এক.
সাবাস! সাবাস!!
শব্দটি শুনে যে কেউ মনে করবে উৎসাহ দেওয়ার মতো কোন কিছু ঘটেছে এবং খুব স্বতঃস্ফুর্তভাবে উচ্চস্বরে আনন্দচিত্তে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। এ শব্দটির কাছাকাছি শব্দ হলো বাহ্! বাহ! কিংবা বেশ বেশ, ধন্য ধন্য; ইংরেজিতে ব্রাভো ব্রাভো, ওয়েলডান ইত্যাদি। কিন্তু কোনটিই সাবাসের মতো এত অর্থব্যঞ্জন বা ভাবপ্রকাশক নয়। শব্দটি কবি সুকান্তের ব্যবহারে দেখা যাক--
“সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয় :
জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।”
(দুর্মর; সুকান্ত ভট্টাচার্য)
এখানে সাবাসের পরিবর্তে বাহ্ বাহ্ কিংবা বেশ বেশ শব্দ প্রয়োগ করে কোনভাবেই ওই অর্থ আনা সম্ভব নয়।
অবাক করা ব্যাপার হলো, এই সাবাস শব্দটি আস্ত একজন মানুষ। মানুষের এ নামটি অপভ্রংশ হয়ে সাবাস হয়েছে। শব্দটির প্রয়োগ এত ব্যাপক যে, পারস্য থেকে শুরু করে পুরো ভারতবর্ষে এ শব্দটির বিকল্প কোন শব্দ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলা, উর্দু, হিন্দি, ফার্সিসহ উপমহাদেশের প্রায় সব ভাষাতে এ শব্দটির ব্যবহার দেখা যায়। জানা যাক শব্দটির উৎপত্তি। শাহ আব্বাস নামে পারস্যে একজন বাদশাহ ছিলেন। তিনি ১৫৮৮ খৃস্টাব্দ থেকে ১৬২২ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত পারস্য শাসন করেন। কূটনৈতিক বিচক্ষণতার কারণে কিংবদন্তিতে পরিণত হন তিনি। অনেক রাজা-বাদশার সাথে বিনা যুদ্ধে বুদ্ধির চালে বিজয়লাভ করেন তিনি। তাই তখন থেকেই লোকেরা কারো বুদ্ধিমত্তা বা বিচক্ষণতা দেখে কিংবা সাহস আর উৎসাহ যোগাবার জন্য ব্যবহার করতে থাকে শা-আব্বাস! যা রূপান্তর হয়ে সাবাসে পরিণত হয়। সে সময় ভারতের মোঘল রাজদরবারে বিপুল পরিমানে ইরানি আমির-ওমরাহ এবং বিভিন্ন প্রদেশে ইরানি রাজকর্মচারী থাকায় তাদের প্রভাবে ভারতের সর্বত্র এ শব্দটির ব্যাপক প্রয়োগ হতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলা ভাষাতেও শব্দটি স্থান পেয়ে যায়। [সূত্র : Travels in the Mughal Empire (AD 1656-1668) by Francois Bernier/অনুবাদ : বাদশাহী আমল; বিনয় ঘোষ; অরুণা প্রকাশনী; কলকাতা, বৈশাখ ১৪০২; পৃ. ৫৩]
কোথাকার কোন শাহ আব্বাস বাংলা ভাষাতেও এসে আশ্রয় নিতে পেরেছেন। অথচ আমরা আমাদের নিজস্ব সম্পদগুলোকে সেভাবে ব্যবহার করতে শিখে নি। যেমন বখতিয়ারের কথাই ধরা যাক। দুরন্ত সাহসের প্রতীক তিনি। এ সাহস কোন বোকামীপূর্ণ নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক ছিল। প্রতিষ্ঠিত রাজশক্তিকে খুব স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে পরাজিত করার হিম্মত কয়জনই বা রাখে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির বিরল। তাই আমরা সহজেই বুদ্ধিবৃত্তিক দুরন্ত সাহস বুঝাতে বখতিয়ার শব্দটি বা এর অপভ্রংশ ব্যবহার করতে পারতাম। গত আটশত বছরেও আমরা তা পারে নি।
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহও (১৩৪২-১৩৫৮ খৃ.) তেমন আরেক নজির। তিনি বাঙ্গালী জাতির গোড়াপত্তন করেন। তিনি সাতগাঁও, লখনৌতি, সোনারগাঁও এ তিনটি দিল্লি সালতানাতের প্রদেশকে এক করে স্বাধীন বাঙ্গালা রাষ্ট্রের পত্তন করেন। পরে আরো বিশাল ভূ-ভাগকে এ রাষ্ট্রের সাথে যুক্ত করেন। তিনিই প্রথম দিল্লির নিয়ন্ত্রণ অস্বীকার করে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। যা দুইশত বছর পর্যন্ত অক্ষুণ্ন থাকে। বাঙ্গালী জাতি গঠনকারী হিসেবে বাংলাপেডিয়াসহ সকল ঐতিহাসিকগণ তাকেই কৃতিত্ব দেন। তিনি তখন যে নাম দিতেন সে নামেই এ জাতি পরিচিত হতো। অপূর্ব রণকৌশল দিয়ে তিনি বার বার দিল্লির আক্রমন থেকে বাংলাকে বাঁচিয়েছিলেন। সাতশত বছর পর সেই একই রণকৌশল অবলম্বন করে স্ট্যালিন হিটলার বাহিনীকে পরাজিত করেন। এমনকি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ ঘটে মূলত দুশত বছরের এ সুলতানী আমলেই। তারা মৃতপ্রায় একটি ভাষাকে পুনর্জীবন দান করেন। কিন্তু তাদের কাউকেও আমরা আমাদের প্রতিদিনের শব্দে নিয়ে আসতে পারে নি। যেমন আমরা রাম, লক্ষ্মী, ইন্দ্র, রুদ্র ইত্যাদি নামকে শব্দ বানিয়ে কথা বলছি।
আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, আদি বাংলা ভাষার অনেক শব্দই আরবি-ফারসি জাত। যেমন ওহী থেকে বহি হয়ে বই শব্দের উৎপত্তি। এভাবে বিশ্লেষণ করলে বাংলা অনেক শব্দের মূলই পাওয়া যাবে আরবি-ফারসি থেকে উদ্ভুত। এছাড়া আমাদের প্রতিদিনের অসংখ্য নিত্য ব্যবহৃত শব্দই আরবি-ফারসিজাত। যেমন সরকারি, দরকারি, আমলা, ইজারা, ইস্তাফা, এজমালি, খতিয়ান, খাজনা, খাসমহল, খারিজ, গোমস্তা, গোয়েন্দা, চৌহদ্দি, জমাদার, জমি, জমা, জামানত, জমিদার, জরিপ, তফসিল, দফতর, দখল, দফা, দরখাস্ত, দরবার, দাগ, দাদন, দাখিলা, দেওয়ান, দৌলত, দৌলতখানা, নক্শা, নবাব, নাজির, নামজারি, নায়েব, পরচা, পরোয়ানা, পাইক, পালোয়ান, পিলখানা, পেয়াদা, পেশকার, ফরমান, ফৌজ, বন্দুক, বন্দোবস্ত, বায়না ইত্যাদি ।
কিন্তু ইংরেজ আমলে সংস্কৃত পণ্ডিতদের বদৌলতে এই স্বাভাবিক বাংলা ভাষা সংস্কৃতপ্রবণ হয়ে যায়। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পাদ্রী ও সংস্কৃত পণ্ডিতগণের তৈরিকৃত ‘বাংলা’ সম্পর্কে প্রখ্যাত ইংরেজ ভাষাতাত্ত্বিক স্যার জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন (১৮৫১-১৯৪১) বলেন : “শতকরা নব্বইটি প্রকৃত বাংলা শব্দের স্থলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সংস্কৃত শব্দ বসিয়ে বাংলা ভাষাকে তথাকথিত সাধু ভাষা বানানোর চেষ্টা করেছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিতগণ।” যে সময় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পাদ্রী ও সংস্কৃত পণ্ডিতগণ বাংলা গদ্য লেখা শুরু করেন, সে সময় এ সম্পর্কে ইংরেজ পণ্ডিত বহু ভাষাবিদ এন. বি. হ্যালহেড (১৭৫১-১৮৩০) মন্তব্য করেন : “বাংলা গদ্যের এই নব রূপায়ণ ঐতিহ্য-বিরোধী এবং ভাষার স্বাভাবিক বিকাশকে ব্যাহত করেছে।”
ভাষা কখনো সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। সবার জন্য হয়ে থাকে উন্মুক্ত, সর্বজনীন। হয়তো কোন ভাষায় কোন সম্প্রদায়ের বেশি উপস্থিতির কারণে সে ভাষায় ঐ সম্প্রদায়ের প্রাধান্য বেশি থাকতে পারে। এটা কোন দোষণীয় ব্যাপার নয়। বাংলা ভাষায় হয়েছে তার উল্টো। পৃথিবীতে বাংলা ভাষাভাষী জনসংখ্যার মধ্যে মুসলমানই বেশি। এ অবস্থা সব যুগেই ছিল। কিন্তু বাংলা ভাষার বিপুল শব্দ হিন্দু মিথ (Myth) থেকে নেয়া। সে তুলনায় মুসলিম মিথ থেকে নেয়া শব্দ খুবই কম। মূলত এমনটা হয়েছে হিন্দু লেখক-সাহিত্যিকের প্রাধান্যের কারণেই । তারা অকৃপণভাবে এসব মিথকে সাধারণীকরণ করেন। বিভিন্ন পৌরাণিক ব্যক্তিদের নামকে শব্দ বানান। বাংলা ভাষাকে তারা সমৃদ্ধ করেন। অন্যদিকে মুসলিম কবি সাহিত্যিকরা চরম অলসতার পরিচয় দেন। তারা নিজস্ব সংস্কৃতিকে স্বাভাবিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেন নি। নতুন নতুন শব্দ উপহার দিতে পারেন নি। বরং তারা বেশি বেশি সংস্কৃতপ্রবণ শব্দ ব্যবহার করে জাতে