View this link
লিখতে বসেছিলাম এক বিষয়ে। সে লেখা সরিয়ে রাখতে হলো। নভেম্বরের প্রথম সাত দিনের ১০টি দৈনিকের ৭০টি সংখ্যা পড়ে মনে হলো, প্রসঙ্গ পাল্টানো দরকার। একটি জাতির সংবাদমাধ্যম যদি ৩৫ বছর পর ভোল পাল্টাতে পারে, রাজনৈতিক নেতারা যদি ভোল পাল্টাতে পারেন, একজন উপসম্পাদকীয় লেখকের পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রসঙ্গ পাল্টাতে অসুবিধা কোথায়?
খুব বড় মিলিটারি রেজিমেন্টেশনের মধ্যে ইতিহাস গায়েব করা হয় অথবা বিকৃত করা হয় এবং সত্য ধামাচাপা দেওয়া হয়। শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশে এবং সম্পূর্ণ বিনা প্ররোচনায় ইতিহাসকে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলার দৃষ্টান্ত শুধু বাংলাদেশেই পাওয়া যাবে। কঠোর সামরিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রে সাংবাদিককে সত্য চেপে যেতে হয়। কিন্তু গায়ে পড়ে সত্য গোপন করা অতি নিন্দনীয় কাজ। আজ বাংলার রঙ্গমঞ্চে কুশীলবদের রাজনীতির অভিনয় দেখে ক্ষুধিত পাষাণ-এর পাগলা মেহের আলীর মতো বলতে ইচ্ছা হয়: ‘তফাত যাও! তফাত যাও! সব ঝুট্ হ্যায়! সব ঝুট্ হ্যায়!’ আজ বাংলাদেশে যাঁদের বয়স ৬০-এর ওপরে, তাঁদের অধিকাংশের অবস্থা পাগলা মেহের আলীর মতো।
১৯৭৫-এর নভেম্বরের প্রথম হপ্তায় অ্যাবসার্ড নাটকগুলো অভিনীত হয়েছে এখনকার ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক মানুষদের সামনে। তাঁরা সব দেখেছেন, তাঁরা সব জানেন। এখন আর নতুন কিছু যোগ করা যাবে না।
বাঙালি স্বার্থসিদ্ধির জন্য সব সময়ই একজন নন্দ ঘোষ খোঁজে। নিজের দোষ তার ওপর চাপিয়ে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বাঙালি দিব্যি ঘুরে বেড়ায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত মহাজোট সরকারের আমলে জিয়াউর রহমানকে নন্দ ঘোষের ভূমিকায় বসানো হয়েছে। অবশ্য জিয়া ও এরশাদের সময় নন্দ ঘোষ ছিলেন অন্য কেউ।
পঁচাত্তরের পরবর্তী ৩১ বছর নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে অজস্র সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়, প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে আমাদের জাতীয় দৈনিকগুলোতে। প্রকাশিত হয়েছে রাশি রাশি প্রতিবেদন ও সাক্ষাৎকার। সেগুলো যদি বন্দুকের নলের মুখে প্রকাশিত না হয়ে থাকে, তাহলে সেসবকে অগ্রাহ্য করা যাবে না।
একটি গণতান্ত্রিক সমাজের প্রধান গুণই হলো বিশুদ্ধ যুক্তিবাদিতা। কোনো রাষ্ট্রে তা যদি না থাকে, তাহলে জাতীয় জীবনকে অন্ধত্ব গ্রাস করে। সেখানে সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে না। সেখানে বৈজ্ঞানিক চিন্তার সুযোগও থাকে না। শিক্ষা-সংস্কৃতির অমূল্য উপাদানগুলো চূর্ণ হয়ে যায়। সে অবস্থায় বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে ইতিহাসের নামে বহু রকম কল্পকথা প্রচারিত হয়। তা প্রচারিত হয় কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী ও তাদের দোসরদের অথবা সুবিধাভোগীদের স্বার্থে।
পঁচাত্তরের নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অপরিহার্য অংশ। ওই ঘটনাপ্রবাহের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ছাড়া, কল্পকথা ছড়িয়ে জাতির কোনো উপকার হবে না। কাগজে বা বইপত্রে যা লেখা হলো তা-ই ইতিহাস নয়, মানুষ যা জানে, তা-ই ইতিহাস। মার্কিন দলিলপত্রের মাধ্যমে মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোয় যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন, বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনায় তা সহায়ক। কিন্তু মার্কিন কূটনীতিকদের পাঠানো প্রতিবেদনই ইতিহাস নয়—ইতিহাসসংক্রান্ত মন্তব্য প্রতিবেদন, যে প্রতিবেদন লিখিত হয়েছে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও বিভিন্ন প্রচারপত্রের ভিত্তিতে। সেই সঙ্গে আছে ওই প্রতিবেদন প্রেরকের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ। ইতিহাস রচনা করতে চাইলে তখনকার রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মূল প্রচারপত্র-লিফলেটের সাহায্য নিতে হবে।
