somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

৭ম পর্ব - ভাষার ভূষণ : পরিভাষা ও প্রতিশব্দ

০৫ ই জুন, ২০১৪ বিকাল ৪:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একবার ‘হৃদয় বদল’-এর ঘটনা এক বাংলা দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় হরফে ছাপা হয়েছিল। ব্যাপারটা কত বড় ছিল তাই না?

আপনারা বুঝে গিয়েছেন, আমি কোন প্রণয়ঘটিত ঘটনা বলতে চাচ্ছি। ‘হৃদয় বদল’ কথাটা শুনেই আপনাদের মন সাথে সাথে এর রূপক অর্থের দিকে চলে গেছে। মূল অর্থ ‘হার্ট ট্রান্সপ্লান্টেশন’ কিন্তু কেউ বুঝেন নি। ১৯৬৭ সালের ৩রা ডিসেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত ইংরেজ ডাক্তার ক্রিশ্চিয়ান বার্নাড বিশ্বে প্রথম সফল হার্ট ট্রান্সপ্লান্টেশন করেছিলেন। এ সংবাদটি তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তানে (অধুনা বিলুপ্ত দৈনিক বাংলা) প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় হরফে ছাপে ‘হৃদয় বদল’ শিরোনামে। এমন একটি যুগান্তকারী সংবাদ বা বৈজ্ঞানিক সাফল্য শুধু লাগসই পরিভাষার অভাবে সে দিন সংবাদপত্রে প্রণয়ঘটিত ব্যাপারে রূপান্তরিত হয়েছিল।

তাই তো যুৎসই পরিভাষা না পেয়ে রবীন্দ্রনাথ রোমান্টিক শব্দটা হুবহু বাংলায় রেখে দেন। শুনতে ও বলতে কঠিন হওয়ায় দুরালাপনী শব্দটি হালে পানি পায় নি, ফোনই রয়ে যায়। কিন্তু মোবাইল ফোনের বিকল্প হিসেবে নির্মলেন্দু গুণের দেয়া ‘মুঠো ফোন’ শব্দটি ঠিকই জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। যা চমৎকার, কিন্তু আক্ষরিক অর্থ নয়।

আবার সত্যজিৎ রায় অনেকটা মজা করেই ফোনেটিক টাইপিং-এর মত ইংরেজি শব্দের বাংলা বানিয়েছিলেন। dictionary শব্দের বাংলা করেছিলেন 'দেখাশোনারি', impossible-কে করেছিলেন 'আম পচে বেল'!

মূলত পরিভাষা ও প্রতিশব্দ তৈরি একটা গতিশীল ভাষার চিরন্তন কর্মযজ্ঞ। একটা সুন্দর, সহজবোধ্য, মাধুর্যপূর্ণ ও যথাযথ পরিভাষা তৈরি করা গেলে তা ভাষায় স্থায়ীত্ব পায়, জনগণের মুখে মুখে তা স্থান পেয়ে যায়। বিদেশি বিভিন্ন শব্দ ও বিশেষায়িত শব্দের কোন ভাষায় যথাযথ পরিভাষা বা প্রতিশব্দ থাকলে সে ভাষা অনেক শক্তিশালী হয় এবং ভাষার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। মূলত পরিভাষা ও প্রতিশব্দ ভাষার ভূষণ হিসেবে কাজ করে। নতুন পরিভাষা না হলে ভাষা সমৃদ্ধ হবে না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্তার ঘটবে না।

আমাদের বাংলা সাহিত্য অর্থাৎ গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক হয়তো পরিভাষার মুখাপেক্ষী নয়, তবে অনুবাদ সাহিত্যের জন্য প্রয়োজন আছে। কিন্তু বিজ্ঞান, বাণিজ্য, দর্শন, চিকিৎসা, প্রকৌশল বিদ্যা, আইন শাস্ত্র তথা বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত এবং সংবাদমাধ্যমগুলোতে বাংলা ভাষার প্রয়োগ করতে গেলে পরিভাষার সমস্যা আসবেই। সে কারণেই প্রয়োজন উপযুক্ত পরিভাষা। তাছাড়া সাহিত্যে আধুনিক বিষয়গুলো তুলে ধরতেও পরিভাষার প্রয়োজন রয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করেছিলেন, ‘‘গল্প কবিতা নাটক দিয়ে বাংলা সাহিত্যের পনেরো আনা আয়োজন৷ অর্থাৎ ভোজের আয়োজন, শক্তির আয়োজন নয়৷'' বাংলাভাষায় শক্তির আয়োজন করতে গিয়ে প্রয়োজন পড়ে পরিভাষার৷

এক ভাষা থেকে অপর ভাষায় রূপান্তর করতে গেলে সব সময় এক শব্দে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। ভাষার এ সীমাবদ্ধতা মেনে নিতে হবে। এক ভাষার সব শব্দের যথার্থ প্রতিশব্দ অন্য ভাষায় থাকার আশা করাটা ঠিক নয়। তবে সেসব অনুপস্থিত শব্দের ভাব অন্যভাবে প্রকাশ করা যায়। যেমন বাংলার “পরশ্রীকাতর” শব্দটা এক শব্দে ইংরেজিতে বোঝানো না গেলেও একাধিক শব্দবিন্যাসে (a person who’s jealous of other’s fortune) তা সম্ভব। শব্দটির অর্থ Envious, malevolent বা jealous শব্দ দিয়ে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ পায় না।

দুই.
পরিভাষা আসলে কী এবং কেনই বা এর প্রয়োজন রয়েছে, তা জানা দরকার। যে শব্দের দ্বারা সংক্ষেপে কোন বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে ব্যক্ত করা যায় তাকেই পরিভাষা বলা হয়। শব্দ হল যে কোন কিছুর নাম বা তাকে ভাষায় প্রকাশ করার উপায়, প্রতিশব্দ হল সমার্থক শব্দ; কিন্তু পরিভাষা পুরোপুরিই সংজ্ঞাবাচক। এর অর্থ ব্যাপক। একটি পরিভাষা একটি পরিপূর্ণ সংজ্ঞাকে নির্দেশ করে। শব্দের অর্থ এবং পরিভাষার অর্থ ভিন্ন বা একেবারে বিপরীত হতে পারে। যেমন, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে। সংস্কৃতে বিজ্ঞান শব্দের অর্থ ছিল ঈশ্বরানুভব, অপরোক্ষ জ্ঞান, তত্ত্বজ্ঞান বা বিশেষ জ্ঞান। কিন্তু বাংলায় এটি ইংরেজি science শব্দের পরিভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই বাংলায় বিজ্ঞান শব্দের অর্থ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার ফলে কোন বিষয়ে ক্রম অনুসারে লব্ধ জ্ঞান। ঈশ্বরানুভূতি এবং গবেষণালব্ধ জ্ঞান একেবারে বিপরীত। দেখা যাচ্ছে, পরিভাষার অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এটিই বর্তমানে একটি সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞার জন্ম দিয়েছে।

একই শব্দের অনেকগুলো সমার্থক শব্দ বা প্রতিশব্দ থাকলে ভাষা খুব সমৃদ্ধশালী হয়ে থাকে। বিপুল প্রতিশব্দের জন্য আরবি ভাষা বিখ্যাত। আরবি ভাষায় দেখা গিয়েছে এক ঘোড়া শব্দের প্রায় একশত প্রতিশব্দ রয়েছে। তাই আমরা বহুল ব্যবহৃত বিদেশি শব্দের পরিভাষা তৈরি করে বাংলা এবং বিদেশি শব্দ উভয়কে প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করতে পারি।

আমরা এখানে প্রতিশব্দ বলতে কোন বিদেশি শব্দের বাংলায় প্রকাশ, যা কোন বিশেষ সংজ্ঞা গ্রহণ করে না তাকে বুঝাবো। তবে সাধারণভাবে পরিভাষা ও প্রতিশব্দ প্রায় একই অর্থে ব্যবহার করা হবে। অর্থাৎ যে কোন বিদেশি শব্দের সংক্ষেপে বাংলায় প্রকাশ, তা বিশেষ অর্থবোধক, সংজ্ঞাবাচক বা সাধারণ শব্দই হোক না কেন, তা-ই এখানে পরিভাষা বা প্রতিশব্দ হিসেবে বলা হবে। রবীন্দ্রনাথও দুটোকে একই অর্থে ব্যবহার করেছেন। যেমন, তিনি তাঁর বিখ্যাত 'প্রতিশব্দ' প্রবন্ধে লেখেন, 'Originality শব্দের যে প্রতিশব্দ আজকাল চলিতেছে সেটা ‘মৌলিকতা’। সেটা কিছুতেই আমার ভালো লাগে নাই।'

বাংলা পরিভাষা তৈরির কাজ শুরু হয় উনিশ শতকে এ দেশে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার সূত্রপাতের কালে। বাংলা পারিভাষিক শব্দ তৈরির বিভিন্ন নীতিকৌশল নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে। কেউ চান শব্দের সহজবোধ্যতা, কেউ শ্রুতিমাধুর্য, কেউ চান শব্দের দৃঢ়তা। বাংলা করতে গিয়ে কেউ হয়েছেন শুধুই সংস্কৃতনির্ভর, কারো বা পক্ষপাত আরবি-ফারসি দেশী শব্দের ওপর। আবার কেউ করেছেন লোকমুখে প্রচারিত হয়ে যাওয়া কোন শব্দের ওপর। রবীন্দ্রনাথ জোর দিয়েছেন পারিভাষিক শব্দের প্রকাশ-সামর্থ ও যাথার্থের ওপর। শব্দের অর্থের মধ্যে তিনি সবসময় যুক্তি খুঁজতেন। যুক্তিতে না টিকলে তিনি সরাসরি মূলভাষার শব্দটিকে গ্রহণ করতেন, যেমন করেছিলেন ‘রোমান্টিক' শব্দের বেলায়। এই শব্দের তিনি কোনো বাংলা করতে যান নি। বাংলা করেন নি অনেক শব্দের।

