকর্ড প্রত্যদর্শীর বর্ননা দেন। মাকর্ড বলেন, আমাদের এভাবেই গড়ে তোলা হয়। মনুষত্ব বলে কিছুই আর অবশিষ্ট রাখা হয় না। তিনি বলেন, ইরাকে আমাদের বলা হয় কোনভাবে আক্রান্ত হলেই ‘৩৬০ ডিগ্রি রোটেশনাল ফায়ার’ কর এবং রাস্তার প্রত্যেকটি লোককে হত্যা কর। এমনকি এরফলে বেসামরিক লোক নিহত হলে তার দায়দায়িত্বও তারা গ্রহন করবে বলেও উল্লেখ করে। আর এরকম না করলে এসসিও বা ব্যাটালিয়ন কমান্ডাররা আমাদের জীবন অতিষ্ট করে তুলত। যে ভিডিওটা নিয়ে আমরা কথা বলছি সেরকম ঘটনা ইরাকে প্রতিদিন ঘটছে। লোকজনের ওপর আক্রমন করার জন্য যে বিধি আছে তা হাস্যকর। বলা আছে, যে কাউকে হুমকি মনে হলেই তার ওপর গুলি ছোড়া যাবে। এমনও হয়েছে অনেক সৈনিক কেবল তার দিকে তাকানোর জন্যও গুলিবর্ষন করেছে। কিন্তু আমি জানতাম, কোনোভাবেই আমি একজন মহিলা, শিশু বা নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিককে গুলি করতে পারিনা।
২০০৭ সালের ১২ জুলাই এর মর্মান্তিক ঘটনার আবেগাপ্লুত বর্ননা শুনে উপস্থিত অনেক মার্কিনীকেই চোখ মুছতে দেখা যায়। ইথান ম্যাকর্ড প্রত্যদর্শীর বর্ননা দেন এভাবেই -
“ঘটনার পরপরই আমরা সেখানে উপস্থিত হই। রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে মৃত দেহ, পাশে কামানের গোলায় বিধ্বস্ত প্রায় একটি মিনিভ্যান (মাইক্রোবাসের মত গাড়ী)।
ইউএস ইনফ্রানটির ব্রাডলি (ট্যাংক) পিষে ফেলছে আহত এবং শিশুসমেত আক্রান্ত বিদ্ধন্ত গাড়ীটির সামনের অংশ
বিধ্বস্ত গাড়ীটির ভেতর থেকে শিশুর কান্নার শব্দ ভেসে আসছিল। আমি এবং আর একজন সৈনিক ভেতরে উঁকি দিলাম। দেখলাম সিটের ওপর বছর চারেকের একটি মেয়ে পেটে গুরুতর জখম নিয়ে কাতরাচ্ছে। তার চোখ এবং চুলে গেঁথে আছে অসংখ্য কাঁচের টুকরো। একটা ছোট ছেলে গাড়ীর মেঝেতে পড়ে আছে মাথাটা সীটে হেলানো। বয়স বড়জোর সাত হবে। সে নড়াচড়া করছিল না আপাত দৃষ্টিতে তাকে আমার মৃতই মনে হয়েছিল। মাথার ডানদিকে মারাত্মক জখম। চালকের আসনে ছিল সম্ভবত বাচ্চাগুলোর পিতা। তার পড়ে থাকার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল বাচ্চাগুলোকে সে নিজের শরীর দিয়ে আড়াল করতে চেয়েছিল। তার বাঁচার কোন উপায়ই ছিল না। আমি দ্রুত ছোট্ট মেয়েটিকে কোলে তুলে নিয়ে একজন চিকিৎসা কর্মীর সাথে কাছাকাছি একটা বাসার ভেতরে গেলাম। সেখানে একজন স্থানীয় বাসিন্দা ভয়ে আতঙ্কে রান্নাঘরে লুকিয়ে ছিল। আমি মেয়েটির শুশ্রুষার জন্য তার সাহায্য চাইলাম। সে দ্রত সাড়া দিল এবং একটি পাত্র ভরে পানি নিয়ে এল যা দিয়ে আমি এবং চিকিৎসা কর্মীটি শিশুটিকে পরিষ্কার করে তগুলো ড্রেসিং করে দিলাম । তার চোখে বিঁধে থাকা কাঁচ আমি যতটুকু সম্ভব টেনে বের করলাম যাতে সে পলক ফেলতে পারে। পুরো সময়টা জুড়ে আমি ভাবছিলাম এগুলো করতেই কি আমি এখানে এসেছি? আমার মনে পড়ল দেশে ফেলে আসা আমার সন্তানদের কথা। আমার ছেলে জন্মগ্রহন করেছে ২০০৭ এর ৩১মে। তখনও আমি তাকে দেখিনি। আমার মেয়েটি বয়সে এই মেয়েটির চেয়ে বড় হবে না।
আমি বাচ্চা মেয়েটিকে চিকিৎসা কর্মীর কাছে রেখে আবার গাড়ীটির দিকে ফিরে গেলাম কোনো এক অজানা তাড়নায় । ভেতরে উঁকি দিলাম। ছেলেটা কি একটু নড়ে উঠল!