বাংলাদেশের পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতি একটি যৌথ রাজনৈতিক প্রকল্প—কোনো এক ব্যক্তি বা একাধিক ব্যক্তির কাজ নয়। যে রাজনীতির প্রবর্তনে গোটা দেশের অধিকাংশ মানুষের নীরব অথবা প্রকাশ্য সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল। তা না থাকলে কোনো ব্যক্তি, তা তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি শক্তিমান মানুষও যদি হন, টিকে থাকতে পারতেন না। যৌথ প্রকল্প না হলে ওই ধারার রাজনীতি ২১টি বছর বা তারও বেশি টিকে থাকত পারত না।
নভেম্বর উপাখ্যান সম্পর্কে প্রথম আলোয় দুই দলের দুই জেনারেলের সাক্ষাৎকার বেরিয়েছে। মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ বলেছেন, ‘জিয়াউর রহমান তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ পূরণ ও ক্ষমতা সংহত করতেই সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেন।’ তাঁর এই বক্তব্য থেকে ১২-১৪ বছর বয়স্ক যেকোনো পাঠক মনে করবে, যেকোনো জেনারেলই ইচ্ছা করলে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে পারেন। একজন জনপ্রিয় জেনারেল তাঁর বাহিনীকে ব্যবহার করতেই পারেন, অন্যদিকে দুর্বল ও ব্যর্থরা অধীনস্থের অধীনে গোলামি করেন। একজন সেনাশাসক সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করবেন না তো কি রাস্তার হকার, পত্রিকার উপসম্পাদকীয় লেখক, কবি, নাটকের কলাকুশলী বা ট্যাক্সি ড্রাইভারদের ব্যবহার করবেন?
১৭ আগস্ট আমি বাংলাদেশের সংবাদ সংস্থার মহাব্যবস্থাপক ও সম্পাদক জাওয়াদুল করীমের সঙ্গে বঙ্গভবনে গিয়েছিলাম। সেখানে বারান্দায় দাঁড়িয়ে যে দৃশ্য দেখেছিলাম, তা আজ অবিশ্বাস্য মনে হয়। আমার কাছে তখন ‘বিশ্বাসঘাতক’ বা ‘নিমক হারাম’ শব্দ দুটিকে বাঙালির জন্য যথেষ্ট শক্ত শব্দ মনে হয়নি।
দিনের পর দিন সেনাবাহিনীর কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমে ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছেন। ৭ নভেম্বর উপলক্ষে জেনারেল সফিউল্লাহর স্মৃতি রোমন্থন অথবা পর্যবেক্ষণ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। কারণ, মানবজাতির ইতিহাসে তিনিই একমাত্র সেনাপতি, যিনি ১০টি দিন তিন-চারজন মেজরের অধীনে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করেছেন। এবং সেই মেজররাই তাঁকে, তাঁর ভাষায়, ‘বরখাস্ত’ করেন। তিনি নিজেই বলছেন, ‘বরখাস্ত’, আমরা জানি তাঁকে ‘অবসর’ দেওয়া হয়েছিল। সে জন্যই এখন ‘অব’ লেখা হয়, ‘বরখাস্ত’ লেখা হয় না। তিনিই একমাত্র সেনাপ্রধান, যিনি দুজন রাষ্ট্রপতির অধীনে বহুকাল রাষ্ট্রদূতের চাকরি করেন—যে দুই রাষ্ট্রপতি একসময় ছিলেন তাঁরই অধীনে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষ্য দিতে গিয়ে মূর্ছিত হয়ে পড়ে যাওয়ার আগে তিনি যে জবানবন্দি দেন, তা আমাদের অনেকের কাছে আছে। জিয়াউর রহমান বা জেনারেল এরশাদের মতো সামরিক শাসকদের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞ থাকার কারণ নেই, সফিউল্লাহর তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। মোশতাক-জিয়া তাঁকে চাকরি দিয়েছেন এবং কখনোই জিয়া তাঁকে কূটনীতিকের চাকরি থেকে বরখাস্ত করেননি। এটা জিয়ার কম উদারতা নয়।
আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মানুষের যদি কৃতজ্ঞতাবোধ না থাকে, সৌজন্যবোধ না থাকে ও উপকারী বন্ধুর উপকারের ঋণ তারা স্বীকার না করে—তাদের দোষ দেওয়া যাবে না। আমাদের মতো মধ্যশ্রেণীর মানুষকে জীবনের বিশেষ বিশেষ অবস্থায় সুখ-শান্তিতে থাকার জন্য আপস করতে হয়। বিত্তবান ও সবলের কাছে নত হতে হয়। মেরুদণ্ড সোজা রাখা যায় না। তা যে বড় দোষ, তা-ও নয়। জিয়ার অব্যাহত নিন্দা সফিউল্লাহর মুখে শোভনীয় নয়।
পঁচাত্তরের নভেম্বর সম্পর্কে মার্কিন দলিল গুরুত্বপূর্ণ; তার চেয়ে বেশি মূল্যবান সেই সময়ের রাজনৈতিক দলগুলোর দলিল, প্রচারপত্র প্রভৃতি। খালেদ মোশাররফের দোষ স্খলনের একটা চেষ্টা চলছে কয়েক বছর ধরে, এখন হচ্ছে তাঁকে একজন চমৎকার নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আয়োজন। মিজানুর রহমান খান তাঁর ‘১৯৭৫ নভেম্বর মার্কিন দলিল ৫’-এ লিখেছেন, ‘রব-জলিল এক যৌথ বিবৃতিতে খালেদ মোশাররফকে “বিশ্বাসঘাতক” এবং “ভারত, রাশিয়া ও আমেরিকার উসকানিতে বাংলাদেশের অস্তিত্ব মুছে ফেলার চক্রান্ত” করেছিলেন বলে উল্লেখ করেন।’ হাসানুল হক ইনু এ সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা জাসদের কোনো দলিলে কখনো খালেদ মোশাররফ সম্পর্কে এমন মত দেইনি।...তবে তিনি উচ্চাভিলাষী, অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী ও সামরিক শাসনের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠাকারী।’ ইনু সাহেবের শেষ বাক্যটির সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ নেই, কিন্তু প্রথম কথাটি সঠিক নয়। জাসদের অসংখ্য প্রচারপত্র প্রমাণ দেয় মিজানুর রহমান খানের কথাই ঠিক। ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬, তাঁদের এক প্রচারপত্রে বলা হয়েছিল: ‘১৯৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে আধিপত্যবাদী ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর সহায়তায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করল। জনগণের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হলো না। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নিহত অগণিত মানুষের জমাট রক্তের বিনিময়ে সুখের সৌধ নির্মাণে ব্যস্ত হয়ে পড়ল নব্য বুর্জোয়া শাসক ও শোষকগোষ্ঠী। ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টের এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের কাঁধে ভর দিয়ে ক্ষমতা আত্মসাৎ করল মুজিবেরই এককালীন দোসর খোন্দকার মোশতাক, ৩রা নভেম্বর আবার ঘটল সামরিক অভ্যুত্থান, কুখ্যাত ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ভারত-রাশিয়ার প্ররোচনায় প্রতিক্রিয়াশীল মহল দেশ ও জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বকে চিরতরে বিলুপ্ত করার ষড়যন্ত্র করল; তারপর ঐতিহাসিক ৭ই নভেম্বরে জাসদ ও বিপ্লবী গণবাহিনীর সক্রিয় সহযোগিতায় সেনাবাহিনীর বিপ্লবী জওয়ানরা মহান সিপাহি অভ্যুত্থানে ফেটে পড়ল; কিন্তু আবার দেশি-বিদেশি শোষকরা জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো, অর্জিত হলো না লক্ষ্য,...।’