বাংলা পরিভাষার অপর সম্ভাব্য উৎস ‘প্রাকৃত বাংলা’। চলতি বাকরীতি ও শব্দভাণ্ডারে সম্ভাব্য পরিভাষার সন্ধান করার কথা প্রথম তুলেছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। চালুভাষার লোকপ্রচলিত শব্দের দিকেই ছিল তার মূল পক্ষপাত। ‘নূতন কথা গড়া’ প্রবন্ধে তিনি সংক্ষেপে তার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করেছেন [হরপ্রসাদ ২০০০/বি: ৫৫২-৫৮]। ‘নূতন কথা গড়া’ প্রবন্ধ ছাড়াও ‘অষ্টম বঙ্গীয় সাহিত্য-সম্মেলনের সাহিত্য-শাখায় সভাপতির সম্বোধন’ প্রবন্ধে তার এই পক্ষপাত ঘোষিত হয়েছে:
''বাংলায় আকাশে তারা মাপিবার যন্ত্রঘর ছিল না। যখন কলিকাতায় সেই ঘর হইল, পণ্ডিত মহাশয়েরা তাহার তর্জমা করিলেন ‘পর্যবেক্ষণিকা’। কথাটা একে তো চোয়ালভাঙা, তাহাতে আবার কঠিন সংস্কৃত— শুদ্ধ কি না সে বিষয়েও সন্দেহ। হিন্দুস্থানি গাড়োয়ানেরা অত শত বুঝে না— তাহারা উহার নাম রাখিল ‘তারা-ঘর’, মোটামুটি উহার উদ্দেশ্য বুঝাইয়া দিল, কথাটি শুনিতেও মিষ্ট। তবে উহা চালাইতে দোষ কী? এইরূপ অনেক নূতন জিনিস, নূতন ভাব নিত্যই আসিতেছে; তাহাদের জন্য কথা গড়া একটা বিষম সমস্যা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আমার বোধ হয়, বাংলা হইতেই এ সমস্যার পূরণ হওয়া ভালো, বাংলা কথা দিয়াই নূতন কথা গড়া উচিত। নিতান্ত না পারিলে, আসমিয়া, হিন্দি ও উড়িয়া খুঁজিয়া দেখা উচিত; তাহাতেও না হইলে যে ভাষার ভাব, সেই দেশের কথাতেই লওয়া উচিত। আমরা তো চিরকালই তাহাই করিয়া আসিতেছি, নহিলে ‘বাতাবি লেবু’, ‘মর্তমান কলা’, ‘চাঁপা কলা’ কোথা হইতে পাইলাম? সেইরূপ এখনো সোজা বাংলায়, সোজা কথায় এ সকল নূতন জিনিসের নাম দেওয়া ও নূতন ভাব প্রকাশের চেষ্টা করা উচিত; নহিলে কতকগুলো দাঁতভাঙা কট্কটে শব্দ তৈয়ার করিয়া লইলে ভাষার সঙ্গে তাহা খাপ খাইবে না।'' [হরপ্রসাদ ২০০০/বি: ৩৭১-৭২]

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের সাধারণ মানুষ তাদের কৃষিকাজের জন্য ‘গভীর নলকূপ’ ব্যবহার করে। এই গভীর নলকূপটি যে ইংরেজি ‘ডিপটিউবওয়েল’ থেকে এসেছে, পরিভাষা হিসেবে তা তারা জানে না। বাংলা ভাষার ভান্ডারে নতুন শব্দ এল, বাংলা ভাষাভাষী মানুষ তা গ্রহণও করল। এভাবে পরিভাষা তৈরি হয়, ভাষা সমৃদ্ধ হয়।

ভাষা বিশারদ মুহাম্মদ এনামুল হক এ প্রসঙ্গে লিখেছেন—‘দেশের গণমানব বাংলা মুদ্রাক্ষর যন্ত্রের খবর রাখে না, বাংলা পরিভাষা তৈরিরও তোয়াক্কা করে না। প্রকৃতপক্ষে তারাই বাংলা ভাষার মূল ধারক ও বাহক। তাদের কাজ চালানোর মতো প্রয়োজনীয় পরিভাষা তারা নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছে ও নিচ্ছে।’ (মনীষা-মঞ্জুষা; ১৯৭৬) তিনি এগুলোকে লৌকিক পারিভাষিক শব্দ উল্লেখ করে কিছু দৃষ্টান্তও দিয়েছেন: অ্যারোপ্লেন>উড়োজাহাজ, রেডিও>বেতার, কন্ট্রাক্টর>ঠিকাদার, বোম্ব>বোমা, ইঞ্জিন>ইঞ্জিল, ভোটিং>ভোটাভুটি, জেনারেল>জাঁদরেল প্রভৃতি।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পরিভাষা নিয়ে বলেন, ‘আমাদের চেষ্টা করা উচিত পরিভাষা তৈরি করা। বিজ্ঞান বিষয়ক যদি কিছু হয়, তবে তা আলাদা কথা। বিজ্ঞানের অনেক শব্দ আছে যার হয়তো প্রায়োগিক ও যুৎসই বাংলা করা সম্ভব নয়। সেটা আমরা সরাসরি নিতে পারি। কিন্তু যে শব্দগুলো তৈরি করা সম্ভব তা সরাসরি না নিয়ে তৈরি করা উচিত। আর এটিই ঠিক পথ। আঞ্চলিক শব্দ থেকেও মূল ধারায় শব্দ আনা যেতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘প্রচলিত শব্দ থাকলে সেটিই প্রথম নেয়া উচিত। প্রচলিত শব্দ কোনভাবেই বাদ দেয়া ঠিক নয়। আর প্রশাসনিক পরিভাষা অবশ্যই ভালোভাবে করা উচিত। কারণ এখান থেকেই মানুষ প্রথম এবং বেশি শেখে।’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ এপ্রিল, ২০১২)

পরিভাষা বা প্রতিশব্দ অনেক সময় আম-জনতা লোকমুখে তৈরি করলেও, তা তৈরি মোটেও কোন সহজ কাজ নয়। এর জন্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, গবেষণা, পরিকল্পনা, গ্রহণযোগ্য করে তোলা ও প্রচারণার মত অনেকগুলো কাজ সম্পাদন করতে হয়। অনেকক্ষেত্রে এটা একটা প্রাতিষ্ঠানিক কাজও বটে। বাংলাদেশে পরিভাষা নিয়ে কাজ করেছেন ভাষাবিজ্ঞানী মনসুর মুসা। তিনি বাংলায় পরিভাষার সমস্যা ও করণীয় বিষয়ে বলেন, ‘বাংলা পরিভাষা পরিস্থিতি ও আমাদের করণীয় সম্বন্ধে বলতে গেলে তিনটি পর্যায়ে আলোচনা করতে হবে। একটি হচ্ছে পরিভাষা বা পরিশব্দ সৃষ্টি পরিস্থিতি, দ্বিতীয়টি হলো সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে পরিশব্দ প্রচার-পরিস্থিতি, তৃতীয়তটি হলো পরিভাষা ব্যবহারকারীর আগ্রহ।