ইউএস ইনফ্রানটির সদস্য ইথান ম্যাকর্ড গাড়ী থেকে একটি শিশু উদ্ধার করে কোলে নিয়ে ছুটছে
আমি মেঝেতে পড়ে থাকা ছেলেটিকে বুকে তুলে নিয়ে ছুটতে শুরু করলাম আর চিৎকার করে বললাম ‘ছেলেটা বেচেঁ আছে’ . . . . . .। ছেলেটি আমার দিকে চোখ মেলে তাকাল, বড়জোর ২-৩ সেকেন্ডের জন্য। আমি বলার চেষ্টা করলাম ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’। কিন্তু সে নেতিয়ে পড়ল। মনে হল আমার কোলেই বোধহয় ছেলেটি মারা গেল। আমার ব্যাটালিয়ান কমান্ডার আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘হোয়াট দ্য ... ইউ ডুয়িং, পুট দ্য ...কিড টু দ্য সিকিউরিটি’। এরপর আমি বাচ্চাাটকে অন্যদের কাছে হস্তান্তর করে ছাদের ওপরে চলে যাই। ওই সময় কোন একজন সৈনিক আমার একটা ছবি তোলে। আমি পরে দেখেছিলাম ছেলেটির রক্তে আমার ইউনিফর্মের সামনের অংশ লাল হয়ে গিয়েছিল। বেস ক্যাম্পে ফিরে ঘটনাটা সবাই ভুলে গেল কিন্তু আমি ভুলতে পারলাম না। আমি ঘরে ফিরে ইউনিফর্ম থেকে শিশুটির রক্ত পরিষ্কার করলাম। আমার চোখের পানি আমি কোনোভাবেই লুকোতে পারছিলাম না। সেই মর্মান্তিক দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। আমার নিয়ন্ত্রন বিবেকের হাতে চলে যাচ্ছিল। যে জিনিসটি যুদ্ধে সৈনিকদের করা একেবারেই নিষেধ সেটাই আমি করলাম। আমার মানবতা তখন সব নিয়মকে ছাপিয়ে সামনে চলে আসছিল। ...
আহত ৭ বছরে শিশুটির রক্তে লাল হয়ে গেছে ম্যাকর্ডের ইউনিফর্ম
সিনেমা দেখে কিংবা গান শুনে বাস্তবতাটা ভুলে থাকতে চাইলাম। সহযোদ্ধা সৈনিক, আমার পরিবার, দেশের সিভিলিয়ন সবার উপরই আমার খুব রাগ হল কিন্তু সবচেয়ে বেশি রাগ হল নিজের ওপর। যা করেছি তার জন্য নিজের ওপরই ঘেন্না হল। সেইথেকে আমি এই মর্মযন্ত্রনা সাথে নিয়ে বেঁচে আছি। অনেকদিনই আমার মনে হয়েছে একজন স্নাইপার আমাকে টার্গেট করলে অন্তত এই যন্ত্রনা থেকে আমি মুক্তি পাব। এটা আমার মাথার ভেতর প্রোথিত হয়ে গেছে। ওই দৃশ্যগুলো দেখার জন্য আমার গান- ক্যামেরার কিপ দেখার প্রয়োজন হয় না। প্রতিদিনই এমনিতেই আমি এটা দেখি। চোখ বন্ধ করলেই আমি ওইসব বাচ্চাদের কান্না শুনতে পাই। ওই গন্ধ আমি চিনতে পারি। চুপচাপ থাকলে আমি চোখের সামনে ওই দৃশ্য দেখতে পাই।”
১. হত্যাযজ্ঞ এবং ইথান ম্যাকার্ডের জবানীতে প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ননার লিংক:
২. ট্রান্সক্রিপ্ট লিংক:
**এ লেখাটি গত সপ্তাহে দৈনিক সংবাদে ছাপা হয়েছে
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১১ সকাল ১০:৩১