ক্ষণিকের জন্য রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করতে গিয়ে দরজার কাছ থেকেই খালেদকে বিদায় নিতে হয়। কিন্তু দেশের সর্বনাশ অর্ধেক করেছিলেন মোশতাক ও মেজররা, বাকি অর্ধেক সম্পন্ন করলেন খালেদ। মোশতাকের সময় ইসলামি চেতনা জোরদার হয়, কিন্তু ভারতবিরোধী জিগির ছিল না। বাংলাদেশে ভারতবিরোধী চেতনা সুদৃঢ় করে যান খালেদ। সেই চেতনা ব্যবহার করে জিয়া পাঁচ বছর, এরশাদ নয় বছর এবং খালেদা পাঁচ-পাঁচ ১০ বছর ক্ষমতায় থাকেন। নিজের ক্ষমতা পোক্ত করতে আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করতে গিয়ে খালেদ আওয়ামী লীগকে ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে রাখার ব্যবস্থা করে যান। আওয়ামী লীগের যে ক্ষতি খালেদ করেছেন আর কেউ তা করেননি। তিনি ভারতপন্থী—নিজেই এ কথা চাউর করে দিয়েছিলেন এই আশায় যে তাতে ভারত সামরিক সাহায্য নিয়ে তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসবে। ভারতীয় নেতারা এত কাঁচা নন। কিন্তু ফল যা হওয়ার তা-ই হলো। বাংলাদেশের মানুষ ভারতের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন হয়ে গেল বহুদিনের জন্য। দুই বন্ধু প্রতিবেশীর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেল। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে একটি নতুন রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বের জন্ম হয় ৩ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বরের তিন দিনে। সেই মনস্তত্ত্ব থেকে জাতি এখনো মুক্ত নয়।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ও ৩-৭ নভেম্বরের দিনগুলো আকাশ থেকে হঠাৎ পড়েনি। সব ঘটনারই একটি পটভূমি থাকে। ওই ঘটনাপ্রবাহেরও একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৯৭৪-এর ১৩ অক্টোবর জাসদ গণ-আন্দোলনের ডাক দেয় এবং ২৬ নভেম্বর দেশব্যাপী হরতালের আহ্বান জানায়। হরতাল ও গণ-আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাদের প্রচারপত্রে বলা হয়: ‘ভারতের আধিপত্যবাদী, রাশিয়ার সংশোধনবাদী ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সকল চক্রান্ত ও অশুভ প্রভাবের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পূর্ণ বিধানের জন্য; সাম্রাজ্যবাদ ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় সরকার গঠন।’
১৯৭৩-৭৪-এ প্রধান বিরোধী দল ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী) ও জাসদ। সরকারের সঙ্গে এই দুই দল ও অন্যান্য বাম দলের সম্পর্ক কেমন ছিল, তা আলোচনা ছাড়া পঁচাত্তরের আগস্ট-নভেম্বরের আলোচনা সম্পন্ন হতে পারে না। ১৯৭৩-৭৫-এ ন্যাপ, জাসদ ও বিভিন্ন বাম দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মী ছিলেন কারাগারে। তাঁদের জেলে ঢোকাতে সরকারের নীতিনির্ধারকদের যাঁরা পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই আজও ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং দাঁত বের করে হাসেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে চলে যেতে হলো।
অপ্রীতিকর সত্য আলোচনা করে যত খোলাসা করা যায়, তত গণতন্ত্রের উপকার। চাটুকারিতা করে বর্তমান মহাজোটের অসাম্প্রদায়িক সরকারকে সংহত করা যাবে না। তাতে সরকারের বরং ক্ষতি হবে। ক্ষতি হয়ে যাওয়ার পরে সেই দায় কেউ নেবেন না।
বাস্তবতাকে অস্বীকার করা বোকামি। বোস্টার বোকা ছিলেন না। তাই তিনি তাঁর ছাদের ওপর থেকে তাকিয়ে দেখে লিখেছিলেন: ‘জেনারেল জিয়া ৭ নভেম্বর সম্পূর্ণ ক্ষমতা করায়ত্ত করার একটি চমৎকার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি চাইলেই ক্ষমতা নিতে পারতেন। রাজপথে আমরা ৭ নভেম্বর যা দেখেছি, তা যদি কোনো অর্থ বহন করে থাকে, তাহলে এটাই প্রমাণ দেয়, জিয়ার ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে।’