প্রথমত. বাংলা একাডেমী, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যা পরিভাষা বা পরিশব্দ সৃষ্টি করেছে তা জ্ঞানচর্চার জন্য যথেষ্ট নয়। সব শব্দ এক দিনে সৃষ্টি করা যায় না। কিন্তু যা সৃষ্টি হয়েছে তার যথাযথ বিতরণ ও ব্যবহারও হচ্ছে না। ফলে পরিভাষা পরিস্থিতি যতটা স্বভাবমুখী হওয়া উচিত ছিল, ততটা স্বভাবমুখী না হয়ে বিভাষামুখী হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক পরিভাষা কমিটিগুলোতে আমাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব কিংবা অংশীদারি নেই। এমনকি ভাষিক এলাকা হিসেবে উপমহাদেশের পরিভাষা পরিস্থিতি খুব সন্তোষজনক নয়। সার্ক অঞ্চলে একটি পরিভাষা সমতা কমিটি গঠন একান্ত প্রয়োজন।

তিন.
"বাংলায় সংস্কৃত ব্যাকরণের ব্যভিচার অনেক চলিয়াছে; কিন্তু আজকালকার দিনে পূর্বের চেয়ে পাহারা কড়াক্কড় হওয়ায় সে সম্ভাবনা আর নাই।" - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রতিশব্দ।

পরিভাষা তৈরি ব্যাকরণের একটি অংশ বটে। গত একশ বছরে আমাদের ব্যাকরণ গ্রন্থ করা হয়নি। যা এখন আছে তা সংস্কৃত ও ইংরেজির আদলে। বাক্যে শব্দের অযথা সংস্কৃতায়নে রবীন্দ্রনাথের সম্মতি ছিলো না৷ ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব’ গ্রন্থের ‘অনুবাদচর্চা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘‘ইংরেজি বাক্য বাংলায় তরজমা করিবার সময় অনেকেই সংস্কৃত শব্দের ঘটা করিয়া থাকেন।’’

সংস্কৃতায়িত অনেক পারিভাষিক শব্দই রবীন্দ্রনাথের সমর্থন পায় নি। বহুল ব্যবহৃত ‘গঠনমূলক' এবং ‘বাধ্যতামূলক' শব্দকে তিনি বলেছেন বর্বর শব্দ। ‘সহানুভূতি' শব্দটির প্রতিও রবীন্দ্রনাথ বেশ বিরক্ত ছিলেন। ‘অবলাবান্ধব' পত্রিকার সম্পাদক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ইংরেজি 'সিম্প্যাথি' শব্দের বাংলা করেছিলেন ‘সহানুভূতি'। শব্দটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য – ‘‘সহানুভূতির ওপর আমার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই।'' পরে তিনি তাঁর মন্তব্যকে আরো তীক্ষ্ণ করেছেন, বলেছেন, ‘‘সাহিত্যের হট্টগোলে এমন অনেক শব্দের আমদানি হয়, যা ভাষাকে চিরদিনই পীড়া দিতে থাকে। যেমন, সহানুভূতি।'' রবীন্দ্রনাথ ‘সিম্প্যাথি'র প্রতিশব্দ করতে চেয়েছিলেন ‘অনুকম্পা'। তবে ‘দরদ' শব্দটির ওপর তাঁর চরম দুর্বলতা ছিলো।

সংস্কৃতায়িত অনেক শব্দ সম্বন্ধে আপত্তি তুললেও পরিভাষা প্রণয়নে রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃত ব্যাকরণের ওপরই নির্ভর করেছিলেন বেশি। তিনি বলেছেন, ‘‘ইংরেজিতে যে-সব শব্দ অত্যন্ত সহজ ও নিত্য প্রচলিত, দরকারের সময় তার প্রতিশব্দ সহসা খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন তাড়াতাড়ি যা হয় একটা বানিয়ে নিতে হয়। সেটা অনেক সময় বেখাপ হয়ে দাঁড়ায়, অনেক সময় মূল ভাবটা ব্যবহার করাই স্থগিত থাকে। অথচ সংস্কৃত ভাষায় হয়তো তার অবিকল বা অনুরূপ ভাবের শব্দ দুর্লভ নয়। একদিন ‘রিপোর্ট' কথাটার বাংলা করার প্রয়োজন হয়েছিল। সেটাকে বানাবার চেষ্টা করা গেল, কোনোটাই মনে লাগল না। হঠাৎ মনে পড়লো কাদম্বরীতে আছে ‘প্রতিবেদন' – আর ভাবনা রইল না প্রতিবেদন, প্রতিবেদিত, প্রতিবেদক যেমন করেই ব্যবহার করো কানে বা মনে কোথাও বাধে না।''

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যক্তিগত চর্চায় চলতি বাংলা থেকে পরিভাষা বা প্রতিশব্দ খোঁজার চেষ্টা খুব একটা করেন নি। তার তত্ত্ব-তালাশ প্রধানত সংস্কৃত-উৎসেই আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু চলতি বাংলায় এ ধরনের যুৎসই প্রতিশব্দ খোঁজার তাৎপর্য সম্পর্কেও তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। শুধু তাই নয়। যে ধরনের সংস্কারের বশে চালু শব্দের মধ্যে দরকারি পরিভাষা ও প্রতিশব্দ না-খোঁজার রেওয়াজ তৈরি হয়েছে, তারও পরিচয় দিয়েছেন: ''ইংরেজি অনেক নিত্যপ্রচলিত সামান্য শব্দ আছে বাংলায় তাহার তর্জমা করিতে গেলে বাধিয়া যায়। ... ইহার একটা কারণ, তর্জমা করিবার সময় আমরা স্বভাবতই সাধু ভাষার সন্ধান করিয়া থাকি, চলিত ভাষায় যে-সকল কথা অত্যন্ত পরিচিত সেইগুলিই হঠাৎ আমাদের মনে আসে না। চলিত ভাষা লেখাপড়ার গণ্ডির মধ্যে একেবারেই চলিতে পারে না এই সংস্কারটি থাকাতেই আমাদের মনে এরূপ বাধা ঘটিয়াছে।'' [রবীন্দ্রনাথ ১৪০২: ১৮৮]

সংস্কৃত ভাষায় ‘চালু’ এবং ‘সহজ’ শব্দ পাওয়া গেলে বাংলা পরিভাষা হিসাবে তা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ — জটিল, দুর্বোধ্য ও নতুন-তৈরি লম্বা শব্দ নয়।

পরিভাষা তৈরির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক-একটি প্রতিশব্দ বা পরিভাষা প্রস্তাব করেছেন, আর তা বিচারের ভার ছেড়ে দিয়েছেন বৃহত্তর পাঠকসমাজের কাছে। এ ক্ষেত্রে তিনি লিখেছেন, ‘চেষ্টার দ্বারা চেষ্টাকে উত্তেজিত করা যায়, সেইটেই লাভ। এইজন্যই, কোনো ওস্তাদীর আড়ম্বর না করিয়া আমাদের সাধ্যমত পত্রলেখকদের প্রেরিত ইংরেজি শব্দের প্রতিশব্দ ভাবিয়া বাহির করিবার চেষ্টা করিতেছি।’ [রবীন্দ্রনাথ ১৪০২: ১৯৩]

রবীন্দ্রনাথের করা ৯১৩ টি পারিভষিক শব্দের তালিকা ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব’ গ্রন্থের বৈশাখ ১৩৯১-এ প্রকাশিত তৃতীয় স্বতন্ত্র সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছিল। অপহরণ, অভিযোজন, অনীহা, অনুষঙ্গ, প্রতিবেদন, পটভূমিকা, আকাশবাণী, অনুষ্ঠান, অভিজ্ঞান-পত্র, প্রতিলিপি, অপকর্ষ, আপতিক, আপজাত্য, প্রণোদন, দুর্মর, লোকগাথা, প্রাগ্রসর, অনুকার, প্রতিষ্ঠান, নঞর্থক, আবাসিক, অনাবাসিক, অবেক্ষা, ঐচ্ছিক, ক্ষয়িষ্ণু, অনুজ্ঞা, রূপকল্প, জনপ্রিয়, যথাযথ, আঙ্গিক, প্রদোষ, মহাকাশ প্রভৃতি চমৎকার শব্দ তাঁরই বানানো। এগুলো বাংলার স্বাভাবিক শব্দভাণ্ডারের অঙ্গীভূত হয়ে গেছে।

রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত-সংকলিত-নির্মিত পরিভাষার তালিকা বিরাট রয়েছে। কিন্তু এ তালিকার বিপুল বা অধিকাংশ শব্দই পরিত্যক্ত হয়েছে। পরিভাষার ক্ষেত্রে তাই রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব নির্বাচনের চেয়ে তাঁর মূলনীতি আর কর্মপ্রক্রিয়া অধিকতর প্রাসঙ্গিক।

চার.
সম্প্রতি বাংলা ভাষায় নতুন আড়াই হাজার বিদেশি শব্দ আত্তীকরণ করা হয়েছে। প্রয়োজন ছাড়াই ঢুকানো হয়েছে অনেক বিদেশি শব্দ। বাদ পড়ছে প্রচলিত অনেক যুৎসই বাংলা শব্দ। বাংলা ভাষায় প্রতিনিয়ত ঢুকছে বিদেশি শব্দ। এর ফলে অনেক প্রচলিত শব্দ বাদ যাচ্ছে দৈনন্দিন ব্যবহারের তালিকা থেকে। মানুষের মুখে মুখে যেমন উচ্চারিত হচ্ছে বিদেশি শব্দ, তেমনি সরকারিভাবেও প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অনেক বিদেশি শব্দ আত্তীকরণ করা হয়েছে। মান বা প্রমিত বাংলার বাইরে অঞ্চলভেদে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর নিত্যব্যবহূত আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা থেকে একটি শব্দও নতুন সেই তালিকায় স্থান পায় নি।

বাংলাদেশের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ (বাবাকো) প্রশাসনিক পরিভাষা তৈরি করে। ১৮ বছর পর বাবাকো নতুন করে প্রশাসনিক পরিভাষা প্রকাশ করেছে ২০১১ সালের অক্টোবরে। এর আগে ১৯৯৪ সালে প্রশাসনিক পরিভাষা প্রকাশ করেছিল তারা। নতুন পরিভাষা কোষটির প্রকাশনা বিষয়ক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘অনেক নতুন শব্দ নতুন কলেবরে প্রশাসনিক পরিভাষায় অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়ায় প্রায় ২৫০০ নতুন শব্দ অন্তর্ভুক্ত করে বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ প্রশাসনিক পরিভাষা পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশ করেছে।’

বাবাকো’র নতুন প্রশাসনিক পরিভাষা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, যেসব বিদেশি শব্দ পরিভাষায় আনা হয়েছে, সেসবের অনেকগুলোরই বিকল্প হিসেবে যথেষ্ট যুত্সই বাংলা শব্দ রয়েছে। সেগুলো বহুল প্রচলিতও বটে। শুধু অভিধানে নয়, মানুষের মুখে মুখেও সেসব শব্দ চালু আছে। তবু সেসব শব্দ বাদ দিয়ে সরাসরি ইংরেজি শব্দটিকে বাংলায় স্থান দেয়া হয়েছে। যেমন, ‘স্টক এক্সচেঞ্জ’ শব্দটিকে বাংলায় আনা হয়েছে। এর বিকল্প হিসেবে রাখা হয়েছে ‘শেয়ার বাজার’ শব্দটি। বাংলা আর ইংরেজি মিশিয়ে এটি করা হয়েছে। কিন্তু বহুল প্রচলিত ‘পুঁজি বাজার’ শব্দটিকে রাখা হয়নি পরিভাষায়। এমন আরো অনেক ইংরেজি শব্দ হুবহু বাংলা হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে। যেমন—মেডিকেল অফিসার, পাসওয়ার্ড, সিকিউরিটি, সিভিল সার্ভিস ইত্যাদি। কিন্তু এসবের প্রত্যেকটির প্রচলিত বাংলা শব্দ রয়েছে। যেমন—মেডিকেল অফিসার> চিকিত্সা কর্মকর্তা, পাসওয়ার্ড>গোপন নম্বর, সিকিউরিটি>নিরাপত্তা, সিভিল সার্ভিস>জনপ্রশাসন ইত্যাদি।

নতুন কলেবরে বের করা পরিভাষায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইংরেজি ও বাংলা দুইটি শব্দই পাশাপশি রাখা হয়েছে। ব্যবহারকারী তার ইচ্ছেমতো যেকোনটিই ব্যবহার করতে পারবে। যেমন ‘একটিং প্রেসিডেন্ট’-এর দুইটি বাংলা করা হয়েছে। ‘অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট’ ও ‘অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি’। এ ধরনের আরো শব্দ রাখা হয়েছে। যেমন—মর্গ/শবাগার, বাসা/কোয়ার্টার, প্রতিবেদক/রিপোর্টার, সিদ্ধান্ত/রুলিং, সাইরেন/সংকেত বাঁশি, স্টক/মজুদ, এক্স-রে রিপোর্ট/রঞ্জন রশ্মি প্রতিবেদন, উড়োজাহাজ/বিমান, ব্যাংক জামানত/ ব্যাংক গ্যারান্টি, অঙ্গন/ ক্যাম্পাস, ক্যাপশন/ পরিচয়জ্ঞাপক বিবরণ, সার্টিফিকেট/ সনদ, ডেসপাচ/প্রেরণ করা, ডাউনপেমেন্ট/ক্রয়মূল্যের প্রাথমিক পরিশোধযোগ্য অংশ, এন্ট্রি ফি/প্রবেশ মূল্য, ইরেজার/মুছিয়া ফেলা, নিশ্চিহ্ন করা, দ্রুত টেলিগ্রাম/তারবার্তা, প্রধান কার্যালয়/প্রধান অফিস, হাইজ্যাক/ছিনতাই, হট লাইন/সরাসরি লাইন, হাইব্রিড/সংকর, জেলখানা/কারাগার, এজমালি/যৌথ ভূসম্পত্তি/জয়েন্ট ইস্টেট, জার্নাল/পত্রিকা ইত্যাদি। কিছু ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে শব্দ করা হয়েছে। যেমন—ব্যাংকের পাসবই, বাণিজ্যিক এজেন্ট, কাউন্টার বিলি, তলবী ড্রাফট, জরুরী ওয়ার্ড ইত্যাদি।

যেসব বিদেশি শব্দ প্রশাসনিক পরিভাষায় সরাসরি ঢুকিয়ে বাংলায় আত্তীকরণ করা হয়েছে সেগুলো হলো এডহক, অ্যাডমিরাল, এজেন্সি, ব্যাংক ড্রাফট, ব্যাংক নোট, ব্যানার, বার কাউন্সিল, ব্যারিস্টার, ব্যাটেলিয়ান, ব্যাটারি, ব্যাটারি চার্জ, বিল, ব্রীফকেস, ব্রডব্যান্ড, বাজেট, ক্যাডেট, ক্যাডার, ক্যাডার সার্ভিস, ক্যাম্প, ক্যাপ্টেন, কপি, ক্যাশবই, সিনিয়র ক্যাম্প রেজিস্টার, ক্যাসেট, চার্টার অ্যাকাউন্টান্ট, চেক/ব্যাংক চেক, সিভিল, সিভিল সার্ভিস, সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট, ক্লিনিক, কোচিং সেন্টার, কমিশন এজেন্ট, কমনওয়েল্থ, কম্পাউন্ডার, কম্পিউটার, কনফারেন্স, কনস্টেবল, কনসাল, কনসাল অফিস, কন্টেইনার সার্ভিস, কর্পোরেশন, কালভার্ট, ডিজিটাল, ডিপ্লোমা, ডিভিশন বেঞ্চ, ই-মেইল, এস্টাব্লিসমেন্ট, ম্যানুয়াল, ইস্টেট, এক্সচেঞ্জ ফি, ফেলোসিপ ফাউন্ডেশন, গ্যালারি, গ্যারেজ, ব্রড গেজ, মিটার গেজ, গেজেট, গেজেটেড অফিসার, গার্ল গাইড, গ্রেড, গার্ড ফাইল, হার্ডডিস্ক ইনবক্স, ইনস্টিটিউট, ইন্টারনেট, কিটবক্স, লেবেল, ল্যাপটপ লে-অফ, লে-আউট, লেভেল ক্রসিং, লাইসেন্স, লাইফ ভেস্টা, লাইন, লক আউট, মেসার্স, মেইলবক্স, মেইন ট্রেন, ম্যানহোল, মাস্টার রোল, মিটার, মিল, মিস্ড কল, মিশন, মিকচার, মোবাইল ফোন, মডেম, মানিঅর্ডার, মনিটর, মনোগ্রাম, মাদারবোর্ড, মাউস, নোটারী পাবলিক, নোট শীট, নোটিশ, অফিসিয়েলিং আউটবক্স, ওভারড্রাফট, প্যাকেট, প্যানেল, পার্শেল, পাসওয়ার্ড, পে-অর্ডার, পে-রোল, পে-স্লিপ, পারমিট, পেট্রোল, ফোন, ফটো, ফটোপ্রিন্ট, ফটোকপি, পিকেটিং প্লাকার্ড, প্লাস্ট, প্লাটফর্ম, প্লাটুন, পোর্টফোলিও, পোস্টাল অর্ডার পাওয়ার অব এটর্নি, প্রেসক্লিপিং, প্রেসকাটিং, প্রাইজবন্ড, প্রমিসরি নোট, প্রটোকল, রাডার, লটারী, রেস পুলিশ, র্যালি, রেকর্ড, রেফারী, রিমান্ড, রোটারী ক্লাব, রয়্যালটি, রবার স্ট্যাম্প, রানওয়ে, সেলুন, স্কেল, স্কল, সার্চ লাইট, সীট-বেল্ট, সেক্টর, সিনেট, সেপটিক ট্যাংক সার্ভিস, সার্ভিস চার্জ, সেটেলমেন্ট, শেয়ার সার্টিফিকেট, শেয়ার হোল্ডার, শুটিং, শর্ট সার্কিট, শো-রুম সাটস ট্রেন, স্লিপ প্যাড, স্লোগান, স্লুইস গেইট, সলিসিটর, স্পীড বোট, স্পাইরাল বাইন্ডিং, স্পন্সর, স্টেডিয়াম, স্ট্যাম্প, স্টেশন, স্ট্রং-রুম, সাব-পোস্ট অফিস, সাব-এজেন্সি, সিম্পোজিয়াম, সিন্ডিকেট, সিনথেটিক, ট্যাগ, ট্যানারি, টেলিগ্রাম মনিঅর্ডার, টেলিফোন, টেলিপ্রিন্টার, টেলেক্স, টেরেস্ট্রিয়াল, টেস্ট, টেস্ট রিলিফ, টাইমস্কেল, টিস্যু পেপার, টয়েলেট, ট্রেড-ইউনিয়ন. ট্রফি ট্রান্সফর্মার, ট্রলার, ট্রেজারি বিল, ট্রাইব্যুনাল, ট্রাংক কল, ট্রাস্ট, টাইফয়েড, ইউনিয়ন, ইউনিট, ভল্ট, ভাইস চেয়ারম্যান, ভিটামিন, ভোল্ট, ভাউচার, ওয়েবসাইট ইত্যাদি।

পাঁচ.
আধুনিক সভ্যতার বিস্ময়কর অগ্রগতির কারণে অসংখ্য বিদেশি পারিভষিক শব্দ আমরা এখন বাংলায় ব্যবহার করছি। কিন্তু এগুলোর বাংলা হওয়া দরকার। এরকম কিছু শব্দের বাংলার প্রস্তাব করেছি, যার সবগুলোই আমার তৈরি নয়। নেট থেকে বিভিন্ন জনের করা শব্দও এখানে স্থান পেয়েছে। পাঠকবৃন্দকেও অনুরোধ করছি এগুলোকে মূল্যায়ন করতে এবং পারলে নতুন কিছু শব্দ যোগ করতে।

তবে বহুল ব্যবহৃত কিছু শব্দের বাংলা করার আসলে অতটা প্রয়োজন নেই। যেমন, কম্পিউটার, কিবোর্ড, মাউস, টিভি, রেডিও, ফ্রীজ, বিউটি পার্লার, ফাস্টফুড ইত্যাদি। তারপরও প্রতিশব্দ হিসেবে এগুলোর সুন্দর বাংলা করে উভয় শব্দই ব্যবহার করা যায়।

১. হোমপেজ = নিজপাতা, আপনঘর, নিজকথা, নীড়পাতা (ইতোমধ্যে নীড়পাতা শব্দটি সচেলায়তন ব্লগে নিজস্ব পরিভাষা হিসেবে ব্যবহৃত। কিন্তু হোমপেজের আক্ষরিক অর্থ হলেও বুঝতে কঠিন। আমি নিজেও বুঝতাম না। পরে কোন এক ব্লগে এর অর্থ জানতে পারি।)
২. ইমেল = উড়োডাক, ই-ডাক, ই-চিঠি, হাওয়াই ডাক, বৈচিঠি, তড়িৎ-চিঠি, তড়িৎ বার্তা
৩. ব্লগ = মনকথা, দিনলিপি, নেটনামচা, নেটনামা, আপনমন, আপনকথা, জীবনজাল, হাওয়াইজীবন, অন্তর্জালজীবনী, দিনক, মনপ্রকাশ, থেড়োখাতা, রাফখাতা
৪. আর্কাইভ = তথ্যভাণ্ডার, আড়ৎ, সংগ্রহশালা, ভাণ্ডার, রক্ষণভাণ্ডার, অভিলেখাগার
৫. কিবোর্ড = লেখাচাবি
৬. মাউস = অন্যহাত,
৭. কম্পিউটার = গণকযন্ত্র, সর্বকর্মা (!)
৮. ল্যাপটপ =
৯. গেমবয় = ছেলেখেলা
১০. cut = কাটো
১১. paste = সাঁটো, জুড়ে দাও
১২. copy = ছাপ, ছাপ্পা, ছাপো, অনুলিপি
১৩. delete = ছাঁটো, বাদ দাও
১৪. পাসওয়ার্ড = গোপন নম্বর
১৫. ওয়েবম্যাগ = গতিপত্র, পত্রজাল
১৬. টেলিফোন = দূরভাষ
১৭. মোবাইল ফোন = মুঠো ফোন
১৮. রেডিও = বেতার
১৯. টিভি = দূরদর্শন
২০. ফ্লাইওভার = উড়ালসেতু, উড়োরাস্তা, উড়ালসড়ক
২১. রিমোট কন্ট্রোল = দূরনিয়ন্ত্রণ
২২. গ্যালারি (নাট্যমঞ্চ/মাঠ) = দর্শকসারি ( 'আজ গ্যালারি পরিপূর্ণ' না বলে 'আজ দর্শকসারি পরিপূর্ণ' শুনতে মনে হয় খারাপ শোনায় না), দর্শনাঙ্গন, দেখাঙ্গন
২৩. ছবির গ্যালারি = ছবিঘর, চিত্রাঙ্গন
২৪. হারমোনিয়াম =
২৫. বিউটি পার্লার = রূপ-ঘর, সাজঘর, রূপাধার, রূপনীড়
২৬. শো রুম = দর্শন দেউড়ি, প্রদর্শন-কক্ষ
২৭. ওয়াশরুম = প্রক্ষালন কক্ষ, ধৌতকক্ষ
২৮. বাথরুম = গোসলখানা,স্নানাগার, স্নানাধার
২৯. শাওয়ার = ঝাঁঝরি, ঝরণা, জলধারা
৩০. প্লেট = থালা, বর্তন
৩১. কাপ-প্লেট = পেয়ালা-পিরিচ
৩২. ন্যাশনাল আইডি = জাতিচিহ্ন,
৩৩. সার্টিফিকেট = চিহ্নসূত্র, চিহ্নপত্র
৩৪. স্কেল/ রুলার = রেখানি, মাপনী
৩৫. বার্ড ফ্লু = মুরগিজ্বর, পক্ষিজ্বর
৩৬. ম্যাড কাউ = গাইপাগলী, গরুরোগ
৩৭. গ্লোবাল ওয়ার্মিং = বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, ভুবনোষ্ণতা
৩৮. লেন্ডফিল = বর্জ্যভূমি; আবর্জনাভূমি
৩৯. টেলিপ্যাথি = ভাবতরঙ্গ, উড়োসংযোগ, ভাবসংযোগ
৪০. ফাস্টফুড = দ্রুতাহার (দ্রুত আহার), নাস্তা
৪১. এমপিথ্রি প্লেয়ার =

উনিশ ও বিশ শতকে পরিভাষা প্রণয়নে ব্যক্তিপর্যায়ে অক্ষয়কুমার দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, রাজশেখর বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল মনসুর আহমেদ, প্রিন্সিপ্যাল আবুল কাসেম প্রমুখ এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমী প্রভৃতির অবদান অস্বীকার্য। অথচ একুশ শতকে এসে যেন আমাদের পরিভাষা প্রণয়ন প্রচেষ্টা থমকে গেছে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করতে হলে আমাদের পরিভাষা ও প্রতিশব্দ তৈরির বিকল্প নেই।


বিশেষ ঘোষণা
এ লেখাটি হয়তো এ পর্বের শেষ লেখা। তারপর বানান-ক্লাস অথবা বানান-পাঠ নামে এ লেখার ২য় সিরিজ শুরু করবো, ইনশাআল্লাহ। এতে প্রত্যেক পর্বে বানানের কিছু নিয়ম আলোচনা করবো, শেষে অনুশীলনী থাকবে। এভাবে চর্চা করলে আশা করা যায়, বাংলা বানান সবার কাছে সহজ হয়ে যাবে এবং শুদ্ধ বানানে বাংলা লেখতে সবাই অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। আশা করবো, সামু কর্তৃপক্ষ এ লেখাগুলো স্টিকি করবে।


পূর্বের পর্বগুলো:
১ম পর্ব - আমরা বাংলা বানান কতটুকু শুদ্ধ করে লেখি? View this link
২য় পর্ব - বাংলা বানান : আসুন এক ছাতার নিচে View this link
৩য় পর্ব- বাংলা বানানে যত বিভ্রান্তি View this link
৪র্থ পর্ব : বাংলার শব্দভাণ্ডার View this link
৫ম পর্ব : বিকৃতির সয়লাবে আমার মাতৃভাষা View this link
৬ষ্ঠ পর্ব : বাংলা আমার অহঙ্কার View this link


তথ্যসূত্র ও বিশেষ কৃতজ্ঞতা :
[১] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; প্রতিশব্দ
[২] সৌরভ সিকদার; বাংলা পরিভাষা: নতুন কোনো নির্মাণ নেই, (০৩.০২.২০১০, প্রথম আলো)
[৩] ফরহাদ খান; রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা পরিভাষা,www.dw.de (30 languages website)
[৪] মোহাম্মদ আজম; বাংলা পরিভাষা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ (০৮.০৫.২০১৪, বাংলামেইল২৪ডটকম)
[৫] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; বাংলা শব্দতত্ত্ব, তৃতীয় স্বতন্ত্র সংস্করণ, পুনর্মুদ্রণ, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা
[৬] হরপ্রসাদ শাস্ত্রী; রচনা-সংগ্রহ, দ্বিতীয় খ-; ২য় মুদ্রণ, সত্যজিৎ চৌধুরী, দেবপ্রসাদ ভট্টাচার্য, নিখিলেশ্বর সেনগুপ্ত ও সুমিত্রা ভট্টাচার্য সম্পাদিত; পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, কলকাতা
[৭] উইকিপিডিয়া; পরিভাষা
[৮] ব্লগার অপার্থিব; ভাষা দিবসে প্রমিত ভাষা, উপভাষা, পরিভাষা ইত্যাদি নিয়ে কিছু কথা (মুক্তমনা ব্লগ, ২১.০২.২০১২)




সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০১৪ দুপুর ১২:৪১
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×