উঠতে চেয়েছেন। মাত্র নিকট অতীতে কবি নজরুল, ফররুখ, আবুল মনসুর আহমেদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, হালের প্রবীণ কবি আল মাহমুদ প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক মুসলিম শব্দ ও মিথকে শব্দ বানাতে চেষ্টা করেন। এ সময়ের বাংলাদেশী কবি-সাহিত্যিকরা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। তারা একে আধুনিকতা বিরুদ্ধ মনে করেন। কিন্তু তারা যে কৃত্রিম সাহিত্য রচনা করছেন, যা কালের বিচারে উত্তীর্ণ হওয়া কঠিন, এ বোধটুকুও তাদের নেই। যেমন পারেন নি মধুসূধন ইংল্যান্ডে গিয়ে ইংরেজি সাহিত্যিক হতে। পরে ঠিকই বাংলা ভাষা তাঁকে অমরত্ব দান করে।
হিন্দু মিথ থেকে নেয়া কিছু শব্দের উদাহরণ দিচ্ছি যা আমরা বিভিন্ন সময় শব্দ হিসেবে ব্যবহার করি। যেমন, ইন্দ্র হলেন স্বর্গের দেবরাজ। তা থেকে হয়েছে ইন্দ্রজিত (যে ইন্দ্রকে জয় করেছে), ইন্দ্রজাল (যাদুবিদ্যা, ভেলকি), এমন কি ইন্দ্রীয় শব্দটিও এসেছে ইন্দ্র থেকে। তাদের প্রধান দেবতা ব্রহ্মা থেকে বিশ্ব অর্থ বুঝাতে এসেছে ব্রহ্মাণ্ড, অতিশয় ক্ষমতাশালী বুঝাতে ব্রহ্মাস্ত্র শব্দ ব্যবহার করা হয়। তেমনি দেবতা শিবের সাংহার রূপ হলো রুদ্র। তা থেকে রুদ্ররোষ, রুদ্রমূর্তি এসেছে। রাম থেকে রামদা, রামধনু, রামছাগল, রামলীলা প্রভৃতি শব্দের উৎপত্তি। রাবণ থেকে রামণমুখো; দেবী চণ্ডী বা চণ্ডিকা থেকে কলহপ্রিয় নারী বুঝাতে রণচণ্ডী বা উগ্রচণ্ডী এসেছে। দেবতা কৃষ্ণ কর্তৃক নিহত দৈত্যের নামে গাড়ী অর্থে এসেছে শকট শব্দটি। এভাবে অসংখ্য হিন্দু ধর্মীয় ব্যক্তিদের নাম শব্দ হিসেবে আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছি। এ ক্ষেত্রে যদি আমরা আমাদের হাজার বছরের বাঙালি সামাজিক কৃতি ব্যক্তি, ঘটনা বা স্থানকে আমাদের ভাষায় নিয়ে আসতে পারতাম তাহলে কতই না সমৃদ্ধ হতো আমাদের গৌরবের এ মাতৃভাষা।
আমি সাম্প্রদায়িক কোন আলোচনা এখানে করতে চাই নি কিংবা দু’ জাতির প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলতে চাই নি, আমার সে ধরনের মানসিকতাও নেই। আমি মূলত এখানে আমাদের প্রকৃত দৈন্যতা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি এবং বলতে চেয়েছি ভাষার উন্নয়নে আমরা কী করতে পারি, আমাদের কী গ্যাপ হচ্ছে, আমরা কি আমাদের ভাষাকে কোন কৃত্রিম ভাষা বানিয়ে ফেলছি কি না... ইত্যাদি। মূলত এ লেখাটা হচ্ছে অনেকটা আত্মপর্যালোচনামূলক। কিন্তু জানি না, আমি আমার প্রকৃত মনোভাব ফুটিয়ে তুলতে পেরেছি কি না?
---------------------
তথ্যসূত্র:
১. Francois Bernier; Travels in the Mughal Empire (AD 1656-1668) /অনুবাদক : বিনয় ঘোষ; বাদশাহী আমল; অরুণা প্রকাশনী; কলকাতা, বৈশাখ ১৪০২
২. মুহম্মদ মতিউর রহমান; শব্দ সংস্কৃতি; অক্টোবর ১১, ২০১৬; Click This Link
৩. মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান; ভাষাবিজ্ঞানী জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন; দৈনিক ইত্তেফাক : ২৩ জানুয়ারি ২০১৩
৪. পবিত্র সরকার; হ্যালহেড: জীবন কথা; বণিকবার্তা : ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৭; Click This Link
৫. গোলাম মুরশিদ; বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান; বাংলা একাডেমি, ঢাকা
৬. ড. মোহাম্মদ হারুন রশিদ; বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি ফারসি উর্দু শব্দের অভিধান; বাংলা একাডেমি, ঢাকা
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:৪৬