রাজপথে মি. বোস্টার সেদিন যা দেখেছিলেন, তা আর কারও কাছে অর্থ বহন করুক আর না করুক, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের কাছে খুবই অর্থবহ ছিল। সেনাবাহিনীর একজন জনপ্রিয় মানুষই তাঁরা খুঁজছিলেন। তা তাঁরা পেয়ে গেলেন ৭ নভেম্বর। শুধু বোস্টার পাননি, বাংলার মাটির বাম ও অতি ডান সংগঠনের নেতারাও পান। জিয়ার নিজের কোনো শক্তি ছিল না। তাঁর শক্তির উৎস ছিল সোভিয়েত বলয়ের বাইরের গোটা পুঁজিবাদী বিশ্ব, মধ্যপ্রাচ্য এবং দেশের ভেতরের বিভিন্ন ক্ষুদ্র শক্তি। চীন তাঁর পক্ষে দাঁড়ায়। তা ছাড়া ১৯৭৫-৭৬-এ দেশের ভেতরে জিয়ার এতই বন্ধু ছিলেন, যাঁদের সংখ্যা প্রথম আলোর বন্ধুসভার সদস্যদের চেয়ে বেশি।
১৬ নভেম্বর জিয়ার সমর্থনে এগিয়ে আসে পাঁচটি বাম সংগঠন: পূর্ব বাংলার সাম্যবাদী দল (এম-এল), পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এল-এম), পূর্ব বাংলার গণবিপ্লবী পার্টি এবং কমিউনিস্ট কর্মী সংঘ। তারা তাদের ‘ভারত-রাশিয়ার নয়া চক্রান্তকে ব্যর্থ করুন’ শীর্ষক প্রচারপত্রে বলে: ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর মূল নেতৃত্ব ভারতের এজেন্ট হিসেবে বিশ্বাসঘাতক ও দেশদ্রোহিতার ভূমিকা পালন করলেও বহু দেশপ্রেমিক তাঁদের সমাজতন্ত্র ও ভারতবিরোধী স্লোগানের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে এখনো সেই সংগঠনে অবস্থান করছেন। তাঁদের কাছে আমাদের আহ্বান, আপনারা দেশপ্রেমিক হিসেবে নিজ দলের নেতৃত্বের কার্যকলাপ বোঝার চেষ্টা করুন এবং তাঁদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করুন।’
১৪ নভেম্বর পূর্ব বাংলার সাম্যবাদী দল এক প্রচারপত্রে বলে: ‘জাসদের অভ্যন্তরস্থ দেশপ্রেমিক ভাইদের প্রতি আমাদের আহ্বান; আপনারা সংগঠনের ভিতরের বিশেষ করে ভারত-রাশিয়ার ও অপর বিদেশি শক্তির দালালদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, তাদের বিতাড়িত করুন।...হিন্দু ভাইবোনদের প্রতিও আমাদের বিশেষ আহ্বান; আপনাদের দুঃখ-দুর্গতি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদ্বেষমূলক আচরণ থেকে মুক্তি লাভের জন্য ভারতের ইন্দিরা সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবেন না।’
জিয়ার সেদিন কোনো দল ছিল না, তাঁর কাজ অন্য দলের নেতারাই করে দেন। পূর্ব বাংলার গণবিপ্লবী পার্টি, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, বিভিন্ন ছাত্র, যুব ও শ্রমিক সংগঠন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নেতারা জিয়ার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ান। কোনো কোনো সংগঠনের প্রচারপত্রের ভাষা লোমহর্ষক অথবা ঘৃণা উদ্রেককারী। সফিউল্লাহ যে বলেন, জিয়া কিচ্ছু না, সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে ক্ষমতা আঁকড়ে ছিলেন, তা বড়ই করুণ শোনায়। দেশের ভেতরে তাঁর জনপ্রিয়তা ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি ওআইসি গঠিত মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনার একজন নেতা নির্বাচিত হতেন না।
শত্রুকে নিন্দা করারও একটা ভাষা আছে, একটা রীতি আছে। তার বাইরে গিয়ে কিছু করলে শত্রু উপকৃত হয়। শেখ হাসিনাকে খুশি করতে গিয়ে অনেকেই যা করছেন, তাতে জিয়ার উপকার হচ্ছে।
আরেকটি কথা বলে শেষ করতে চাই। বাংলার সংগ্রামী রাজনীতির ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে। দেশের বারো মাসের নয় মাসের সংবাদপত্র পড়ে মনে হবে—এই দেশের নেতা হলেন কয়েকজন ক্ষমতালোভী ও নষ্ট সেনা কর্মকর্তা। প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের কোনো প্রচার নেই। মিডিয়ায় জামায়াত নেতা গোলাম আযম ও বিভিন্ন চরের পীরেরা যে প্রচার পান, তার এক শ ভাগের এক ভাগ পান না তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। মিডিয়াকে নজরুলের কথাটা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই: দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ।